শরীরের আকর্ষণীয় প্যাটার্নের কারণে সারাবিশ্বে ‘অ্যাকুরিয়াম ফিশ’ হিসাবে জনপ্রিয় মাছ তেরাপন জার্বুয়া। টানা নয় মাসের বেশি সময় ধরে এই মাছ প্রজনন করছে কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলীয় নদী মোহনায়। গবেষকরা চলতি বছরের ৭ এপ্রিল থেকে গতকাল ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সমুদ্র মোহনার অগভীর খাল-বিলে এ মাছের পোনা প্রজনন রেকর্ড করেন। এটাই বিশ্বের সর্বোচ্চ রেকর্ড বলে মনে করছেন তারা। পাশাপাশি হ্যাচারিতে পোনা ফুটিয়ে ‘অর্নামেন্টাল ফিশ’ হিসাবে সারাবিশ্বে মাছটি রফতানি করে দেশের ব্লু-ইকনোমিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচন করা সম্ভব বলে মনে করেন গবেষকরা।
মাছটির প্রাণিতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক নাম তেরাপন জার্বুয়া হলেও বিশ্বব্যাপী এটি ‘টাইগার পার্স’ বা ‘ক্রিসেন্ট গ্রান্টার’ হিসাবে পরিচিত। আর আমাদের দেশে মাছটি ‘বরগুনি’ হিসাবে পরিচিত হলেও স্থানীয়রা ‘ঘ ঘ মাছ’ নামেই চেনে। ভারতের পন্ডিচেরিতে মাছটির প্রজননকাল রেকর্ড করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত, ভিয়েতনামে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত, পাকিস্তানে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ও তাইওয়ানে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশে এ মাছটি নিয়ে আগে কোনো গবেষণা হয়নি বলে জানান বাংলাদেশ ফিশারিশ রিচার্স ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক।
তিনি বলেন, কঙবাজারের সমুদ্র মোহনার ৪টি নদী ও খাল থেকে আমরা চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে প্রতি পক্ষকাল অন্তর বিভিন্ন মাছের পোনা সংগ্রহ করেছি। এরমধ্যে গত ৭ এপ্রিল প্রথম তেরাপন জার্বুয়ার পোনা রেকর্ড করি। সর্বশেষ আজ (গতকাল সোমবার) বিপুল পরিমাণ পোনা রেকর্ড করা হয়েছে। আশা করা যায়, আরো কিছুদিন এ মাছের পোনা পাওয়া যাবে। মানে এ মাছ টানা প্রায় দশ মাস ধরেই প্রজনন করছে বাংলাদেশে। এটা বিশ্বরেকর্ড- দাবি করেন বিজ্ঞানী আশরাফ।
তিনি বলেন, বিএফআরআই ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী সমুদ্র উপকূলীয় মাছের প্রজননকাল ও ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য গবেষণা করে যাচ্ছেন। গবেষণার অংশ হিসাবে তারা কঙবাজার সদর ও শহরের ৪টি স্পট থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া স্থানীয় আরেকদল গবেষক শহরতলীর দরিয়ানগর বড়ছড়া খালের মোহনায় চলতি বছরের ৪ এপ্রিল প্রথম এ মাছের পোনা রেকর্ড করেন এবং সর্বশেষ গতকাল সোমবারও বিপুল সংখ্যক পোনার উপস্থিতি তারা দেখতে পান। ফলে এতে তারা নিশ্চিত হন যে, তেরাপন জার্বুয়ার সর্বোচ্চ প্রজননকালের রেকর্ড বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ ফিশারিশ রিচার্স ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ তেরাপন জার্বুয়ার প্রজননকালের এ রেকর্ড বাংলাদেশের মানুষের জন্য গর্বের বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্লু-ইকনোমি জোরদারে গবেষণার মাধ্যমে আমাদের নতুন নতুন সম্ভাবনামর ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে হবে। এভাবে আমরা দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত করতে পারি। তেরাপন জার্বুয়া (ঞবৎধঢ়ড়হ লধৎনঁধ) টেরাপন্ডাই (ঞবৎধঢ়ড়হঃরফধব) পরিবারের ‘পার্সিফর্মেস’ (চবৎপরভড়ৎসবং) বর্গের একটি প্রজাতি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মাছটি ‘অর্নামেন্টাল ফিশ’ হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ফলে এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা।
গবেষকদের মতে, কঙবাজারসহ দেশের প্রায় ৫৫০ কিলোমিটারব্যাপী সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এ মাছের শত শত প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে। মাছটি উপকূলের মৎস্য খামারে বা ছোট্ট চৌবাচ্চাতেও চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। এ মাছের লেজ ধরলে তার মুখ থেকে ‘ঘ ঘ’ সুরে শব্দ বের হয় বলে স্থানীয় ভাষায় মাছটিকে ‘ঘ ঘ’ মাছ বলা হয়।
টাইগার পার্স মাছটি বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়ায় বরগুনি মাছ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ‘কাঠ-কোই’ নামে পরিচিত। এছাড়া জিরপাই, গরঙ্গেটা, জলকন্যা, গোর, কিলিপোথু বৈকেলি, সমুদ্রাকিলি, গঙ্গা কিলি, পোল বাতেয়া, ইরি বাতেয়া, শ্রীলংকায় পলিন-কেচঞ্চন, অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিসেন্ট গ্রান্টার, ক্রিসেন্ট পার্চ, মিয়ানমারে বাঘাট, জেলামা, কিরং-কিরং, মেংকারং, কেরং-কেরং, সেকিরং, সুকিরোং, কোকোরেহ, জামব্রুং, মালয়েশিয়ায় রুমপাক, জেন্ডাং-জেন্ডাং, ইন্দোনেশিয়ায় জাঙ্গজান, মাঙ্গাহুয়া, বাবাগুনি, কালারো, জাপানে কোতোহিকি, ইয়াগাটা-ইসাকি, কোরিয়ায় সাল-বেন-জা-রি, এনগা-হান্ন- কিয়াং, এনগা-গাই-কিয়ার, এনগা-নান-গায়ং, ফিলিপাইনে দ্রেকে সাক, তসারাবাড়ো, আস্তসারবাড়ো ইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে সি ওং, সি সি কং, চীনে এঙ ল্যান ইন, কেনিয়ায় নাগাগু, কৌরমৌ, কুরমনও, মাদাগাস্কারে সুমাহা, ওমানে বাআম, থিয়েব, ইয়াল্লি, ইয়ানাম, জিমজাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় ডোরিংভিস, খংটাফোলাইখং ইন, কুই, এনগাগু নামে পরিচিত।
তেরাপন জার্বুয়া একটি মাঝারি আকারের মাছ, যার বণ্টন সীমা বিস্তৃত। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও জাপান পর্যন্ত মহাসাগর এবং ভূমধ্য সাগরে এই প্রজাতির মাছের হার বেশ ভালো রকমের রয়েছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
তারা জানান, বরগুনি মাছ সাধারণত সমুদ্র থেকে মোহনার অগভীর পানিতে এসে প্রজনন করে। সামুদ্রিক জোয়ারে প্লাবিত হয়, এমন খালবিলে এদের রেণু থেকে পোনা ফোটে। এরপর পক্ষকাল থেকে ২৮ দিনের মধ্যেই বড় হয়ে এরা সাগরে চলে যায়। আকারে ১০ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে বরগুনি। সাধারণত, পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী প্রজাতির সংখ্যা হয় ৭/৮ গুণ বেশি। বরগুনি মাছের চঞ্চল পোনাগুলো ক্ষিপ্ত গতিতে ওজানের দিকে ধাবিত হতে পারে। এরা খাল ও সাগরের ২০ মিটার (প্রায় ৬৭ ফুট) গভীরতম এলাকাতেও বসবাস করে। একেকটি ডিম থেকে চার লাখের বেশি পোনা বের হয়। এরা সাধারণত খাদ্য হিসাবে মাছ, পোকামাকড়, কৃমি, এলগি, প্রাণকণা (জু প্লাঙ্কটন), উদ্ভিদ কণা (ফাইটো প্লাঙ্কটন) এবং বালির ভেতরে বসবাসকারী অমেরুদণ্ডী প্রাণিগুলো খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে এ মাছ ‘সর্বভুক’ বা অমনিভোরাস হিসাবেও তালিকাভুক্ত, আবার মাংশাসী হিসাবেও তালিকাভুক্ত।
বরগুনী একটি ‘ইউরিহেলাইন’ বা তীব্র লবণসহিষ্ণু প্রজাতির মাছ। এটি ১ পিপিটি (পানিতে লবণাক্ততা মাপার পরিমাপক বা পার্টস পার থাওজেন্ড) থেকে ৭০ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। অথচ কঙবাজার বঙ্গোপসাগরের পানির লবণাক্ততা থাকে সর্বনিম্ন ১৫ পিপিটি থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ পিপিটি পর্যন্ত। এটি সর্বভুক মাছ হওয়ায় পঁচাগলা জৈব বর্জ্য খেয়ে সাবাড় করে। এটি উপকূলের পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ও উপকারি মাছ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে এ মাছ ব্যাপকভাবে চাষ করা সম্ভব। এমনকি ছোট ছোট জলাশয়, ড্রাম বা অ্যাকুরিয়ামে।