সারাজীবন বাবা সংগ্রাম করেছেন, সুখ দেখে যেতে পারলেন না

জসীম উদ্দিন টিপু | বৃহস্পতিবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

আমার বাবা মরহুম মোহাম্মদ আবুল কাশেম। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার আহলা সাধার পাড়া গ্রামে ১৯৩০ সালে তাঁর জন্ম। বাবা আমৃত্যু শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ২৬ বছর যাবৎ বোয়ালখালী উপজেলাধীন পি সি সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথমে সহকারী শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সবশেষে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৭৩ সাল হতে ১৯৭৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। সবশেষে ১৯৭৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি হতে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একই প্রতিষ্ঠানে রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাবা পটিয়ার সূচক্রদন্ডী নিবাসী জমিদার আসাদ আলী মাস্টারের ছেলে মরহুম আহমদ কবির মোক্তারের জ্যেষ্ঠ জামাতা। শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে বেশি দিন এই ধরণীতে ছিলেন না বাবা। পাঁচ ভাই চার বোন আর মাকে রেখে তিনি ১৯৯৫ সালের ২৪ জুলাই দিবাগত রাতে জিইসি মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। আমি বাবার বড় সন্তান এ জে চৌধুরী কলেজে শিক্ষকতা করতাম, তাই বাসায় থাকতাম। আমার ভাই এ কে এম শামসুদ্দিন লাভলু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স পরীক্ষার্থী, এ কে এম মহিউদ্দিন মানিক দিনাজপুর মেডিকেলে কলেজে পড়তো, এ কে এম মঈনুদ্দিন খোকন ও এ কে এম আহসান উদ্দিন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তো। আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন স্বাভাবিক ভাবে সচ্ছল ছিলো না। কি এক অজানা চিন্তায় বাবা রাত্রে ঘুমাতেন না। আমাকেও একই অবস্থা দেখে বকা দিতেন, এতরাত কেন জেগে রইলাম বলে। কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি বাবার প্রেসার তখন থেকে বেশি ছিলো। এই অবস্থায়ও বাবার প্রাইভেট এর ইনকামই হলো পরিবারের অন্যতম আয়ের উৎস। বাবা সারাজীবন ডায়েরীতে পরিবারের দৈনন্দিন আয়-ব্যয় লিখে রাখতেন। জীবনের শেষ মাস অর্থাৎ জুলাই ১৯৯৫ সালের ১৮ তারিখ পর্যন্ত জীবন চলার হিসাব ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ পাওয়া যায়। ২২ জুলাই ৩.৩০টার সময় খবর আসলো বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। ডাক্তার সাহেব এর পরামর্শ মতে সাথে সাথে পটিয়া মেডিকেলে নিয়ে গেলাম, ওখান থেকে সন্ধ্যা সাতটায় জিইসি মোড় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে আসলাম। মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে নামার সময় বাবা বমি করলেন। তারপর ভর্তি হওয়ার পর ডিউটি ডাক্তার চিকিৎসা করে ওরাডেঙন ইনজেকশন দিলেন। বাবা কিন্তু সারাক্ষণ কথা বলেই যাচ্ছেন যেন ইংরেজি ক্লাশ করাচ্ছেন। রাত নয়টায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেডিসিন এর ফারুক সাহেব আসলেন, দেখলেন এবং বললেন রোগীর এটেন্ডেন্ট কে? আমি গেলাম, উনি বললেন, বাবা একটা ভুল হয়ে গেল, এখন আর কিছুই করার নেই। ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে থাকবে, হায়াত মাউত আল্লাহর হাতে, সবাই বাবার জন্য দোয়া করেন। ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। খবর পেয়ে সবাই আসলো, কিন্তু মানিক দিনাজপুর মেডিকেল থেকে তখনো এসে পৌঁছায় নি। ২৩ তারিখ বিকালে মানিক আসলো। আমার মনে হয়, আমার বাবা যেন শুধু মানিকের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বাবার বড় সখ ছিলো মানিককে ডাক্তারি পড়াবেন। তাঁর জীবদ্দশায় সেই আশা পূরণ হয়েছিল। মানিক দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলো। দিনাজপুর থেকে মানিক আসলো। মাকে রাত ১১.৩০ টার দিকে আমার খালাম্মার বাসায় ভাত খাওয়ার জন্য পাঠালাম। আমি দেখলাম বাবা হাসপাতালে বেডের নীচের দিকে চলে আসছে। এটা দেখে ডাক্তারকে ডেকে আনলাম, ডাক্তার দেখে বললেন,তিনি আর নেই। সারাজীবন বাবা সংগ্রাম করেছেন, কষ্ট করেছেন। কিন্তু বাবা সুখটা দেখে যেতে পারলেন না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাকালীন মনের অভিব্যক্তি
পরবর্তী নিবন্ধভয়াবহ ২৯ এপ্রিল : দুঃসহ স্মৃতি