বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ৭ জুন, ২০২১ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

করোনা মোকাবেলায় সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন
আজ আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। গণমাধ্যমে করোনা পরিস্থিতির খবর দেখে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে। গত ঈদের সময় ঢাকা ও বড়ো শহর থেকে মানুষ লকডাউনের মধ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ছোট ছোট যানবাহন ব্যবহার করে, ভেঙে ভেঙে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। টিভি চ্যানেলে আমরা সচিত্র প্রতিবেদন দেখেছি, ফেরীঘাট মানুষে মানুষে সরলাব হয়ে গেছে। এমনকি ফেরীঘাটে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে। গরমে, হিট স্ট্রোকে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও দলে দলে মানুষের গ্রামে যাওয়া এবং গ্রাম থেকে শহরে আসা থামেনি। এই মানুষগুলো মাস্ক পরেনি, স্ত্রী ও শিশুপুত্র কন্যাদেরও সাথে করে বাড়ি নিয়েছে। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। গ্রামে ঘোরাফিরা করেছে। লকডাউনের মধ্যে দোকানপাট, শপিংমল খুলে দেওয়ার জন্য দাবী তোলা হয়েছে। খুলে দেওয়ার পর শপিংমলে ক্রেতারা ভিড় করেছে। নিষেধাজ্ঞা না মেনে যানবাহনে মানুষ গাদাগাদি করে চলাফেরা করেছে। তখন ডাক্তার এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছিলেন, মে মাসের শেষ দিকে এবং জুন মাসের প্রথম দিকে এইসব কাজের কুফল হিসেবে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। আমি ও আমার ইতিপূর্বে প্রকাশিত কলামে করোনার নতুন আঘাত আসার আশংকার কথা বলেছিলাম। আমি যখন এই লেখা লিখছি, আজ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের উপরের দিকে যাচ্ছে। এটি ৬ থেকে ৭ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ এর কাছাকাছিতে চলে এসেছে। এই সংখ্যা ৩০ এর নীচে নেমে গিয়েছিল। আজকের খবরে জানা যাচ্ছে যশোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, সিলেটসহ ভারতের সাথে সীমান্ত আছে এমন সকল জেলায় ভারতীয় ভেরিয়েন্ট এর ভাইরাস করোনা শনাক্ত রোগীর দেহে পাওয়া গেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ভয়াবহ ভারতীয় ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি এটা এখন সামাজিক সংক্রমণের পর্যায়ে চলে গেছে। ইতিমধ্যে আরো একটি খবর পাওয়া গেছে, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় ধরনের ভাইরাসের সংমিশ্রণে অনেক ভয়াবহ একটি ভেরিয়েন্ট ভিয়েতনামে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল যে ভিয়েতনাম করোনাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। অনেকেই সুপারিশ করেছিলেন ভিয়েতনামের করোনা নিয়ন্ত্রণ মডেল যেন বাংলাদেশ সরকার অনুসরণ করে। এখন আমরা ভয় পাচ্ছি ভিয়েতনাম থেকে করোনার ঐ ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে চলে আসে কিনা? যদি আসে? অবস্থা কি হবে? ৫ জুনের সংবাদ বুলেটিনে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সংবাদ দিয়েছে যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর সংক্রমণের প্রমাণ পেয়েছে আইইডিসিআর।
চাপাইনবাবগঞ্জ, যশোরসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। হাসপাতাল ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। ফুসফুস ও অঙিজেনের জটিলতা বেড়ে যাচ্ছে। সীমান্ত অঞ্চলগুলিতে বেশি পরিমাণ হাই ফ্লো অঙিজেন ও আইসিইউর যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। আমি একটি সংবাদ মাধ্যমে এরকম খবরও শুনেছি যে কোথাও কোথাও ৭০ শতাংশ সংক্রমণ হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। টেকনাফ, উখিয়া অঞ্চলেও সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। করোনার পুনরুত্থান দেখে আজ সকাল থেকে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে।
