হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে বিভ্রান্তি

হাসান মারুফ রুমী | শুক্রবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ

ফিরে দেখা ২০১৭ সাল। হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে চট্টগ্রামের করদাতাদের অসন্তোষ ২০১৭ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করে। ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ এর নেতৃত্বে নাগরিকদের আন্দোলনের উত্তাপ চট্টগ্রাম নগরের উঠান, পাড়া-মহল্লা, অলি-গলি, হাউজিং সোসাইটি, রাজপথ ছাপিয়ে সংসেেদও উত্থাপিত হয়। সে বছর ২৬ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংসদ সদস্য থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত। তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির বিষয়টি পুনঃবিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম ৯ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেছিলেন ‘আমার নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেও একইভাবে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তাই সিদ্ধান্তটি পুনঃবিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি। ‘হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন তৎকালীন সাংসদ মঈনুদ্দিন খান বাদল।
তখন পূর্ববর্তী মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবিত এসেসমেন্ট বাতিল করার দাবি জানিয়েছিলেন। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। আরেক সাবেক মেয়র মনজুরুল আলম একই অনুরোধ জানিয়ে মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দীনকে চিঠি দিয়েছিলেন। তখনো সে সময়ের মেয়র একই কথা বলেছিলেন – ‘আইন’ মেনেই এসেসমেন্ট করা হয়েছে, বাতিলের সুযোগ নেই। তখন তিনি আপিলের মাধ্যমেই একমাত্র সমাধানের রাস্তা দেখছিলেন।
এরকম এক অচলাবস্থায় ২৬ নভেম্বর ২০১৭, রোববার বিকেলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বসেন। চট্টগ্রাম সহ সারাদেশের সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাগণ বৈঠকে অংশ নেন। সেই বৈঠকে হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে জনগণের অসন্তোষের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে হোল্ডিং ট্যাক্স প্রক্রিয়া অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। অটোমেশনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আলোচিত/বিতর্কিত এসেসমেন্ট স্থগিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা উপস্থিত ছিলেন।
কী পদ্ধতিতে হয়েছিল সে এসেসমেন্ট:
দ্য মিউনিসিপালিটি ট্যাক্সেশান রুল ১৯৮৬ প্রণীত হয় স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে। যে আইনটি তখন থেকে আজ অবধি প্রয়োগ করা যায় নি। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন লিফলেট ছাপিয়ে ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এ আইন অনুযায়ী হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়ার আহ্বান জানায়। যা দৈনিক আজাদীতে ১৯ অক্টোবর ২০১৬ সালে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও জানানো হয়। বিজ্ঞাপনে সে আইনের ২২ ধারা মতে নিজের কর নিজে কিভাবে নির্ধারণ করবে তা হিসাব করে সহজ ও সাবলীল ভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়। কর নির্ধারণের সেই হিসাবটি পাঠকের জন্য তুলে ধরলাম
আপনি নিজেই নিজের পৌরকর নির্ধারণ করতে পারবেনঃ
(ক) ভাড়ার ক্ষেত্রে :
আপনি নিজেই নিজের কর নির্ধারণ করতে পারেন। আপনার ভবনটি যদি সম্পূর্ণ ভাড়াপ্রদত্ত হয় তবে ভবনে বাৎসরিক ভাড়া হতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ দু্থমাসের ভাড়া বাদ দিন। অবশিষ্ট দশ মাসের ভাড়াই আপনার ভবনের বার্ষিক মূল্যায়ন অর্থাৎ ধরুন আপনার বাড়ির মাসিক ভাড়া পাঁচ হাজার। তাহলে বাৎসরিক আয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে বছরে ষাট হাজার টাকা। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ বাদ যাবে দশ হাজার টাকা। অতএব বার্ষিক মূল্যায়ন পঞ্চাশ হাজার টাকা। এ পঞ্চাশ হাজার টাকা বার্ষিক মূল্যায়নের ১৭% পৌরকর। পঞ্চাশ হাজার এর ১৭% আট হাজার পাঁচশত টাকা এক বৎসরের পৌরকর।
যদি উক্ত ভাড়া ঘর নির্মাণ বা ক্রয়ে সরকার, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, তফসিলি ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন তবে ঋণের বাৎসরিক মূল্যায়ন থেকে বাদ দিন। অবশিষ্ট মূল্যই আপনার ভবনের বার্ষিক মূল্যায়ন।
(খ) সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবহৃত ভবনের ক্ষেত্রে :
আপনার ভবনটি যদি সম্পূর্ণ নিজের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করেন তবে একই এলাকায় সমান সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ভবনের ভাড়ার আনুপাতিক হারে আপনার ভবনের বার্ষিক ভাড়া নির্ধারণ করুন। অতঃপর দুমাসের ভাড়া রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বাদ দিন; অবশিষ্ট মূল্য হতে ৪০% পুনরায় বাদ দিন। সর্বশেষ যা অবশিষ্ট থাকবে তাই আপনার ভবনে বার্ষিক মূল্যায়ন। উদাহরণ স্বরূপ: বাড়ির আনুমানিক ভাড়া পাঁচ হাজার। তাহলে বাৎসরিক আয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে বছরে ষাট হাজার টাকা। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ বাদ যাবে দশ হাজার টাকা। অতএব বার্ষিক মূল্যায়ন পঞ্চাশ হাজার টাকা। নিজ বাসস্থান হিসেবে বাদ যাবে আরও ৪০% অর্থাৎ বিশ হাজার বাদ দিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা।
বার্ষিক মূল্যায়নের ১৭% অর্থাৎ ত্রিশ হাজার টাকা বার্ষিক মুল্যায়ন হলে বার্ষিক কর হবে পাঁচ হাজার একশত টাকা।
বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটি নির্মাণে যদি সরকার, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, তফসিলি ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দ্বারা নির্মিত বা ক্রয়কৃত হয় তবে ঋণের বাৎসরিক সুদ সর্বশেষ মূল্যায়ন থেকে বাদ দিন। অবশিষ্ট মূল্যই আপনার ভবনের বার্ষিক মূল্যায়ন।
(গ) আংশিক ভাড়া ও আংশিক নিজস্ব ব্যবহৃত ভবনের ক্ষেত্রে :
আপনার ভবনটি যদি আংশিক ভাড়া এবং আংশিক নিজস্ব ব্যবহৃত হয় তবে ভাড়ার অংশের মূল্য উপরে বর্ণিত ভাড়া পদ্ধতিতে নির্ধারণ করুন এবং নিজস্ব ব্যবহারের অংশ উপরে বর্ণিত নিজস্ব ব্যবহারের নিয়মে ধার্য্য করুন। অতঃপর উভয় অংশ যোগ করুন।
পাঠকগণ এ বিজ্ঞাপন পড়ে নিজেরা হিসাব করে দেখুন এ পদ্ধতিতে হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়া সম্ভব কি না। এ পদ্ধতির মধ্যেই সকল অসন্তোষের বীজ বপন করা আছে। এমনকি দুর্নীতিরও।
চসিক মেয়রের বক্তব্য ও বাস্তবতা:
চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী গত ৩ অক্টোবর দেশে ফিরেন। ৪ অক্টোবর দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে আমরা তাঁর কিছু বক্তব্য জানতে পারি। মেয়র বলেন ‘২০১৭ সালের কর পুনঃমূল্যায়নের উপর মন্ত্রণালয় স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করায় আমরা তা আদায় করছি। এখানে আইনের বাইরে যাচ্ছি না। ২০১৭ সালের ধার্যকৃত করের উপর কারো আপত্তি থাকলে আপিল করতে হবে। আপিল রিভিউ বোর্ডে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন ‘বাস্তবতা হচ্ছে আপিল ছাড়া কর সহনীয় করার অন্য কোনো পথ খোলা নেই। … আমি নিজেও সবসময় বলি ২০১৭ সালের কর মূল্যায়নে অসঙ্গতি আছে। ২০ হাজার টাকার ভ্যালুয়েশনকে দুইলাখ টাকা করা হয়েছে।
বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার চার মাথায় ২০২০ সালের ৩ জুন বিতর্কিত এসেসমেন্টের উপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। ফলে ২০১৭ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে স্থগিত হওয়া বিতর্কিত এসেসমেন্টের উপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। যদিও মেয়র এতদিন যাবত বার-বার বলে এসেছেন- ‘পৌরকর বাড়ানো হবে না। আমি নিজেও ট্যাক্স বাড়ানোর পক্ষপাতি না। তবে করের আওতা বাড়ানো হবে। আগে একতলা ভবন ছিল সেটা এখন যদি পাঁচতলা হয় তার ট্যাক্স তো দিতে হবে’।
অথচ হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদানকারীরা দেখছে ভিন্ন চিত্র। কারণ সংকটের মূলে রয়েছে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের সময়ে তৈরি “The Municipal Corporation Taxation Rule 1986” । সে আইনের আলোকে তৈরি এসেসমেন্টের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের আন্দোলনের চাপে জাতীয় সংসদে হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে আলোচনা উঠেছিলো। বর্ষিয়ান অভিজ্ঞ আইন প্রণেতাগণ আলাপ করেছেন। কিন্তু সংকটের মূলে হাত দেননি কেউই। সংকটের সাময়িক সমাধান হিসেবে স্থগিতাদেশকেই বেছে নিয়েছিলেন আমলারা। সংকট উত্তরণে কোনো সুপারিশ বা আলোচনা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এর সমাধান জনবিচ্ছিন্ন আমলার কূটনীতির মাধ্যমে সম্ভব নয়। সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক ভাবে। অর্থাৎ নতুন আইন নির্মাণের মাধ্যমে, যেখানে জনমত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে।
আমাদের সুপারিশ :
খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয় বর্গফুটের উপর ভিত্তি করে। প্রতি বর্গফুট ৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা ধরে সম্পত্তির ভ্যালুয়েশন নির্ধারণ কার হয়। সেই ভ্যালুয়েশনের ১২ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স নেয়া হয়।
এলাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব, নানান সুবিধা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থাপনার ধরন ইত্যাদি হিসাবে রেখে স্টেক হোল্ডারদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্গফুটের উপর ভিত্তি করে হোল্ডিং ট্যাক্স নিতে হবে।সেক্ষেত্রে The Municipal Corporation Taxation Rule 1986 ১৯৮৬ বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুসাহিত্য আমার অহংকার
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা