‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি’ – বাবু গুহঠাকুরতার কথা ও মৃণাল বন্দোপাধ্যায়ের সুরে শিল্পী প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠের এই জনপ্রিয় গানের সাথে আমরা কম–বেশি সবাই পরিচিত। আবহমান কাল থেকে বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে তালপাতার তৈরি হাতপাখাসহ অন্যান্য সামগ্রী। এই যান্ত্রিক যুগেও কিন্তু এটির চাহিদা বেশ লক্ষ্যণীয়। বিশেষত দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা কিংবা অন্যান্য ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মেলায় এগুলো বেশি দেখা যায়।
তালপাতার সিপাই শিশুমনের চিত্তাকর্ষক খেলনা। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় এই খেলনার প্রথম প্রচলন। তালপাতাকে ছোটো ছোটো করে কেটে মানুষের দেহের নানা অংশ বানিয়ে সুতো দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। এর ভেতরে বাঁশের কঞ্চি আটকানো থাকে। বাঁশের কঞ্চি এমনভাবে আটকানো হয় যাতে ঘোরানোর সাথে সাথে হাত–পা নড়তে থাকে। কোনো পুতুলের নাম মেম পুতুল, কারো আবার সাহেব পুতুল, কোনটা রাজা কিংবা কোনোটা সঙ। এগুলোর পাশাপাশি জন্তু–জানোয়ারের পুতুলও বানানো হয়।
তালপাতার শীর্ষদেশে বাবুই পাখি শক্ত বুননে নিপুণ শিল্পকর্মে তৈরি করে ঝুলন্ত বাসা। বাবুই পাখি তালপাতা কিংবা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি নিজেদের বাসাতেই থাকতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে । কিন্তু কালের আবর্তে এমন কারুকার্যে নির্মিত শিল্পকর্মও খুব বেশি চোখে পড়ে না।
তালপাতার পাখায় ঘোরে অনেকের সংসারের চাকা। রাজধানীর ভাটার থানার ছোলমাইদ গ্রাম ‘তালপাখার গ্রাম’ নামে পরিচিত। এখানকার অধিবাসীরা তালপাতা দিয়ে পাখা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তালপাতার পাখার অনেক খ্যাতি রয়েছে। আগে বাড়িতে কোনো অতিথি আসলে তাদেরকে বসতে দেওয়ার পাশাপাশি তালপাতার হাত পাখা এগিয়ে দিতো। এতে করে পাখার শীতল বাতাসে ক্লান্তি দূর হতো।
তালপাতা তুলনামূলক মোটা, আকৃতি বড় এবং শক্ত হয়। এটি সহজে নষ্ট হয় না। তাই প্রাচীনকালে হস্তেলেখা পুঁথিগুলোর সিংহভাগই ছিলো তালপাতার। এখনো আমাদের দেশে তালপাতায় লিখে যাচ্ছে। গোপালগঞ্জের ডুমুরিয়া গ্রামের জামাইবাজার নামক স্থানের কিছু শিশু তাদের প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম অর্থাৎ বর্ণমালা শেখার কাজে এখনো তালপাতা ব্যবহার করছে।
কর্ণাটকে আটদিনের উৎসবে একটি শতাব্দী প্রাচীন ধর্মীয় রীতি হল ‘তুতেধারা’ বা ‘অগ্নি খেলি’। এই রীতিতে ভক্তরা দুই দলে ভাগ হয়ে একে অপরের দিকে জ্বলন্ত তালপাতা ছোড়াছুড়ি করে। এখনো তালপাতার সাহায্যে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে এই ধর্মীয় আচার পালিত হয়।
এছাড়া তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, চাটাই, মাদুর, বাঁশি, বাড়ির ছাউনি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
এই তালগাছ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রয়েছে একটি কবিতা ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। তালগাছের বাকলে পুরো কার্বন স্তর থাকে। তালগাছ হলো কম্বোডিয়ার জাতীয় বৃক্ষ। তালগাছ তামিলনাড়ুর আবার রাজ্যবৃক্ষও। তালগাছ রক্ষায় শ্রীলঙ্কায় আইন আছে। আর আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী বেশি বেশি করে তালগাছ রোপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মহাভাবতের যুদ্ধে ভীষ্মের রথের ব্যানারে খচিত ছিল তালগাছের চিহ্ন। এক–একটি তালগাছের জীবনকাল প্রায় একশত থেকে দেড়শ বছর।