হিরন্ময় সময়ের ঘটনাপ্রবাহ

আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব

নিজামুল ইসলাম সরফী | শুক্রবার , ১০ মার্চ, ২০২৩ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আনিসুজ্জামান বাঙালির সারস্বত প্রজন্মের চেতনালোকের অনন্য সারথি, মহীরুহ ও বটবৃক্ষ বটে। শৈশবে স্কুলে আমরা যে শিক্ষককে স্যার বলে সম্বোধন করি পৌঢ়ত্ব অথবা বার্ধক্যেও আমরা স্যার শব্দটিই ব্যবহার করি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বিষয় এই যে, যারা তাঁর ছাত্র নয় তারাও তাঁকে স্যার বলে সম্মোধন করেন। আনিসুজ্জামানের এই অবস্থান একান্তই তাঁর জন্য সংরক্ষিত। তিনি যেন এই প্রজন্মের সর্বজনীন স্যার। সকলের শিক্ষক না হয়েও সকলের আনিস স্যার।

আনিসুজ্জামান ছিলেন এদেশের একজন মহাকালিক বুদ্ধিবৃত্তিক পুরুষ। যার অলোকসামান্য অবদান বাঙালির জাতির শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তাকে স্মরণীয় করে রাখবে যুগের পর যুগ। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, সামরিক স্বৈরাচার প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িকতার অমানিশা অন্ধকার থেকে জাতিকে রক্ষা করতে তাঁর সাহসী ও সজাগ ভূমিকা ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে। তাঁর আত্মজীবনী “কাল নিরবধি,” “আমার একাত্তর”, “আমার চোখে”, “বিপুলা পৃথিবী”, প্রভৃতি গ্রন্থ বাঙালির জীবন ও কালের চলমান ইতিহাস হিসাবে আগামী প্রজন্মকে আবিষ্ট করে যাবে নিঃসন্দেহে। বর্তমানে দেশ এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে তাঁর মত একজন বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ বড় প্রয়োজন ছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতে শাকিল আহমদ রচিত আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব বইটি আমাদের কাছে এক আকরগ্রন্থ বৈকি।

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭১৪ মে ২০২০)-এর বর্ণাঢ্য দীর্ঘ জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে এসে তিনি এতদঞ্চলের শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের অভিভাকতুল্য হয়ে ওঠেন। সেই হিরন্ময় সময়ের ঘটনা প্রবাহকে ইতিহাসের আলোকে স্বভঙ্গিমায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিকগবেষক শাকিল আহমদ তাঁর “আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব” গ্রন্থে। কথা সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ যাকে “নতুন প্রজন্মের সাহিত্যতাত্ত্বিক” আখ্যায় ভূষিত করেছিলেন সেই শাকিল আহমদ এবার আমাদের উপহার দিয়েছেন এক অনন্য সাধারণ মৌলিক আকর গ্রন্থ “আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব”। এটি প্রকাশ করে তিনি যেন আনিসুজ্জামানের প্রতি বাঙালির দায় শোধের চেষ্টায় শরীক হয়েছেন। আনিসুজ্জামানের স্নেহধন্য শাকিল আহমদ স্যারকে কাছ থেকে দেখার স্মৃতি ও ইতিহাসের তথ্যউপাত্ত দিয়ে রচনা করেছেন এই অমূল্য দলিল। নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত গ্রন্থসূচিতে রয়েছে: আনিসুজ্জামান, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান, ৭১এর উত্তাল মার্চে চট্টগ্রাম ও আনিসুজ্জামান, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিজ কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ও অর্জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগকে সমৃদ্ধকরণ, ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান, চট্টগ্রামে আনিসুজ্জামানকে কাছে থেকে দেখা, আমৃত্যু চট্টগ্রামকে ফিরে ফিরে দেখা।

গ্রন্থের পরতেপরতে নানা দুর্লভ ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা ও কিছু আলোকচিত্র পাঠককে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সুখস্মৃতিতে নিয়ে যাবে। চট্টগ্রামের প্রতি আনিসুজ্জামানের ছিল মায়ার বন্ধন। চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবার পরও যেকোন ডাক পেলেই তিনি ছুটে আসতেন। এখানকার সাহিত্যসাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। আনিসুজ্জামান দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন রাজধানীর বাইরে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় অবস্থান করেও একজন আনিসুজ্জামান তৈরি হতে পারে।

