অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি। ১৪২৮ বংগাব্দ। ব্রণ ঘরে ঘরে আলোচিত একটি অতি পরিচিত শব্দ। ঠিক রোগের পর্যায়ে না পড়লেও এটি বয়ঃসন্ধিকালে সংগঠিত শরীরের জৈব রাসায়নিক এক ধরনের প্রকাশ বলা যায়। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ব্রণ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য জেনে নিয়ে এ সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা সমূহের অপনোদন করা।
ব্রণ কী?
ব্রণ হচ্ছে মানব ত্বকের কেশ ঘর্মগ্রন্থির প্রদাহজনিত একটি সাধারণ রোগ যা ত্বকের উপরিস্থিত স্তরে কমেডো, প্যাপিউল, পাসটিউল, প্রদাহজনিত নডিউল, পুঁজপূর্ণ সিস্ট এবং চরম অবস্থায় নালীকৃত গভীর পুঁজপূর্ণ থলে ইত্যাদি বিবিধ আকৃতির ক্ষত দ্বারা চিহ্নিত হয়।
মানব ত্বকে কিভাবে ব্রণকে দেখা যায়? রোগতত্ত্বের বিবিধ পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্রণ বিভিন্ন রূপে ও ধরনে দেখা দেয়।
কমেডো : এটি মানবত্বকের প্রদাহবিহীন ব্রণের এক ধরনের ক্ষত যা ত্বকের কেশগুটিকার প্রসারিত ছিদ্রের মধ্যস্থিত কেরাটিন, সিবাম ও মেলানিন এবং প্রধানতঃ প্রোপাইনো ব্যাকটেরিয়াম একনি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সৃষ্ট প্লাগ দ্বারা সংগঠিত হয়।
আবদ্ধ কমেডো বা হোয়াইট হেডস : এটি এমন ধরনের কমেডো যার মুখ প্রসারিত নয় বিধায় অভ্যন্তরস্থ কেরাটিন এবং সিবাম বের হতে পারে না এবং তদজনিত সৃষ্ট কমেডো ফেটে গিয়ে ত্বকের ডার্মিস স্তরে প্রদাহজনিত ক্ষতের সৃষ্টির মাধ্যমে রক্তিম বর্ণের প্যাপিউল হিসাবে ত্বকে দেখা যায় এবং একে আবদ্ধ কমেডো বা হোয়াইট হেডস বলে।
খোলা কমেডো বা ব্ল্যাক হেডস : এমন ধরনের কমেডো যাহার নালী বিশেষভাবে প্রসারিত এবং যাতে জমাটবদ্ধ দানাদার বস্তুসমূহ মানবত্বকের উপরিস্থিত স্তরে বাতাসের সংস্পর্শে অঙিডাইজড হয়ে কালো বর্ণের দেখা যায় বিধায় তাকে খোলা কমেডো বা ব্ল্যাকহেডস বলে।
প্যাপিউল : একটি শক্ত উথ্বিত মানব ত্বকের ক্ষত যার ব্যাস এক সেন্টিমিটারের চেয়ে কম থাকে।
পাসটিউল : মানব ত্বকের উপরিস্থিত উথ্বিত পুঁজপূর্ণ ক্ষত।
ভেসিকেল : অর্ধসেনটিমিটারের চেয়ে কম বেষ্টিত মানব ত্বকের উথ্বিত ক্ষত যাহা তরল সেবাম দ্বারা পূর্ণ থাকে।
নডিউল : একটি স্পর্শগ্রাহ্য উথ্বিত মানব ত্বকের ক্ষত যার ব্যাস অর্ধসেনটিমিটার থেকে এক সেন্টিমিটার থাকে।
সিস্ট : বিশেষতঃ তরল অথবা অর্ধকঠিন বস্তু দ্বারা পূর্ণ যে কোনো আবদ্ধ গর্ত বা থলে যা মানব ত্বকের সর্বোচ্চ স্তর দ্বারা আবৃত থাকে।
সেক : থলে আকৃতির দেহাস্থিত বস্তু।
দেহ ত্বক এর স্তরসমূহ সম্পর্কে তথ্যাদি : দেহত্বক হচ্ছে মানবদেহের সবচেয়ে বাহিরের আচ্ছাদন যা এপিডার্মিস ও ডার্মিস নামক প্রধান দুটি কোষীয় স্তর দ্বারা গঠিত এবং যা দেহের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশের মধ্যস্থলে অবস্থান করে দেহকে বহিঃপরিবেশের নানাবিধ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। দেহত্বক তিনটি স্তরে বিভক্তঃ (১) এপিডার্মিস বা বহিঃত্বক বা বাহিরের স্তর (২) ডার্মিস বা অন্তঃত্বক বা ভেতরের স্তর(৩) সাবকিউটিনিয়াস কলা বা নীচের স্তর। এপিডার্মিস পাঁচটি উপস্তরে বিভক্ত এবং ডার্মিস দুটি উপস্তরে বিভক্ত। সাবকিউটিনিয়াস কলা ডার্মিসের নীচে অবস্থিত। ত্বকের এই স্তর নিম্নবর্তী পেশী, কলা এবং অন্যান্য অঙ্গকে রক্ষা করে। ডার্মিস এর ভিতর জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রক্তনালী, শিরা, স্নায়ু, অজস্র কোষ, ঘামের ও তেলের গ্রন্থি। ঘর্ম রক্তের ভিতর থেকে শুষ নেয় পানি, লবণ এবং কিছু রেচন পদার্থ। তারপর ঘাম আকারে ঘর্মনালীর মধ্যে বেরিয়ে আসে দেহের বাইরে। এই ঘর্ম গ্রন্থি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিরাট ভূমিকা রাখে। তৈলগ্রন্থি থেকে বেরোয় তেলজাতীয় পদার্থ বা সেবাম। এই সেবাম ত্বক ও লোমকে মসৃণ রাখে।
