৪শ দিনের আন্দোলন ও নাগরিক সমাজ চট্টগ্রাম

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৭ আগস্ট, ২০২২ at ৫:০৮ পূর্বাহ্ণ

‘একটা হৃদয়ে কতটুকু প্রেম জমা হলে বৃক্ষের বেদনায় মানুষ কাঁদে? কতটুকু প্রেমিক হলে বৃক্ষদের ব্যথা অনুভব করা যায়? কতটুকু ভালোবাসলে বৃক্ষের কষ্ট দেখে নিজের চোখে জল আসে? বৃক্ষরাও তার ভাষা বোঝে?’
চট্টগ্রামের মানুষ সে ভাষা বোঝে। আর চট্টগ্রামের মানুষের সেই আবেগময় অনুভূতি বুঝেই ৪০০ দিন আগে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের ব্যানারে একদল মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল সিআরবিকে দখলমুক্ত করার। তাদের আহ্বানে একাট্টা হয়েছিল দল মত নির্বিশেষে চট্টগ্রামের লাখো জনতা।
সিআরবি রক্ষা আন্দোলনের জন্ম হয় রাজপথে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল একটাই, ‘বাঁচাও সবুজ, বাঁচো নিজে’। তারা বলেছে, ‘প্রাকৃতিক অক্সিজেন ধ্বংস করে সিলিন্ডারের অক্সিজেন নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে বাঁচতে চাই না’। সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি নাগরিক সমাজ নেতৃবৃন্দের অনুরোধ ছিল, আমরা সবাই সবচেয়ে ভালোবাসি নিজেকে আর নিজেকে বাঁচাতে হলে চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবিকে রক্ষা করতেই হবে। আমরা চট্টগ্রামের মানুষের পক্ষ হয়ে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম তাই পথকে সাথী করেছি। নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ বেয়ে অবশেষে বিজয় সূর্যটা উঁকি দিতে চলেছে।
পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদন ও সর্বস্তরের মানুষের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সিআরবিতে ইউনাইটেড হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়টি স্থগিতের জন্য রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনকে অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের মন্ত্রী ও এমপিরা।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ সিআরবিতে অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে জনপ্রতিনিধিদের এ উদ্যোগে উল্লসিত হন। তাদের বক্তব্য, ৪০০ দিনের আন্দোলনে এটি আমাদের বিজয়ের দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম ধাপ ছিল সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প কুমিরায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা এবং রেল সচিবের সেই জায়গাটি পরিদর্শন করা। চট্টগ্রামবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে এ উদ্যোগ গ্রহণে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ চট্টগ্রামের সকল মন্ত্রী-এমপির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তারা।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, আমাদের অভিভাবক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সিআরবিতে এসে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এখানে হাসপাতাল করতে হলে আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে করতে হবে। আজ তারা মাননীয় রেলমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন চট্টগ্রামবাসীর এক ও অভিন্ন সেই দাবি। আর সেটি হলো সিআরবিতে চট্টগ্রামবাসী হাসপাতাল চায় না।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের কো-চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, আন্দোলনের প্রথম থেকেই আমাদের বিশ্বাস ছিল শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। কারণ হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবর, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই মাটি শহীদের স্মৃতিধন্য। মুক্তিযুদ্ধে এ পাহাড়ের অবদান আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই সিআরবি তথা পাহাড়তলী ছিল বিপ্লবের সূতিকাগার। দেরিতে হলেও সরকারের এ উপলব্ধিতে আমরা সন্তুষ্ট।
জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা জসিমউদ্দিন বাবুল বলেন, সিআরবি আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলেও এটা কোনোভাবেই প্রাইভেট সেক্টরকে দেয়া যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করছেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর সুশাসনকে কলঙ্কিত করার জন্য প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী আমলা রেলের সরকারি জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল প্রকল্পের দুঃসাহস দেখিয়েছে। নাগরিক সমাজের ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তিনি অনুধাবন করেছেন, চট্টগ্রামের মানুষ সবুজ নিয়ে বাঁচতে চায়।
সাংবাদিক নেতা মহসিন কাজী বলেন, প্রকৃতির অসীম দানে ঋদ্ধ এ রকম বড় উন্মুক্ত স্থান চট্টগ্রামে আর নেই। সিআরবির উন্মুক্ত স্থানেই এখন আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী, নজরুল জন্মবার্ষিকী ও বাঙালির অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একসময় বাঙালির প্রাণের এই অনুষ্ঠানগুলো উদযাপিত হতো ডিসি হিলে, সার্কিট হাউজের সামনের উন্মুক্ত স্থানে, যা এখন জিয়া শিশু পার্ক এবং আউটার স্টেডিয়ামে, যা এখন একটি বিশাল কংক্রিট আচ্ছাদিত সুইমিংপুল ও বিপণী কেন্দ্র।
আবৃত্তি শিল্পী প্রণব চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মানুষ বাদ দিলে বাকি সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন সিআরবি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা। আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন যখন এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছি, সেই আহ্বান ছিল উত্তাল প্রতিবাদে শামিল হওয়ার ডাক। তা ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ এসেছে একা কিংবা দল বেঁধে। আমরা কি হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে? না, তা নই। এখানে ৫০০ শয্যার একটা হাসপাতাল নির্মাণের কথা বলে একসময় পুরো সিআরবি তারা দখল করে নেবে। আজ আমরা প্রথম লক্ষ্যে পৌঁছেছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরীক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যাগ নিয়ে উধাও হেল্পডেস্ক
পরবর্তী নিবন্ধব্যয় বেড়েছে ৪৩৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা