আজাদী : ‘আঁরার সেরা পত্রিকা, আঁরা গর্ব’

শিবুকান্তি দাশ | মঙ্গলবার , ১২ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ


দৈনিক আজাদী। আমাদের শৈশব কৈশোরের ভালোবাসার দৈনিক। চট্টগামের প্রথম প্রকাশিত এ দৈনিক। সে হিসেবে অনেক পুরানো। কিন্তু সময়ের সাথে একদম আধুনিক। পুরানো বলে দৈনিকটি বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে যায়নি। সময়ের গতিতে গতিশীল থাকতে নিজেকে সবসময় তরুণ রাখতে সচেষ্ট আজাদী। পাঠকের পছন্দের তালিকায় এ পত্রিকা শীর্ষে।
আমি যখন প্রাইমারি শেষ করে হাই ইশকুলে পা রাখি, তখন থেকে দৈনিক আজাদী পড়ার সাথে বেড়ে উঠছি বলতে গেলে। আমার বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রাখা হতো দৈনিক ইত্তেফাক। পাশের দোকানে রাখা হতো আজাদী। আজাদী সকালেই পাওয়া যেতো। আর ইত্তেফাক চট্টগ্রাম থেকে পটিয়ায় পৌঁছাতো দুপুরে। আমি পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ইশকুল ছুটির পর বাবার দোকানে বসে ইত্তেফাকটি চোখ বুলিয়ে পাশের দোকানে যেতাম আজাদী পড়ার জন্য। আমি তখন আগামীদের আসর’ পাতাটির প্রতি নজর রাখতাম বেশি। কোনদিন আগামীদের আসর ছাপা হতো উন্মুখ হয়ে থাকতাম। এ পাতাটিতে ছড়া, কবিতা গল্প কত কি মজার মজার বিষয় ছাপা হয়। সেগুলোই আমাকে টানতো। এ গুলো পড়ে পড়েই তো নিজেও লেখার প্রেরণা পেতাম। এক সময় ছড়া লিখায় মনোযোগ বাড়ে। শনিবার মানে আজাদীতে আগামীদের আসর। শত কাজের মাঝেও সেদিন আজাদীতে চোখ রাখতেই হবে। তারপর ধীরে ধীরে পাঠক হয়ে উঠা আমার। আমাদের পটিয়ায় মোস্তাফিজুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরী ছিল। পটিয়া ক্লাবের অঙ্গ প্রতিষ্টানের মতো। আজ সেই লাইবেরী নেই। অযত্ন অবহেলায় কাঁদছে। পাঠক নেই। সেখানে ক্লাবের সদস্যারা নানা কাজে ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে লাইবেরী জীবনের সেইসব সোনালী দিনগুলোর কথা। আমরা তখন হাই ইশকুল থেকে কলেজে। লাইবেরী খোলা হতো বিকাল ৫ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। আমরা লাইবেরীকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল সাহিত্য গোষ্ঠী মালঞ্চের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতাম। মাসে মাসে বসতো সাহিত্য সভা। প্রতিদিন পাঠকের সমাবেশ থাকতোই। আমরা কয়েকজন লেখক হওয়ার চেষ্টায় ছিলাম সব রকম খোলাহল ছেড়ে। তারা সবাই পত্রিকার যোগ্য পাঠক। বিকালে কার আগে কে লাইবেরীতে প্রবেশ করবো তা নিয়ে মনে মনে স্নায়ু যুদ্ধ ছিল। আজাদী আর সংবাদ নেয়া হতো লাইবেরীতে। দুটো পত্রিকায় তখন জনপ্রিয়। সংবাদ ঢাকার জাতীয় পত্রিকা আর আজাদী আমাদের প্রাণের দৈনিক। ‘আঁরার চাঁটগাইয়া সেরা পত্রিকা। আঁরা গর্ব’।
আমি আজাদী যখন হাতে নিই কেউ কোন পাতা চাইতে চাইলে মনে মনে এমন রাগ আসতো খুব কষ্টে তা হজম করতো হতো। কারণ আমিই আগে পুরো পত্রিকাটি পড়বো। আমার আগে কেউ পড়ে ফেলবে তা মেনে নিতে পারতাম না।
দৈনিক আজাদী আমার লেখালেখির প্রিয় সোপান। কোন দৈনিকে প্রথম আমার লেখা ছাপিয়েছে তা হচ্ছে দৈনিক আজাদী। আমার প্রথম ছড়া ’হেমন্তের সুখ’ শিরোনামে লেখাটি ছাপা হয় ১৯৮৯ সালে। সেদিন যে আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বলতে পারব না। আমি এ পর্যন্ত লেখালেখির পুরস্কার হিসেবে ‘অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশ শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার, এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার ও মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছি। কিন্তু আজাদীতে যে দিন আমার ছড়াটি ছাপা হয়েছিল সেদিনের আনন্দ ছিল আমার পুরস্কার পাওয়ার চেয়েও বেশি। আমি মনে করেছি আজাদী আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে একজন ছড়াকার হিসেবে। সেদিন আজাদীর আগামীদের আসরে আমার লেখাটি ছাপা না হলে আমি হয়ত হারিয়েও যেতে পারতাম লেখালেখি থেকে। কিন্তু আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাহাড়সম যে প্রেরণা যুগিয়েছে তা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি মনে করি। আজাদী শুধু আমাকে নয়, চটগ্রামের অনেক অনেক কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি করেছে। আজকে অনেকের দেশজোড়া খ্যাতি। তা আজাদীই এগিয়ে দিয়েছিল বলে।
আজাদীর প্রতিনিধি যারা আমার জানা মতে, তারা প্রতিটি এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। আমার এলাকার প্রতিনিধি ছিলেন প্রয়াত জালাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি আজাদীর সাংবাদিক হিসেবে সুনামের অধিকারী ছিলেন। সংবাদ পরিবেশনায়ও আজাদীর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আমার চোখে পড়েনি কখনো আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদের কোন প্রতিবাদ কেউ কখনো করেছে।
আজাদীতে এক সময় বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকান্ড নিয়ে প্রেস রিলিজ পাঠাতাম ফ্যক্সে। হাতে লেখা সেই প্রেসরিলিজ যখন ছাপা হতো কি যে ভালো লাগত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রিভিউ লিখতাম। কত সুন্দর ভাবে তা ছাপা হতো। অথচ আজাদীর কারো সাথে কোন পরিচয় ছিল না। এসব লিখতে লিখতে সাংবাদিক হওয়ার অভিলাষ মনের কোণে উকি দিতো। কিন্তু সময়ের স্রোতে কী করে যে সংবাদপত্রের সাথে জড়িয়ে গেলাম নিজেই জানি না। পেশার কারণে একদিন ঢাকায় চলে আসি। আমার সাংবাদিকতার পেশা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। ঢাকার দৈনিক রূপালী পত্রিকায়। তারপর ২০০৯ সালে আজাদীর ঢাকা ব্যুরো অফিস কয়েক মাস রিপোর্টিংএ কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। আজাদী আমার জীবনের সাথে মিশে আছে।
আজাদী সবসময় আধুনিক। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ছন্দে ছন্দে সুরের রেনু ছড়িয়ে বয়ে যাচ্ছে সময়ের কত না ঘটনা। আজাদী যেনো পাঠকের প্রাণ। পাঠকের চাওয়াকে সবসময় গুরুত্ব দেয় আজাদী। সবার মনের খোরাক যোগায় এই আজাদী। কি ছাপে না? সংবাদের পাশাপাশি, ইতিহাস ঐতিহ্য,অর্থনীতি, রাজনীতি, শিশু, নারী, শ্রমিক,শিল্পী,কবি সাহিত্যিক, খেলাধূলা, সব সব। এক কাগজেই পাঠক পেয়ে যায় সব খবর। আজাদীর দীর্ঘ চলার পথে ভালোবাসার যে সেতু রচনা করে চলছে তা প্রতিনিয়ত সচল থাক, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভ কামনা জানাই আজাদী পরিবারকে।
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক ড. আবদুল করিম ও তাঁর ইতিহাস চর্চা
পরবর্তী নিবন্ধবৃষ্টি জলে বিসর্জন