ব্রণ সৃষ্টির জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া : ত্বকের হেয়ার ফলিকেল বা চুল গুটিকার গোড়ায় জমাকৃত মৃত কোষ ও ধূলা ময়লায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এর ফলে ত্বকে অবস্থিত সিবাসিয়াস তৈলগ্রন্থির দেয়াল ফুলে গিয়ে ছিদ্র সরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে গ্রন্থি মুখ বন্ধ হয়ে গ্রন্থি নালী ফুলতে থাকে। এ পর্যায়ে তৈলগ্রন্থি থেকে অধিক মাত্রায় তৈল নিঃসরণ হলে গ্রন্থি আরো বেশি ফুলে উঠে রক্তিম বর্ণের ফুসকুঁড়ির মতো দেখায়। তেলের চাপে গ্রন্থি ফেটে গিয়ে তেল আশেপাশের কোষকলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণের ফলে তেল থেকে ফ্যাািট এসিড উৎপন্ন হয় যার দ্বারা ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।এর ভেতরে অবস্থিত পুঁজ সাদা বর্ণের ভাতের দানার মতো দেখায় বিধায় হোয়াইট হেডস বা আবদ্ধ কমেডো সৃষ্টি হয়। এ পর্যায়ে ব্রণের উপর যদি কোনো পর্দা না থাকে তবে ভেতরে জমাটবদ্ধ সাদা বস্তুসমূহ বাতাসের সংস্পর্শে অক্সিডাইজড হয়ে কাল বর্ণ ধারণ করে ব্ল্যাক হেডস বা খোলা কমেডো র্সৃষ্টি করে।
ব্রণের চিহ্ন ও বর্ণনা : এটি লোমের গোড়ায় হয়ে থাকে। ব্রণের মূলে যে জিনিষটি তার নাম কমেডো। এটি চাপ দিলে ভাতের দানার মতো বের হয়। কখনও কখনও শুধু দানা আকারে, পুঁজ সহকারে গহ্বর যুক্ত দানা, ছোট ছোট গোল ফুঁসকুড়ি, ত্বকে ছিদ্র, বড় গোটার আকারে দেখা দিতে পারে। আবার এক প্রকারের ব্রণ দেখা যায় যাতে চাপ দিলে শক্ত সাদা সুুতোর মতো বের হয় যাকে শাল বলা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ব্রণের জন্য মুখের ত্বক এবড়ো থেবড়ো দেখায়।
ব্রণ শরীরের কোথায় হয়?
মুখ, পিঠ, ঘাড়, বুক, থুতনি, কপাল, শরীর ও হাতের উপরের অংশ।
ব্রণের উপসর্গ : ব্যথা, তীব্র যন্ত্রণা, মুখে গরম অনুভূতি ইত্যাদি।
ব্রণ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্তঃধারণাসমূহ : ক] নিয়মিত মুখ ঠিকভাবে পরিস্কার না করলে ব্রণ হয়ঃ মুখের ত্বক ভালো রাখতে অবশ্যই নিয়মিত মুখ পরিস্কার করতে হবে। তবে ত্বক পরিস্কার রাখা মানে এই নয় যে, ব্রণ হবে না। বংশগতি, হরমোন ইত্যাদি নানা কারণন ব্রণ হতে পারে।
খ] ব্রণ ছোঁয়াচে, এটি জীবাণু দ্বারা ছড়ায় : ব্রণের জন্য প্রধানতঃ দায়ী এনড্রোজেন হরমোনের জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া এবং সিবাসিয়াস গ্ল্যান্ড এর বক্র গঠন ও শারীরগত কার্যকারীতার ব্যর্থতা। এখানে জীবাণুর সংক্রমণের ভূমিকা সেকেন্ডারী। তাই ব্রণ ছোঁয়াচে নয়।
গ] কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা লিভারের গণ্ডগোল এর কারণে ব্রণ হয়ঃ এমন ধারণার কোন ভিত্তি নেই।
ঘ] ব্রণের শাঁস বের করে দেওয়া ভালো : আসলে কথাটা ঠিক নয়। ব্রণ টিপলে বা খুঁটলে ইনফেকশন হয়ে মুখে বিশ্রি দাগ হয়। ব্রণের শাঁস বের করার জন্য বিভিন্ন ওষুধ রয়েছে। এটি কমাতে রয়েছে ’কমোডন এক্সট্রাক্টর’ পদ্মতি। এগুলো চর্ম বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে করতে হয়।
ঙ] চকোলেট, আইসক্রিম, মিষ্টি- এগুলো খেলে ব্রণ বাড়ে : এমন ধারণা সত্যি নয়।
চ] যাদের যৌন তাড়না বেশি তাদের ব্রণ হয় : এটি ভ্রান্ত ধারণা।
ছ] ব্রণের দাগ সারাতে ডাবের পানি বা দুধের সরের ভূমিকা আছে : এটি সত্যি নয়।
উপসংহার : ব্রণ হলে দেরি না করে চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ থেকে আপনার করণীয় সম্পর্কে জেনে নিন এবং দুঃশ্চিন্তামুক্ত সুস্থ জীবন যাপন করুন।
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্ম যৌন রোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক