বিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যাঙ্গনে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছেন, উল্লেখযোগ্য অনেকের মাঝে কবি শামসুন নাহারও ছিলেন একজন। খুব ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যামোদী পিতার উৎসাহ ও সহযোগিতায় লেখালেখি শুরু করেন। বলা চলে, শিশুকাল থেকেই। সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন ভারতের ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘অভিযান’ নামে তাঁর প্রথম কবিতা ছোটদের আসরে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার পাতায় নিজের লেখা দেখে তিনি প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত হন। দারুণ উৎসাহে শুরু করেন লেখালেখি। তিনি একাধারে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্পও লিখেছেন। যদিও কবিতা এবং প্রবন্ধের তুলনায় গল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়। চট্টগ্রামে একই পরিবারে তিনবোন শামসুন নাহার, আইনুন নাহার, নুরুন নাহার কবি ও লেখিকা বলা চলে, উল্লেখ করার মতো ব্যতিক্রমী পরিবার খুব একটা দৃশ্যমান নয়।
শ্রদ্ধেয় কবি আশীষ সেন দাদা আমাকে একদিন বললেন- ষাট-সত্তর দশকের লেখিকাদের মধ্যে তোমার মা-খালার সাহিত্যাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তোমরা পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁদের নিয়ে লিখো। নয়তো নিভৃতচারিনী এই লেখিকাদের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাও একদিন মুছে যাবে। তাঁর এই কথাটা যথার্থ অর্থবহ বলে মনে হলো। আজ আমি আমার ‘মা’ কবি শামসুর নাহারের জীবন ও সাহিত্যকর্মের কিছু কথা পাঠকের সামনে তুলে ধরবো।
পিতা-মরহুম একরামুল হক। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যানুরাগী ও কংগ্রেস নেতা। জুরি বোর্ডের সদস্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনে সরাসরি জড়িত। তিনি ছিলেন কাজেম আলী স্কুলের প্রথম সফল প্রধান শিক্ষক এবং স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক। মাতা-মরহুমা আছিয়া খাতুন উত্তর কাট্টলীর জমিদার আছু মিয়া চৌধুরীর একমাত্র কন্যা। দাদা- ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শেখ-এ-চাট্্গাম কাজেম আলী। অবিভক্ত ভারতের আইন সভার নির্বাচিত সদস্য এবং কাজেম আলী স্কুলের দাতা প্রতিষ্ঠাতা। স্বামী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ভালুকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
কবি শামসুন নাহার প্রবেশিকা পরীক্ষার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এম.এ. কাশেমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কবির দু’মেয়ে যথাক্রমে, শাহীন ফেরদোসী রুহী সুলতানা; বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। সংস্কৃতিমনা মায়ের উৎসাহে তালিমের পাশাপাশি ‘প্রাচ্য ছন্দ গীতিকায়’ প্রায় ১৫ বছর নৃত্য শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদের’ সাথে সম্পৃক্ত এবং ১৯নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
ছোটমেয়ে-শবনম ফেরদৌসী নিলুফার সুলতানা। তিনিও মায়ের সান্নিধ্যে শিশুকাল থেকেই সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেন। বর্তমানে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ‘প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের’ একজন সদস্য এবং ১৯ নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
কবি শামসুন নাহার বিভিন্ন সময়ে যেমন- শামসুন নাহার, শামসুন নাহার বেগম এবং শামসুন নাহার কাশেম হিসেবে একাধারে সংবাদ, ইত্তেফাক, ইত্তেহাদ, আজাদী, মিল্লাত, আজাদ, পূর্ববাংলা, বান্ধবী, বেগম, নতুনদিন, মাহে নও, দিলরুবা, কোহিনূর ইত্যাদি পত্রিকা ছাড়াও ভারতের যুগান্তর এবং সত্যযুগ পত্রিকায়ও লিখতেন।
কর্মজীবনে তিনি তৎকালীন ‘নতুনদিন পত্রিকার’ চট্টগ্রামের চিঠি বিভাগে প্রায় দু’বছর রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পুরস্কারের তালিকা দীর্ঘ মনা হলেও শিশুকাল থেকে ভারতের তৎকালীন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ছোটদের আসরে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ‘তোমার স্মরণীয় দিন’ প্রবন্ধের জন্য ১ম পুরস্কার ‘অনিল স্মৃতিপদক’ লাভ করেন। ওই একই পত্রিকায় ‘তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? কেন হতে চাও?’ প্রবন্ধের জন্য ৩য় পুরস্কার এবং কোলকাতার আরও একটি প্রবন্ধের জন্য ২য় পুরস্কার অর্জন করেন।
নজরুল প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ময়মনসিংহে ১ম পুরস্কার এবং ‘যশোহর সাহিত্য সংঘ’ থেকে ‘সাহিত্যরত্ন’ বগুড়া থেকে ‘কাব্যভারতী’ উপাধি লাভ করেন। বরিশালে গল্প প্রতিযোগিতায় ৩য় পুরস্কার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৭ সালে তিনি ‘চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের’ প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ১৯৮৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি লেখিকা সংঘের সম্বর্ধনা এবং ‘চট্টগ্রাম শিশু একাডেমি’ থেকে গুণীজন সম্মাননা সম্মানিত হন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে স্বরচিত কবিতা পাঠেও তাঁর নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭৪ সালে তিনি চট্টগ্রামের গুণী সাহিত্যিকদের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি লিখে- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান / নিপীড়িত জনতার পাশে তুমি চির অম্লান,/ তুমি বিদ্রোহী; তুমি যে চির মহামহীয়ান’। তাঁর প্রকাশিত কিছু কবিতা নিয়ে ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর নীলবেদনা’ শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
প্রয়াত কবি ও সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় অরুণ দাশগুপ্ত কবির একটি পাণ্ডুলিপি পড়ে লিখেছেন- ‘মানুষকে যে কবি ভালোবাসেন, তিনি মানুষ ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ না হয়ে পারেন না। সবকিছুকে উপেক্ষো করে মানুষকে পৌঁছে দিতে চান এমন এক চেতনালোকে; যা সমুদ্রে দিকহারা নাবিককে বাতি দেখায়, কবি হিসাবে শামসুন নাহার সেই জাতের কবি’। কবি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধে বহু বর্ণনাতীত দুঃখের সম্মুখীন হন। তাই, তার কবিতায় অসহায় মানুষের দুঃখের কথা উঠে এসেছে বারবার। ‘নতুন দিন’ কবিতায় তিনি লিখেছেন –
‘রুক্ষমুখ চারিদিকে বিলাপের ধ্বনি-
অগ্নিজ্বলা বেদনায় ক্ষুব্ধপ্রাণ ওঠে অনুরণি’।
‘নীল বেদনা’ কবিতায় তাঁর কথা –
‘পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা কেন এই তিক্ত অপমান
মায়াবিনী অভিনয় নির্দয় আঘাত ক্ষুদ্ধ প্রাণ।’
‘অভিমান নয়’ কবিতায় তাঁর হৃদয়ের আর্তি-
‘সব ভুল, ভুল করে আসে বুঝি চৈতি ফাগুন
প্রাণহীন এ পৃথিবী জ্বলে ওঠে ব্যথার আগুন’
অগ্নিকন্যা প্রীতিলতাকে নিয়ে ‘বহ্নিশিখা তুমি’ কবিতায় বলেছেন –
‘বীরকন্যা বিদ্রোহিনী চট্টলের বহ্নিশিখা তুমি
দিকে দিকে খুঁজি আজ তোমার ব্যথিত জন্মভূমি’।
‘জাগো সৈনিক কবি’ কবিতায় নির্বাক কবি কাজী নজরুলকে উদ্দেশ্যে করে বলেছেন,
‘থামেনি এখনো বিশ্বে পীড়িতের ক্রন্দন রোল
শ্রান্ত, ক্লান্ত কেনো জাগো তুমি বিদ্রোহের অশান্ত কল্লোল।
কবি তাঁর ‘মানুষ শ্রেষ্ঠ’ কবিতায় লিখেছেন, –
‘অসীম সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠ সেই মানব মহান
জাগায় ঘুমন্ত মাটি গেয়ে ওঠে জীবনের গান’।
চট্টলার কবি তাঁর ‘চট্টলা’ কবিতায় বলেছেন –
‘কতো মহাপুরুষের উজ্জ্বল স্মৃতির ইতিহাস
অসীম আবেগে জেগে আছে চট্টলের স্নিগ্ধ নীল আকাশ’।
১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ স্ট্রোকে তাঁর ডান পাশ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়। একটু সুস্থ হয়ে তিনি আবার সাহিত্যকর্মে এগিয়ে আসেন। যদিও বাম হাতে লিখে বলতেন, ঠিক করে তাঁর পছন্দের পত্রিকায় যেন পাঠিয়ে দিই।
ঘূর্ণিঝড়ে গৃহহীন চরম মনকষ্টে কবি লিখেছেন –
বেঁচে আছি অর্ধমৃত, নীড়হারা পাখির মতন
সর্বশান্ত হয়ে আজ এলোমেলো অশান্ত জীবন’।
২০ বছর ৫ মাস পক্ষাঘাত অবস্থায় থাকতে থাকতে হাত পা ভেঙে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হন তিনি।
পিতৃহীন পরিবারে একমাত্র অভিভাবক আমার মায়ের উপর পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যেন ভর করেছিল। ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো অর্থনৈতিক মানসিক ও শারীরিকভাবে একটি পরিবারের উপর নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার।
অত:পর অসীম দারিদ্রতায় নীরবে, নিভৃতে ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট তাঁর জন্মদিনটিতেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করবেন সাহিত্যমোদী বিদগ্ধজন। তাঁর সাহিত্য ও কর্মময় জীবনে তিনি বেঁচে থাকবেন।
আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাত নসীব করুন। আমিন।
লেখক: কবি শামসুন নাহার কাশেমের কন্যা