মন খারাপের মধ্যে আমার মাথায় দুটি চিন্তা এসেছে। কলেজে শিক্ষকতা করার সময় আমার দুইজন সিনিয়র সহকর্মীর সাথে আমি একটি কমিটিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ঐ দুইজনের একজনের নাম প্রফেসর এমদাদুল হক, উনার বাড়ি সিলেটে, অন্যজন আমাদের বড় ভাই পংকজ কান্তি পালিত। ঐ কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন আমাদের শিক্ষক প্রফেসর শাফায়েত আহমাদ সিদ্দিকী। কমিটির কাজ করার সময় এমদাদুল হক সাহেব কিছুক্ষণ পরপর আমাকে বলতেন, ‘ঐ সাকরেদ, এই যে কাজ করছো, এইটা থ্যাংকল্যাস জব্‌’। আমাদের সরকার এখন দেশকে এবং জনগণকে করোনা থেকে রক্ষা করার জন্য, অর্থনীতিকে সঠিক পথে গতিশীল রাখার জন্য যে পরিশ্রম করছে, আমার মনে হয় এটা একটা ‘থ্যাংকল্যাস জব্‌’। যখন সরকার দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে, লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে, শপিংমল বন্ধ করে এটা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে করে, তখন সরকারের সমালোচনা করা হয়। যখন লকডাউনের আদেশ দেওয়া হয় তখন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঘোরাফিরা করা মানুষকে পুলিশ মাস্ক পরার কথা বললে তারা মাস্ক পরতে অনীহা প্রকাশ করে। গ্রামের লোকেরা বলে বেড়ায়, করোনা গরীবের রোগ নয়, ধনীদের রোগ। করোনা গ্রামের রোগ নয়, শহরের রোগ। আমাদের দেশের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ওয়ার্ড বয়, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, টেকনিশিয়ানরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আমাদের উচিত এদের প্রশংসা করা। জনপ্রতিনিধি, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সাংবাদিক, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে করোনার মোকাবিলা করছে। এদের প্রশংসা না করে কোন উপায় আছে? করোনার টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী টিকা রাজনীতি চলছে। তারমধ্যে বাংলাদেশ সরকার টিকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের নতুন অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এই বাজেটে করোনা মোকাবিলার প্রস্তাব লক্ষ্যণীয়। অর্থনীতি সুরক্ষার প্রচেষ্টা, কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টা, সামাজিক সুরক্ষার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। আমরা বিরোধী দলকেও করোনার ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করতে দেখছি। এখন সরকারি দল বিরোধী দলকে নিয়ে চিন্তা করার চাইতেও আমাদের বড়ো কাজ হলো কিভাবে করোনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেই চিন্তা করা।
আমি গণমাধ্যমে একটি খবর দেখে একেবারে ভেঙে পড়েছি। এ অবস্থায় আমি রাজনৈতিক বিভাজনের উর্দ্ধে ওঠার জন্য সকল রাজনৈতিক নেতাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে আমরা কেউই কথা বলার সময় পাবো না। এখন করোনা পরবর্তীতেও অনেকের কিডনী বা হার্ট আক্রান্ত হচ্ছে, করোনা পরবর্তী জটিলতায় অনেকে মারা যাচ্ছে। ভারতে নাকি ১০ হাজারেরও বেশি শিশু, যাদের বয়স ১ থেকে ১৪ বছর, তারা পিতামাতা হারিয়ে অনাথ হয়ে গেছে, এখন তাদের দেখাশোনা করার কেউ নাই। দুই একটি কেস স্টাডি উল্লেখ করে ভারতের একটি সাময়িকী জানিয়েছে ৫ বছরের এক শিশু এক সপ্তাহ আগে করোনায় বাবাকে হারিয়েছে, তার দুইদিন পরে তার মা মারা গেছে। বাচ্চাটিকে বলা হচ্ছে, তোমার মা বাবা কাজে গেছে। কাজ শেষে ফিরে আসবে। কিন্তু এইসব বোঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা ৫ বছরের শিশুর নেই। এই দুনিয়াতে এসব শিশুকে কে মানুষ করবে? কঙবাজারের সৈকতে ১০০টি পর্যটনের ঘোড়া ছিল। ঘোড়ার মালিকদের আয় বন্ধ। এখন ঘোড়াগুলি না খেয়ে মরে যাচ্ছে। এইসব সংবাদ যে কোন মানুষের মন খারাপ করে দিতে পারে। সরকার লকডাউন দেয়, বিধিনিষেধ আরোপ করে, ব্যবসায়ীরা তা মানতে চায় না। তারা বলে, ব্যবসা না করলে খাবো কি? গ্রামের মানুষ মানতে চায় না, তারা বলে আমরা ঘরের ভিতরে বন্দী থাকতে পারবো না। আশংকা করা হচ্ছে সামনে বিপদ আসছে, এখন সরকার কি করবে? আমি মনে করি, জনগণের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা রোধ করতে হলে সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক নেতা একসুরে জনগণের কাছে স্বাস্থ্যবিধি মানার অনুরোধ জানাতে হবে। এটা রাজনৈতিক বাগবিতণ্ডার সময় নয়।
