হারিয়ে যাওয়া পেশা

মুহাম্মদ মুসা খান | মঙ্গলবার , ৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে, আর হারিয়ে যাচ্ছে কিছু ‘পেশা’, বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে এবং দৈনন্দিন জীবনে চাহিদার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে ‘পেশা’ বদলের হারও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘পেশা’ বদলে যাওয়া মানুষকে সাময়িক সমস্যায় ফেলে সত্য, কিন্তু সে সমস্যা কাটিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষ ভিন্ন পেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
সমপ্রতি ‘প্রশান্ত মৃধা’ নামের একজন লেখক ‘হারিয়ে যাওয়া জীবিকা’ নামের গ্রন্থে হারিয়ে যাওয়া ও হারিয়ে যেতে বসা ৩০টি পেশার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এক সময় যে পেশা জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম ছিল, বর্তমানে তা বিলুপ্ত কিংবা বিলুপ্তপ্রায়। বেশ কিছু পেশার ভবিষ্যৎ টিমটিমে আলোর মতো জ্বলছে নিভে যাওয়ার অপেক্ষায়। এগুলোর সঙ্গে জীবিকার বাইরেও কমবেশি বহু লোকের শৈশবের স্মৃতি লেপ্টে আছে। জীবিকাগুলো হচ্ছে- ঝর্ণা কলমে নাম খোদাই, ঘটিগরম, ঝর্ণা কলম সারাই, বটতলার বই, ব্ল্যাকের ইন্ডিয়ান শাড়ি, সিনেমার ক্যানভাস, দেলবাহার, বানর-খেলা, আটাকদমা, উড়ে মালি, কুল্ফি মালাই, বায়োস্কোপ, শিল-পাটা খোঁদানো, টিয়ে পাখির ঠোঁটে ভাগ্য গণনা, টাইপ রাইটার, মাধুকরী, গাজীর গান, বৈষ্ণব ও বৈরাগিণী, পুরনো কাপড়ের বদলে বাসন-কোসন, ভাড়ার সাইকেল, মাখন জ্বালিয়ে ঘি, তেল মালিশ, পুকুর আর কুয়ো ছাঁকা, পট ও পটগান, কাঁসা-পিতলের বাসন, যন্ত্রে বাত নিরাময়, ঘোলওয়ালা ও ঘোষমশাই, বহুরূপী, বাজারের মাসি, পাখা টানাওয়ালা, পিন-হোল ক্যামেরা ও লেটার প্রেসের কম্পোজিটর প্রভৃতি”।
এসবের বাইরেও আমরা কিছু পেশাকে হারিয়ে যেতে দেখেছি এবং কিছু পেশা দ্রুতই হারিয়ে যাওয়ায় পথে আছে দেখতে পাচ্ছি। যেমন-সিনেমার ক্যানভাসার, ভিস্তিওয়ালা, দুধওয়ালা (গোয়ালা), ভিসিআরে সিনেমা প্রদর্শন, ঘোড়ার গাড়ি, হাজাম, বাইস্কোপ প্রদর্শন, সাইনবোর্ড লিখিয়ে ও রিঙার পেছনে ছবি আঁকা তুলি শিল্পী, গরুর গাড়ি প্রভৃতি পেশা হয় হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যেতে বসেছে।
সিনেমার ক্যানভাসারদের সুর-চিৎকার করে- ‘হ্যাঁ ভাই, সম্পূর্ণ রঙিন..সোশ্যাল অ্যাকশন ড্রামা আর সাসপেন্সে ভরপুর,রাজ্জাক-শাবানার ‘ফুলের মধ্যে কাটা’ আজ থেকে জলসা সিনেমায় শুভমুক্তি’। সিনেমার এই প্রচারণা রিঙা-টেঙি ও রেডিওতে হরহামেশাই শোনা যেত, যা শোনার জন্য ছেলেমেয়েরা রিঙার পেছনে লাইন ধরতো। গ্রামের মেলাতে বায়োস্কোপওয়ালার উৎফুল্ল চিৎকার ‘কী চমৎকার দেখা গেল, রাজা গেলো মন্ত্রী গেলো’, ছেলে-বুড়োদের আনন্দের খোরাক জোগাতো। আমরাও পয়সা দিয়ে এই বায়োস্কোপ দেখেছি। ‘বানর খেলার’ সেই পুরনো গল্প তো সবাই জানি। ঘটিগরমওয়ালার ছন্দ মেলানো সুর ‘খোকা খাবে, খুকু খাবে, খোকার মা’য় পয়সা দেবে’ এমন সুর করা হাঁক-ডাকগুলো আর শোনা যায় না। হয়তো আর শোনা যাবেও না। ‘দুধওয়ালা’ বা গোয়ালা পেশা এখনও নিভু নিভু ভাবে আছে। তাঁদেরকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘দুধোলি’ও বলা হতো’। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাভীর দুধ দোহন করে নিয়ে আসতো, আবার ফেরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতো। আশির দশকে আমাদের দেশে ‘ভিসিআরে সিনেমা প্রদর্শন’ ব্যবসা বেশ জমজমাট ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এসে কোরবানিগঞ্জ বলুয়ার দীঘির পাড়ে গিয়ে ভিসিআরে সিনেমা দেখতাম। গ্রাম-শহরের মানুষ ঘটা করে এক সময় এই ভিসিআরের আসর বসাতেন। একসময়ের জনপ্রিয় বিনোদনযন্ত্র ভিসিআরের যুগও শেষ হয়েছে অনেক আগে। এখন মানুষের হাতের মুঠোফোনে