জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৯:১৫ পূর্বাহ্ণ

মহাগ্রন্থ আল কুরআনই জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস

আল কুরআন হিদায়তের আলোকবর্তিকা : কুফর শির্ক, অশিক্ষা কুশিক্ষা ও অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে দিশা প্রাপ্তির অনন্য আলোকবর্তিকার নাম মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আলিফ, লাম, রা, এ কিতাব এটা আপনার প্রতি অবর্তীণ করেছি যাতে আপনি মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বের করে আনতে পারেন। (১৪-সূরা ইবরাহীম, ০১)
আল কুরআন সমগ্র বিশ্ব বাসীর জন্য হিদায়তের সঠিক নির্দেশিকা, এতে রয়েছে মানব জাতির জন্য কল্যাণকর বিধান, সুস্পষ্ট নির্দেশনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এটা আপনার জন্য এবং আপনার সম্প্রদায়ের জন্য একটি উপদেশ (এ সম্পর্কে) শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন। (৪৩ সূরা যুখরূপ, ৪৪)
আল কুরআনই জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস : আল কুরআনই পৃথিবীর অদ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ঐশীগ্রন্থ। আল কুরআনের গবেষণায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম মনিষীদের অবদান ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা প্রশাখার নিখুত তত্ত্ব ও উৎস আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীর প্রভূত কল্যাণ সাধন করেছেন গবেষক, তাফসীরকার ও মুসলিম বিজ্ঞানীরা। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জ্ঞান-বিজ্ঞান (পূর্ণতা অর্জন করতে চায়) অর্জনে ইচ্ছুক সে যেন কুরআনকে আঁকড়ে ধরে কেননা এতে পূর্বাপর সর্বপ্রকার জ্ঞান বিজ্ঞানের বর্ণনা রয়েছে। (আল ইতক্বান ফী উলুমিল কুরআন ২য় খন্ড, পৃ: ১২৬)
পৃথিবীর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানময় গ্রন্থ হলো আল কুরআন যার কোনো তথ্যাবলী নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন, এরা কি লক্ষ্য করেনা কুরআনের প্রতি পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যাতীত অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তবে এতে অবশ্যই অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেতো। (সূরা: নিসা: আয়াত: ১১)
জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের গৌরবময় অতীত : ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়। পবিত্র আল কুরআনের প্রায় ৭৫৬টি আয়াতে করীমায় বিজ্ঞান সম্পর্কিত বর্ণনা ও নির্দেশনা রয়েছে। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, মহাবিশ্বের আলোচনা, নভোমন্ডল, ভূমন্ডল, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদ বিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, ভূগোল বিদ্যা, সমুদ্র বিজ্ঞান, জ্যোতিবিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, প্রভূতি বিষয়ে আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি এই কিতাবে কোনোকিছু লিখতে বাদ দেইনি।” (সূরা আনআম, আয়াত: ৩৮)
আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে মানুষকে গবেষণা করার জন্য অনুপ্রানিত করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে,“আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা কি তারা দেখেনি। (সূরা: আরাফ, আয়াত: ১৮৫)
কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞান চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়ে ৭১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর অবদান এক নব জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। বিজ্ঞান চর্চায় ইউরোপীয়ানরা মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে চিরঋণী ছিল। মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র কর্ডোভা নগরী থেকে জ্ঞানের আলোক রশ্মি সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। যে সব মুুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরনীয় তাঁরা হলো:-
আল খাওয়ারিজমী (৭৮০-৮৫০ খ্রি.), আল কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রি.), সাবিত বিন কুররা (৮২০-৯০১ খ্রি.), আত্‌-তাবারী (৮৩৮-৯২৩), আল বাত্তানী (৮৫৮-৯২৯ খ্রি.), আল রাযী (৮৬৫-৯২৫ খ্রি.), আল ফারাবী (৮৭০-৯৫০ খ্রি.), আল মসউদী (৯১২-৯৫৭), আল হায়সাম (৯৬৫-১০৩৯ খ্রি.), আল বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.), ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি.), ওমর খৈয়াম (১০৩৮-১১২৩ খ্রি.), আল গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ খ্রি.), আল ইদরীসি (১০৯৯-১১৬৬ খ্রি.), ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮ খ্রি.), ইবনে বতুতা (১৩০৪-১৩৬৯ খ্রি.), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.) প্রমূখ মুসলমানদের অতীত সোনালী ইতিহাস বর্তমানে স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান মুসলিম শাসকদের বিলাসী জীবন যাপন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা উদাসীনতা পশ্চাদপদতা আজকের মুসলিম দুনিয়ায় করুণ পরিণতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। (সাইন্টিফিক আল কুরআন কৃত মোহাম্মদ নাছের উদ্দিন, পৃ: ৪৩-৪৫)
আল কুরআনই বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ। ব্যক্তি সমাজ দেশ ও রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম দিক নির্দেশিকা। আল কুরআনের বদৌলতে আরবের যাযাবর বেদুঈন বর্বর অসভ্য উশৃঙ্ক্ষল জাতি পৃথিবীর এক সম্ভ্রান্ত সুসভ্য মার্জিত ও সর্বোত্তম জাতিতে রূপান্তর হলো। আল কুরআন শুধুমাত্র মানবতার কল্যাণ সাধন করেছে তা নয় বরং শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা প্রশাখায় এক যুগান্তকারী বৈপ্লবিক পরিবর্তন উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করেছে।
কোরআন নাযিলের সময়কাল :সর্ব প্রথম কোরআন নাযিল হয় ২৭ শে রমজান মোতাবেক ২৮ শে জুলাই ৬১০ খৃষ্টাব্দে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার বয়স তখন ৪০ বৎসর। অত:পর ৬৩২ খৃষ্টাব্দে পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৩ বৎসরে ক্রমান্বয়ে সম্পুর্ণ কুরআন নাযিল হয়।
কোরআন যাবতীয় বিষয়ের দিক নির্দেশিকা : কুরআনে শতকরা ১১ ভাগ আয়াতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে অবশিষ্ট ৮৯ ভাগ আয়াতে আইন কানুন, বিধি-বিধান আচার অনুষ্ঠান, আকাঈদ, বিশ্বাস এবং মানবীয় শিক্ষামূলক বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
কোরআনে হরকত প্রবর্তন : ইসলাম যখন বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিশেষভাবে অনারব পাঠকদের সুবিধার জন্য হিজরী ৮৬ সনে ইরাকের তৎকালীন গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউছুফের নির্দেশে নসর বিন আসিম, ইয়াহিয়াহ, খলীল বিন আহমদ প্রমুখ, কুরআনে কর্তৃকারক কর্মকারক করনকারক ইত্যাদি পৃথকভাবে সংযোজন করেন। সেই সাথে স্বরূপ বিশিষ্ট বর্ণসমূহের মধ্যে যথা বা-তা-ছা, কিংবা জীম হা-খা, পার্থক্য করার জন্য নোকতার’ প্রবর্তন করা হয় ঠিক ঐ সনেই সাধারণ পাঠকদের সুবিধার জন্য সমগ্র কোরআনকে পারা সংখ্যা ৩০ ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক পারাকে নিসফ (অর্ধ) সুলস, (এক তৃতয়িাংশ) রুকু, এমনকি আয়াতের ও ক্রমিক নম্বর দেয়া হয়েছে এটা পাঠকের সুবিধার জন্য। (এজাজে কুরআন, কৃত আল্লামা মুহাম্মদ শরীফ)
নবীদের সংখ্যা :
কোরআনে মোট ২৫ জন নবী রসুলের নাম উল্লেখ আছে: ১. হযরত আদম (আ:), ২. হযরত নূহ (আ:), ৩. হযরত ইদরীস (আ:), ৪. হযরত ইবরাহীম (আ:), ৫. হযরত ইসমাঈল (আ:), ৬. হযরত ইছহাক (আ:), ৭. হযরত ইয়াকুব (আ:), ৮. হযরত ইউছুফ (আ:), ৯. হযরত লুত (আ:), ১০. হযরত হুদ (আ:), ১১. হযরত ছালেহ (আ:), ১২. হযরত শোয়াইব (আ:), ১৩. হযরত মুছা (আ:), ১৪.হযরত হারুন (আ:), ১৫. হযরত দাউদ (আ:), ১৬. হযরত সোলাইমান (আ:), ১৭. হযরত আয়ুব (আ:), ১৮. হযরত যুল কিফল (আ:), ১৯. হযরত ইউনুছ (আ:), ২০. হযরত ইলিয়াছ (আ:), ২১. হযরত আল ইছআ (আ:), ২২. হযরত যাকারিয়া (আ:), ২৩. হযরত ইয়াহিয়া (আ:), ২৪. হযরত ঈসা (আ:), ২৫. হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
কোরআনে উল্লেখিত ফেরেস্তাদের সংখ্যা : ১. জিবরাইল (আ:), ২. মিকাঈল (আ:), ৩. হারুত (আ:), ৪. মারুত (আ:), ৫. রায়াদ, ৬. ছিজ্জিল, ৭. মালিক, ৮. কাউদ, ছাহাবীদের মধ্যে শুধুমাত্র হযরত যায়েদ (রা:) এর নাম উল্লেখ আছে।
আল্লাহ তা’আলা মহাগ্রন্থ আল কুরআন চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য পূনরুদ্ধারের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মসজিদ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে পবিত্র কুরআনের আয়াত বা হাদীস শরীফের বানী লিখা জায়েজ কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ। মসজিদ বা বাড়ীঘর বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে কুরআন শরীফের আয়াত বা হাদীস শরীফের বাণী লিখার ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা উল্লেখ নেই, তবে শরয়ী মূলনীতি হলো “প্রত্যেক বস্তু মূলত বৈধ” যতক্ষণ কোন কাজ কুরআন হাদীস দ্বারা হারাম হওয়াটা প্রমাণিত হবেনা সে কাজ জায়েজ হিসেবে গন্য হবে। হাদীস শরীফে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে কাজ আল্লাহ ও তদীয় রসূল না জায়েজ বলেন নি তা শরীয়ত সম্মত, আবু দাউদ শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। কুরআনে যা হালাল বর্ণিত হয়েছে তা হালাল, যা হারাম করা হয়েছে তা হারাম, যে বিষয়ে নীরব রয়েছে তা মুবাহ। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৩৬২)
বাদশাহ আলমগীর এর ওস্তাদ মোল্লা জিওন (র.) প্রণীত “তাফসীরাতে আহমদীয়া” তে উল্লেখ রয়েছে, প্রত্যেক বস্তু মূলত: মুবাহ বা বৈধ। এ মূলনীতির আলোকে মসজিদের দেওয়ালে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে কুরআন ও হাদীসের আয়াত ও বাণী লিখাটা জায়েজ। (ফতোওয়া আলমগীরি, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৪২৪, ওয়াকারুল ফাতওয়া, খন্ড:২য়, পৃ: ৫২৮)
উল্লেখ্য মসজিদে নববী শরীফের দেওয়ালে হাজার বৎসর ধরে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বাণী লিপিবদ্ধ রয়েছে। অদ্যাবধি পৃথিবীর কোন বিজ্ঞ আলেম এটা না জায়েজ বলেনি, বৈধতার জন্য এটাই প্রকৃষ্ট দলিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে বিভ্রান্তি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগের ৫০ বছর