আনিসুজ্জামান স্যারের চট্টগ্রাম পর্বে ‘সাহিত্য নিকেতন’, আবুল ফজল, আবুল মোমেন নামগুলো অনিবার্য স্মৃতি হয়ে জড়িয়ে আছে। গ্রন্থের লেখক শাকিল আহমদ অনেকটা দ্বিধা সংকোচ এড়িয়ে লিখলেন– “ইট পাথরের নগর যখন আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো তখন আবুল ফজলএর পরিবারের স্বপ্নও মাথা চাড়া দিয়ে উঠার কারণে এক সময়ের চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য ও আন্দোলনের পীঠস্থান সাহিত্য নিকেতনও বহুতল ভবনের নীচে চাপা পড়ে কিন্তু তখন কেউ আর ব্যানার হাতে নিয়ে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সেই ভবনকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি।

আনিসুজ্জামানের কাছে পদবি নয় ব্যক্তি মানুষই সবসময় বড় ছিল। ছেলে আনন্দ জামালের স্মৃতিকথায়– ‘আনিস স্যারের মেজ মেয়ে শুচির স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেমন স্যারকে দেখতে গেছেন তেমনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার প্রায় সিকি শতাব্দ পরও এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রহরী চট্টগ্রাম থেকে ফোন করে স্যারকে সমবেদনা জানান, সান্ত্বনা দেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থান থেকে একেবারে কনিষ্ঠ কর্মচারীর ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন আনিসুজ্জামান। এজন্যই তিনি বাঙালির কিংবদিতূল্য মহান মানুষ। তাঁর বিদায় আমাদের সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি ও শূন্যতা। সেই ক্ষতি সহজে পুষিয়ে ওঠার নয়। আর সেজন্যই শাকিল আহমদ রচিত গ্রন্থটির কাছে পুনঃপুনঃ ফিরে গেলে একজন আনিসুজ্জামানের জীবন ও আর্দশের সন্ধান পাব।

আজাদ বুলবুল গ্রন্থের ভূমিকাতে যথার্থভাবে লিখেছেন গ্রন্থটি সমকালীন সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে। শাকিল আহমদের পর্যবেক্ষণের দক্ষতায় ও বর্ণনার মুন্সিয়ানায় আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব শুধু আত্মজৈবনিক বিবরণ নয়। চট্টগ্রাম ও আনিস স্যারকে ঘিরে অর্ধশতকের অনন্য উপস্থাপন। আবির প্রকাশন থেকে এটি প্রকাশ (অক্টোবর ২০২১) করেছেন মুহম্মদ নুরুল আবসার। টিপলু বড়ুয়া দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে গড়া গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছে আনিসুজ্জামান স্যারকে চেনা জানা মানুষের করতলে।

আনিসুজ্জামানের জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় ও কর্মের বিশাল পরিধি বেষ্টন করে আছে এই চট্টগ্রাম। শাকিল আহমদ আনিস স্যারের সেই স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রামকে আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে একজন ছাত্র শিক্ষকের দৃষ্টিতে নয়; মাননীয় দৃষ্টিতে। চট্টগ্রামবাসীর প্রতি স্যারের জীবৎ কালের অহর্নিস ভালোবাসার দায়শোধেরও এক অনন্য দৃষ্টান্তআনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব। আনিসুজ্জামানের প্রতি চট্টগ্রামবাসীর এই দায়শোধের প্রচেষ্টা ও স্মৃতিধারণ রক্ষার্থে শাকিল আহমদও এক অনন্য দৃষ্টান্ত রাখলেন আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম পর্ব গ্রন্থটি রচনা করে। আনিসুজ্জামানের চেনাজানা প্রিয় মানুষেরা এই গ্রন্থ পাঠে যেমন একদিকে পুলকিত হবেন তেমনি অনেক অজানা তথ্য জেনেও নিজেকে সমৃদ্ধ করবেন বলে আশা করা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার গল্পভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের মাঠকর্মীদের পুরস্কৃত করলেন সাকিব