আমার গল্পভাবনা

সাদিয়া সুলতানা | শুক্রবার , ১০ মার্চ, ২০২৩ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

প্রতিনিয়ত কত গল্প দেখছি, শুনছি, পড়ছি সেসবের কিছুই তো মনে থাকছে না। গল্পের চরিত্রগুলো চোখের সামনে হেঁটে বেড়াতেবেড়াতে আচমকা অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। এযেন হাতের আজলা ভরে পানি তুলছি, মুখটা ধুয়ে নিতে না নিতেই পানি গড়িয়ে হাত শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এর সংলগ্ন মুহূর্তেই আবার খেয়াল করছি, দুই হাতের পাতা ভেজা ভেজা লাগছে, ত্বকে অদ্ভুত এক বিষণ্নতার ছোঁয়া লেগে মিলিয়ে যাচ্ছে; এই যে ভেজা ভেজা অনুভব, স্যাঁতস্যাঁতে একটা বিষণ্নতা থেকে ফের প্রসন্ন হয়ে ওঠাগল্পের কারসাজি হয়তো এটাই। যেই গল্প এমন কারসাজি জানে সেই গল্পকে সহজে ভোলা যায় না, গল্পের চরিত্রগুলোও হঠাৎ হঠাৎ মগজের কোনে কোনে পায়চারি করতে থাকে।

কিন্তু গল্প কী? এ কী নিজের জীবনকে লেখা না অন্যের? গল্পে গল্পে এই যে এত লিখে যাওয়া সেসবের কী আসলে কোনো শেষ আছে? এত যে লেখা হচ্ছে, এতজন যে লিখছেন, গল্প কেন ফুরাচ্ছে না? নিত্য গল্পের মাধুরীর সঙ্গে যত মিশে যাচ্ছি মনেমগজে তত যুক্ত হচ্ছে সহস্র ভাবনা। ভাবনাগুলো খামখেয়ালি মনে হলেও পাঠের জন্য গল্প নির্বাচনে পারতপক্ষে খামখেয়ালি করতে চাই না। সেই কারণেই হয়তো পাঠক আমি গল্পের নির্মাণ শৈলী, গল্পের যাত্রাপথ আর গল্পের চরিত্র নিয়ে ভাবি।

গল্পের শৈলী কেমন হবে তা নিয়ে আলাপচারিতার অন্ত নেই। আবার লেখকভেদে এই শৈলীর বৈচিত্র্যেরও শেষ নেই। দশ জন গল্পকার যেমন একটি প্লটে দশটি ভিন্ন স্বাদের গল্প লিখতে পারেন তেমনি একজন গল্পকার একটি প্লট নিয়ে দশটি গল্প লিখতে পারেন। কেউ আবার হয়তো গল্পের প্লট, থিম, ক্লাইমেক্স এইসব নিয়ে একদম ভাবেন না। নিজের মতো করে নিজের অভিজ্ঞতা নিঙড়ে লিখে যান। আসলে গল্প তো হরেক রকমের। গল্পের সংজ্ঞাগত বিশ্লেষণে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি শুধু গল্পের ভেতরে সেই ছোট্টবেলার মতো দাদীনানীর পাশে শুয়ে বসে গল্প শোনার সুখের মতো সুখ খুঁজি। আর চাই গল্পের সঙ্গে নিজের জার্নিটা ম্যাড়মেড়ে নয়, চমকপ্রদ হবে।

একটা ছোটগল্প কতটা পথ ঘুরে আসবেএর ধরাবাঁধা মাপ কোনো লেখককে দিয়ে দেওয়া যায় না জানি। তবু ছোট গল্প যেন ছোট হলেই স্বস্তি। অতিরিক্ত দীর্ঘ হলে গল্পের জার্নি মাঝেমধ্যে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। শব্দের অহেতুক ব্যবহার বা অপচয় ছোটগল্পে ঠিক যেন মানায় না। উপন্যাসে হয়তো মানিয়ে যায় বেশ। আবার সুর না কাটলে একটা দীর্ঘ গল্পও কিন্তু তরতরিয়ে পড়া যায়। কিন্তু এতে ছোটগল্পের স্বাদ যেন ঠিকঠাক পাই না। ছোট্ট অথচ ছন্দোবদ্ধ পরিসরে চুম্বক আকর্ষণে আটকে রেখে শেষটায় সপাটে আঘাত করবে এমন গল্পই প্রিয়। তার মানে গল্পের শেষে যুতসই চমক দারুণ উপভোগ করি। গল্প পড়তে পড়তে যেই গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইছি সেখানে না গিয়ে যদি গল্পকার অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে চলে যান তবে বলে উঠি, দুর ছাই কী ভাবলাম আর কী হলো! কিছুই তো হলো না! এটাও কিন্তু একপ্রকার চমক।

চমক আনার জন্য গল্পের ভেতরে অণুগল্পও ফাঁদেন গল্পকার। একটা ছোটগল্পে একাধিক অণুগল্প থাকলে একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র রাখেন। আবার কোনো কোনো গল্পের সমাপ্তিতে চমকের বদলে হিরন্ময় নীরবতা নামে যা পাঠকের ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে অন্যতম প্রিয় গল্পকার আফসার আমেদের ছোটগল্প ‘হাসিনার পুরুষ’র কথা বলি। এই গল্পের শেষে কিন্তু চমক নেই, চমকহীনতাই এই গল্পের সমাপ্তির অলংকার। কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সংস্পর্শে না যেতে পেরে হাসিনা যখন নিজের ঘরে ফেরে তখন হাসিনার আঁটি চুষে চুষে খাওয়ার যেই দৃশ্য গল্পকার তৈরি করেন সেটাই পুরো গল্পের আকর্ষণ হয়ে ওঠে। হাসিনা আম খায়, আঁটি চোষে, স্বাদেরসে পরিতৃপ্ত হয় আর পাঠক উন্মুখ হয়ে খুঁজতে থাকে ওর দেহের অভ্যন্তরের বঞ্চনা। ‘হাসিনার পুরুষ’ গল্পের সহজিয়া ভাষাও তখন পাঠকের মনে বিভ্রম তৈরি করে।

আমার কাছে মনে হয় একটা গল্প তখনই সার্থক হয়ে ওঠে যখন সেটা পাঠকের মনে ভ্রমবিভ্রম তৈরি করে। কিন্তু এই ভ্রমবিভ্রম বা ধাঁধা তৈরি করতে গিয়ে গল্পের ভাষা দুর্বোধ্য হলে হয় না। আমি গল্পের ভাষায় চাই স্বচ্ছতা, বাক্যে চাই মসৃণতা আর শব্দ ব্যবহারে খুঁজি গল্পকারের পরিমিতিবোধ। এখানে ফুলের মতো পেলব, কোমল ভাষার ব্যবহারই যে গল্পের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠবে বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। ফুলের কোমলতায় সত্যি বলার, সত্যিকে খোঁজার স্বস্তি তো নেই। কারণ ‘ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই/ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।/তার চেয়ে আমার পছন্দ/আগুনের ফুলকি/যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।’ আসলে সুভাষ মুখোপধ্যায়ের মতো আমি ভালোবাসি আগুনের রমণীয় ফুলকি। এই ফুলকি যেই কলমে ওঠে, যেই গল্পে ফোটে সেই গল্পই আমার কাছে প্রিয় পাঠ হয়ে ওঠে। ক্রিম, চিজ, ফাইন সুগার, ড্রাই ফ্রুটস এসব বাহারি উপাদান দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে উপাদেয় খাবারের মতো যেই গল্প পরিবেশন করা হয় সেই গল্পে এই আগুনটা ঠিক থাকে না। আর আগুন থাকে না বলেই সত্যিটা থাকে না। কিন্তু গল্পে আমার সত্যিটা চাই; নিষ্ঠুর, নির্মম সত্যি চাই। আর তাই গল্পের বুননে চাই লেখকের গুঁজে দেওয়া অস্বস্তি।

একটা গল্পের যাত্রাপথ বা বর্ণনা শৈলী মসৃণ হলেও গল্পটা কিন্তু পাঠকের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। এমন গল্প পাঠককে গোলকধাঁধায় আটকেও ফেলতে পারে। ইহকালে ঐ ধাঁধা থেকে পরিত্রাণের পথ পাঠক পায় না। আর সেই গল্পকে ভুলতেও পারে না। তাই হয়তো মান্টোর ‘খুল দো’ গল্পটা একবার পাঠের পরেও অগুনতিবার মনে পড়তে থাকে। এই যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।

খুল দো’ গল্পে ডাক্তার স্ট্রেচারে শোয়া গণধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে করতে যখন জানলা দেখিয়ে বুড়ো সিরাজুদ্দিনকে বলেন, খুলে দাওখুল দো ঠিক তখনই স্ট্রেচারে শোয়া অর্ধমৃত মেয়েটি যন্ত্রণাকাতরতার মধ্যেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার সালোয়ারের ফিতে খুলে সালওয়ার নামিয়ে দেয় আর সিরাজুদ্দিন আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, বেঁচে আছেআমার মেয়ে বেঁচে আছে!-এমন তীব্র বেদনা গুটিকয়েক চরিত্রের সমন্বয়ে অল্প শব্দে বর্ণনা করে ফেলেন যিনি তিনি খ্যাতিমান উর্দু গল্পকার সাদত হাসান মান্টো। মান্টোর গল্পের তীব্রতা এমনই যে পাঠকের ভাবনার জগতকে একেবারে ছিড়েখুঁড়ে ফেলে। ভাবি কী করে ভাবতেন মান্টো, কী করে লিখতেন এমন? সময় আর সাহসই কি মান্টোকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে? আবার ভাবি দেশভাগের নির্মমতার মুখোমুখি তো অনেক লেখকই হয়েছেন, মান্টোর মতো আখ্যান নির্মাণে সংবেদনশীল হতে পেরেছেন ঠিক কত জন? কতজনই বা গল্পচ্ছলে সত্যিটা বলে পাঠকের মনে এমন তোলপাড় তুলতে পেরেছেন?

অভিজ্ঞতার ঝোলা ভারি হলেই হয়তো এমন তীর তীক্ষ্ম গল্প লেখা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই সংবেদনশীলতা। তাই গল্পের শিল্পীকে হতে হয় সংবেদনশীল। এমন একজন গল্পকারই শুধু পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখতে জানেন, জানেন কী করে পাঠককে টেনে গল্পের সমাপ্তিতে নিয়ে যাওয়া যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন দিনব্যাপী প্রি-রামাদান
পরবর্তী নিবন্ধহিরন্ময় সময়ের ঘটনাপ্রবাহ