৩১মে বেলা ১১টার দিকে আমার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী ফোন করেছিলেন। আমি মাথায় আঘাতজনিত কারণে ভারতে গিয়ে দুইবার চিকিৎসা নিয়েছিলাম। আমার চোখেও একটি অপারেশন হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে করোনায় ভারত বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে আমি চিকিৎসার জন্য সেখানে যেতে পারছি না। করোনা ভীতি মনের মধ্যে নিয়ে ঘরে বসে আছি। চিকিৎসা হচ্ছে না। মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আমার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিলেন। এবং তিনি কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালনায় বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে উনাকে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানান। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটি বিশাল আয়তনের সংস্থা। চট্টগ্রাম-বন্দর নগরী এবং একাধিক ইপিজেডসহ কলকারখানায় ঠাসা একটি নগরী হওয়ার কারণে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন-ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চাইতে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিশাল একটি শিক্ষা বিভাগ রয়েছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সংকট নিরসনে জনগণের প্রত্যাশা রয়েছে। ময়লা নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করপোরেশনের অনেক দায়িত্ব। রাস্তাঘাট মসৃণ রাখা, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা এটা সিটি করপোরশেনের দায়িত্ব। করপোরেশনের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াও তার দায়িত্ব। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে মানুষকে সচেতন করা ও সেবা দেওয়া করপোরেশনের দায়িত্ব। আমি আশা করি এম রেজাউল করিম চৌধুরী সাফল্যের সাথে এই কাজগুলো করতে পারবেন। মেয়র থাকাকালে আ.জ.ম নাছির উদ্দিন দুইবার ফোন করে আমার অসুস্থতার খবরাখবর নিয়েছেন। আমি মাথায় আঘাত পাওয়ার পর দ্রুত বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে ডা. আফছারুল আমীন এম.পি এবং সাবেক চসিক প্রশাসক জননেতা খোরশেদ আলম সুজন আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাদের মধ্যে অনেকেই খোঁজখবর নিয়েছেন। অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন করেছেন। সাবেক এমপি সাবিহা মুসা, সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ও প্রফেসর ড. সেকান্দর চৌধুরীও একাধিকবার ফোন করেছেন। অধ্যাপক মাসুম চৌধুরী ঘন ঘন খবরাখবর নেয়। আমি উনাদের সকলের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। মানুষ যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকে তখন সবাই তার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। আবার যখন কোন ক্ষমতাধর মানুষ ক্ষমতা হারায় তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেকের খোঁজখবর নেন। অসুস্থ, লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া আমার মতো একজন মানুষকে অনেকেই যে মনে রেখেছে এটা একটি প্রশংসনীয় বিষয়।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমধ্যবিত্তবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল
পরবর্তী নিবন্ধসাবিলা-পলাশের ‘অদ-ভূত’