দেশে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারসহ গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অনেকটা থমকে আছে। গত বছরের মাঝামাঝিতে ভোলায় একটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার হলেও নতুন গ্যাস উত্তোলনে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অফশোর এবং অনশোরে প্রচুর গ্যাসের মজুদ থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। গ্যাস আমদানিতে দেখা দেয়া নানা সংকটে দেশে গ্যাসের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
পেট্রোবাংলা সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসের সংকট বেশ প্রকট। বিদেশ থেকে এলএনজি কিনে এনে দেশের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুটেরও বেশি এলএনজি সরবরাহ দেয়া হচ্ছে ন্যাশনাল গ্রিডে। এলএনজি আমদানিতে দেখা দেয়া সংকট সরাসরি প্রভাব ফেলছে দেশের গ্যাস সেক্টরে। এতে করে রেশনিং করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। কৃষির ভর মৌসুমে গ্যাসের অভাবে সিইউএফএলসহ একাধিক সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে রাখতে হয়েছে। বন্ধ রয়েছে গ্যাস নির্ভর একাধিক কারখানা।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে ২৯টি প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছিলো ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে। ১৯৫৭ সালে ওই ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করা হয়েছিল। ২০২১ সালের পর দেশে আর কোনো গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়নি।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে এ পর্যন্ত আবিস্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে সর্বমোট গ্যাসের মজুদ ছিল ২৯.৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট করে ইতোমধ্যে ২০.১১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন এবং ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি ৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস দিয়ে সর্বোচ্চ ৯ বছর দেশের গ্যাস সেক্টর টিকিয়ে রাখা যাবে। এর মধ্যে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার কিংবা গ্যাস কূপ খনন করা না হলে দেশে গ্যাস সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এবং বিদেশী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৩শ’ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস উত্তোলন করা হয়। যা ২০১৬ সালে ২ হাজার ৬শ’ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি উত্তোলন করা হতো। দেশে চাহিদা বাড়লেও গ্যাসের যোগান কমায় বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে গ্যাস সরবরাহ কমাতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এই সংকট আরো প্রকট হয়ে উঠলেও তেমন কিছু করার থাকবে না বলেও সূত্র আশংকা প্রকাশ করেছে।
সূত্র বলেছে, বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলা থেকে সমীক্ষা করে দেশে ৪০ থেকে ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ সব গ্যাস উত্তোলনের জন্য নতুন নতুন উদ্যোগ দরকার। দরকার নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান এবং গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার। কিন্তু নতুন ক্ষেত্র আবিস্কার কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা থমকে আছে বলেও সূত্র উল্লেখ করেছে। দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ২০১১ সালে ‘গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে পরামর্শ’ শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ওই প্রকল্পের আওতায় দেশে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়। যাতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ওইসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়িত হয়নি বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, দেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রের বহু কূপে উৎপাদন কমে গেছে। এ সব কূপ রক্ষণাবেক্ষণ বা ওভারহোলিং করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চল এবং পার্বত্য অঞ্চলে গ্যাসের অনুসন্ধানের ওপর অগ্রাধিকার দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এঙপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেঙ) সক্ষমতা বাড়িয়ে গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার এবং কূপ খননে জোর দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ সব সুপারিশের কোনোটিই খুব বেশি আলো দেখেনি।
সূত্র বলেছে, ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে অন্তত ৪০টি কূপের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হতো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ সব প্রস্তাবনার কোনোটিতেই সরকার সায় দেয়নি। নতুন কূপ অনুসন্ধানে বিনিয়োগের চেয়ে এলএনজি আমদানিতে সরকার বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন স্পট মার্কেটে মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সেই এলএনজি আমদানিতেও দেখা দিয়েছে সংকট। এই অবস্থায় আবারো সরকারকে নিজের ঘরের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে গ্যাসের যে পরিমাণ মজুদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া হলেই কেবল গ্যাস সেক্টরের জ্বালানি নিরাপত্তা অন্তত বিশ বছরের জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।