সিনেমা দেখা যাচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতবষের্র বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ‘ভিস্তিওয়ালাদের’ আনাগোনা ছিল বলে আমরা জেনেছি । ঢাকাতেও তাদের বিচারন ছিল (ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের ‘সাক্কা’ বলা হত)। তখন বাড়িতে পানি সরবরাহ ছিল না, পানির কলও কম ছিল। পশুর/ছাগলের চামড়ার ব্যাগই ছিল পানি সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম। সেই চামড়ার থলেকে বলা হতো “মশক” বা “ভিস্তি”! মশক বা ভিস্তিতে পানি ভরে সেটা পিঠে বয়ে ফেরি করে পানি বিক্রি করা মানুষদের বলা হতো ‘ভিস্তিওয়ালা’। ১৮৩০ সালে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদম- শুমারিতে ঢাকায় ১০টি ভিস্তি পল্লীর উল্লেখ করেছিলেন। যাতে বোঝা যায়,এই পেশা বেশ জমজমাট ছিল। ২০১২ সনে আমি ভারতের আজমির শরীফে এই ভিস্তিওয়ালাদের দেখেছি। সেখানে মাজার জিয়ারতের জন্য যাওয়া মানুষের অনেকে কিছুটা বিশ্বাস ও প্ররোচিত হয়ে ভিস্তিওয়ালাকে টাকা দিয়ে ভিস্তির পানি চৌবাচ্চায় ফেলে থাকে।
আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি, ‘হাজাম’রাই ছেলেদের খতনা করাতো, যা ছিল বেশ ঝুঁকি পূর্ণ। খতনা করানোর সময় মায়েরা জায়নামাজে বসে দোয়া করতেন। সেই ‘হাজাম’ পেশা আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ‘গরুর গাড়ি’ ছিল গ্রামাঞ্চলে মালামাল পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম। কালের বিবর্তনের সেই গরুর গাড়িও হারিয়ে গেছে। ঢাকাতে ‘ঘোড়ার গাড়ির দেখা মিললেও অন্য কোথাও ঘোড়ার গাড়ির অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।
নিজেদের বা পূর্বপুরুষের পেশাচ্যুত হয়ে মানুষ সাময়িক ভাবে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়ে যায়। তবে পরবর্তীতে সে জীবন-জীবিকার তাগিদে ভিন্ন ‘পেশায়’ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পেশা পরিবর্তনের কারণেই আজ কাল রাস্তাঘাটে প্রচুর হকারের দেখা মেলে। যারা তরিতরকারিসহ বিভিন্ন প্রকার মনোহরি দ্রব্যাদি ফেরি করে বিক্রি করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক (যিনি ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছেন) ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, ‘হারিয়ে যাওয়া পেশা নতুন করে চালু করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যের খবর রাখা জরুরি। ঐতিহ্য সবসময় ধারণ করতে হয়। আমাদের পূর্বসূরিরা আমাদেরকে কতটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের কতটা কৃতিত্ব ছিল- তা পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে হবে। এটি মিউজিয়াম আকারে হলেও রাখতে হবে। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম এগুলো বুঝতে পারবে’।
আমরা মনে করি, বিগত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের দেশে যেসব পেশা দৃশ্যমান ছিল, সেসবের একটি তালিকা এবং বিস্তারিত বর্ণনা সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকা উচিত। যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের পূর্ব পুরুষদের বিচিত্র পেশা সম্পর্কে জানতে পারে। দেশের মিউজিয়াম গুলোতেও বিভিন্ন পেশা নিয়ে একটা বিভাগ বা কর্ণার থাকতে পারে, যা দেখে মানুষ পূর্বপুরুষদের পেশা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে। পেশা হারিয়ে যাবে প্রকৃতির নিয়মে, কিন্তু আমরা যেন পূর্বপুরুষের ‘পেশা’ বিস্মৃত না হই। তাহলেই ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচসিককে আয়বর্ধক প্রকল্প প্রণয়ন ছাড়া উপায় নেই : মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী ও ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একে অপরের পরিপূরক