উন্নয়নের মোহনায় বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর

একনেকে উঠবে ৪ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার প্রকল্প

মীরসরাই প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

একসময় এলাকাটি ছিল প্রায় জনশূন্য। ছিল গো-চারণ ভূমি। সেখানে এখন হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। মীরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ৩১ হাজার একর বিস্তীর্ণ জমিতে গড়ে উঠছে এই শিল্পাঞ্চল। এলাকাটি এখন কর্মমুখর। মানুষের কোলাহল, নির্মাণ সামগ্রী, যন্ত্রপাতি বোঝাই ট্রাক, লরি ও ভ্যানগাড়ির আসা-যাওয়ার ব্যস্ততা। পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট।
এ শিল্পনগরের জোন-২ এ (৯৩৯ একর) ও জোন-২বিসহ (৪৭৪ একর) পারিপার্শ্বিক জোনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ৪ হাজার ৩৪৭ কোটি ২১ লাখ ২ হাজার টাকা খরচে একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। তার মধ্যে সরকার দেবে ৩৭৯ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার আর বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে দেবে ৩ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। আজ মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছিল। গতরাতে বেজা চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, সরকারের অন্য কোন সংশ্লিষ্ট বিশেষ কারণে আজকের একনেক এবারের সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পাবার কথা ছিল। তবে বিশেষ কারণে এ সভা স্থগিত হওয়ায় পুনঃ নির্ধারিত সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন পেতে পারে।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন’ শিরোনামের এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বেজা বলছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পায়ন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বেজা দেশব্যাপী প্রায় ১০ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগসহ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশে একশটি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর সর্ববৃহৎ এবং বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির মহাজংশন। করোনা বাধা ডিঙিয়ে এ মুহূর্তে অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা ও উন্নয়নের মোহনায় দাঁড়িয়ে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে অবকাঠামোর উন্নয়ন। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ ও শিল্প-কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলছে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী আজাদীকে বলেন, করোনার সময়েও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি। অনুমোদনও সম্পন্ন হয়েছে। দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ভূ-কৌশলগত সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানের ফলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। এখানে জমির দাম, বিনিয়োগকারীদের চাহিদা ও চাপ প্রতিযোগিতামূলক বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি নামীদামি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে এগিয়ে এসেছে। আশা করি ২০২১ সালে ২০ থেকে ২৫টি নতুন কোম্পানি কাজ শুরু করবে। পবন চৌধুরী জানান, সড়ক ও সংযোগ সড়কসহ শিল্প-কারখানা স্থাপনের উপযোগী অবকাঠামো সুবিধসমূহ তৈরির প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ায় বাঁধ ও পর্যাপ্ত স্লুইচগেট নির্মাণকাজে অগ্রগতি হয়েছে। এর ফলে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করবে না।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত সোয়া ১শ প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য সরকারি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অন্তত ২৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আরও ৩৭টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন। চলতি বছরে উৎপাদন ও রফতানিতে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ দেশি-বিদেশি অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর।
সরাসরি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বেসরকারি উদ্যোগ এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে। এখানে ৩১ হাজার একর জমিতে পর্যায়ক্রমে ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ধাপে ধাপে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের টার্গেট রাখা হয়েছে। শিল্পনগরকে ঘিরে সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, ফেনীসহ আশেপাশের বিশাল এলাকা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। স্থানীয় লোকজন ঠিকাদার, উপ-ঠিকাদারদের মাধ্যমে নানামুখী কাজে ব্যস্ত। বেকার তরুণ-যুবকরাও কাজ পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে উদ্যোক্তারা একক অথবা যৌথ উদ্যোগে গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার, ইস্পাত ও লোহাজাত শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, রাসায়নিক দ্রব্য, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিঙ সরঞ্জাম, ওষুধ, টেঙটাইল, কন্টেইনার ম্যানুফ্যাকচারিং, ভোজ্যতেল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, মোটরযান বা অটোমোবাইল, আইটি, বিভিন্ন সেবাখাতে বিনিয়োগ ও শিল্প, কল-কারখানা স্থাপন করছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেন, বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে শিল্প-কারখানা ছাড়াও মীরসরাই-সীতাকুণ্ড ঘেঁষে প্রকৃতির অপার দান বঙ্গোপসাগর উপকূলভাগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করা হবে কন্টেইনার বন্দর। শিল্পে উৎপাদিত পণ্য রফতানি ও কাঁচামাল আমদানি হবে সহজ। গড়ে উঠবে উপশহর, বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র। শিল্পনগর থেকে বন্দরনগরীতে বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে কঙবাজার পর্যন্ত সুপার ডাইক কাম মেরিন ড্রাইভওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তাছাড়া শিল্পনগরের কাছেই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং রেলপথ। ভবিষ্যতে পাশেই নির্মিত হবে হাইস্পিড রেললাইন। মিশছে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম বাইপাস মহাসড়কে। সব মিলিয়ে এ শিল্পনগর দেশের আধুনিক অর্থনৈতিক হাব বা প্রাণকেন্দ্রে রূপ নিচ্ছে।
তিনি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই থেকে ১০ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর বন্দরের সুবিধা পেতে সহজ হবে। শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের অবকাঠামো সুবিধা হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গ্যাস ও পানির সংযোগ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি শোধনাগার, আবাসন, হাসপাতাল, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার সামুদ্রিক বেড়িবাঁধের কাজ শেষের পথে। ২৩০ কেভিএ গ্রিড স্টেশন, শেখ হাসিনা সরণি নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৮টি কালভার্ট, দুই লেনের ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে ১৭ কিলোমিটার গ্যাস পাইপ লাইন নির্মিত হয়েছে।
মোশাররফ বলেন, আমার স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে দেখে আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। এই এলাকার কোনো কর্মক্ষম মানুষ আর বেকার থাকবে না-এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতে টিকা পাওয়া ৪৪৭ জনের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