নজরুল ও বঙ্গবন্ধু : উক্তি ও উপলব্ধির অভিব্যক্তি

মুহম্মদ নূরুল হুদা | বৃহস্পতিবার , ৭ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

কেবল হাজার বছর নয়, ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে ধারাক্রমে বিবর্তিত এক সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। আর সেই জাতিরাষ্ট্রের দুই দ্রোহী জাতিভাস্করের নাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রায় একুশ বছরের ব্যবধানে তাঁরা এসেছিলেন এই মর্ত্যলোকে, তবে পুনরায় চিরজীবনে প্রবেশ করেছেন মাত্র বছরখানেকের দূরত্বে। জন্মের মুহূর্ত-বিচারে তাঁদের বয়সের ব্যবধান যদিও দুই দশক, উপলব্ধি-উক্তি-যুক্তি-ও-অভিব্যক্তির পারম্পর্যে তারা প্রায়-সমগোত্রীয়। ধারাবাহিকতায় আগে-পরে হলেও স্বপ্ন ও বাস্তবতার একাগ্রতায় তারা প্রায়-অভিন্ন। একজন কবি, সৈনিক, দ্রোহী ও জন্ম-স্বাধীন; অন্যজন রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা, দ্রোহী ও জন্ম-স্বাধীন। এ-রকম আরো অনেক ব্যক্তিক অভিন্নতা বা ভিন্নতা আছে অবশ্যই, তবে আজ আমাদের মুখ্য পরিবীক্ষণ প্রধানত তাঁদের মনোগত, আদর্শগত, জাতিগত, দর্শনগত, উচ্চারণগত তথা অভিব্যক্তিগত ঐকমত্য। দেশের নাম উচ্চারণেও তারা দুজনেই আক্ষরিক অর্থেই যেন একজন। সেই উচ্চারণ আর কিছু নয় ‘বাংলাদেশ’ :
নমঃ নমঃ নমো বাঙলা দেশ মম
‘চির মনোরম চির মধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর।’
এই কবিতায় (যা গান হিসেবেও অতি জনপ্রিয়) কবি তাঁর দেশের নাম হিসেবে উচ্চারণ করেন ‘বাঙলা দেশ’, যা আজকে আমাদের প্রিয় জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। নজরুল ‘বাঙলা’ ও ‘দেশ’ দুই উচ্চারণে একক অর্থপ্রতীকে ব্যবহার করেছিলেন, আর বঙ্গবন্ধু মাটি-মানুষ-ভাষা ও বাঙালির আশানিরাশার সময়ানুগ বিবর্তনে স্বাধীনতা লাভের পূর্বক্ষণে সমার্থক একক উচ্চারণে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশ’। এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পূর্বসূরী নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এই দেশনামটিকেই গ্রহণ করেছিলেন বিজয়ী বাঙালির প্রথম সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র রূপে।
নজরুল কি জানতেন তাঁর আগমনের কথা? যেমন জানতেন বলে অনুমিত হয় রবীন্দ্রনাথ? কবিগুরু ১৯৪০ সালে আশি বছর বয়সে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, “আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্রলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে শোনাবে মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।” তারপর উচ্চারণ করেছিলেন সেই অমোঘ কাব্যবাণী:
ঐ মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।
———-
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নবজীবনের আশ্বাসে।
‘জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়’
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই গণবাঙালি থেকে আবির্ভুত মহামানবের আগমনী ও জয়ধ্বনির সমিলতা। আরো আশ্চর্য হই যখন দেখি, তারও প্রায় ১৪ বছর আগে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে বিদ্রোহী কবি নজরুলের কণ্ঠেও তখন উচ্চারিত হচ্ছে স্পষ্ট ও সাধু গদ্যোচ্চারণে (১৯২৬) এক মহানায়কের আবির্ভাবের সংবাদ :
“দিন আসিয়াছে, বহু যন্ত্রণা পাইয়াছ ভাই, এইবার তাহার প্রতিকারের ফেরেশতা দেবতা আসিতেছেন। তোমাদের লাঙল, তোমাদের শাবল তাঁহার অস্ত্র, তোমাদের কুটির তাঁহার গৃহ। তোমাদের ছিন্ন মলিন বস্ত্র তাঁহার পতাকা। তোমরাই তাঁহার পিতামাতা। আমি আপনাদের মাঝে সেই অনাগত মহাপুরুষের আগমন প্রতীক্ষা করিয়া আপনাদের নবজাগরণকে সালাম করিয়া নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছি, এই বুঝি দিনমণির উদয় হইল। (নজরুলের পত্রাবলী, পৃ. ২২)।”
ময়মনসিংহের কৃষক শ্রমিক সম্মেলনে প্রেরিত চিঠিতে ১৯২৬ সালেই তিনি এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। এই ‘দিনমণি’ তাঁর কবিচিত্তে একটি চির-জাগ্রত অজড় কর্মশক্তির মতো ‘ভোরের বেলায় পুব-গগনে উঁকি দেন’। তিনি তাঁর ভিতরে এমন একটি মাঙ্গলিক বীরসত্তার অবয়ব প্রত্যক্ষ করেন, যার মধ্যে আমরা ভাবী কালের ‘বঙ্গবন্ধ’ু তথা ‘বিশ্ববন্ধ’ুকে আবিষ্কার করি। ‘মাঙ্গলিক’ শীর্ষক এই কিশোর-কবিতায় কবি ভবিষ্যতের ত্রাণকর্তার চিত্র এঁকেছেন।
এই সহজ সরল অথচ প্রতীকী কবিতাটি যেন সূর্য-প্রতীকে নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর মাঙ্গলিক জীবন-সধনার এক সত্যান্বেষী আয়না-প্রতীক। অধোরেখ পঙক্তি ও শব্দগুচ্ছে তার ইশারা আছে। শক্তি-তেজ, শক্তি-তপস্যা, আত্ম-বিশ্বাস, আদর্শ মানুষ ্ত ইত্যাকার ভাবনা যতই সরল মনে হোক না কেন নজরুলের বিদ্রোহ ও মঙগলসত্তা মূলত এই মানবিক শক্তি-দর্শনের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। এই হচ্ছে পরাধীন স্বদেশে স্বাধীন সত্তার উত্থানের মূল সূত্র। নজরুল তাঁর শীর্ষকবিতা ‘বিদ্রোহী’ ছাড়াও অজস্র কবিতায় এই শক্তিসত্তার বন্দনা করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ অবশ্যই আত্মশক্তিতেই জাগ্রত। ‘আত্মশক্তি’ কবিতাতেও কবির স্পষ্ট ঘোষণা:
এস বিদ্রোহী মিথ্যা-সূদন আত্মশক্তি-বুদ্ধ বীর
আনো উলঙ্গ সত্য-কৃপাণ, বিজলী-ঝলক ন্যায়-অসির।
উল্লেখ্য যে, নজরুলের মুক্তিদর্শনের মূলে আছে এই ‘আত্মশক্তি’।
ভগবান যে মূলত ‘আত্মজ্ঞান’, ‘আদিম স্বাধীন-প্রাণ কেবল জাগ্রত আত্মা’র মধ্যেই যে বিরাজমান – এই শক্তিদর্শনই নজরুলের বীরসত্তার উৎস। সেই সত্তাই জাগ্রত করেছে বাংলার ভাবী প্রজন্মকে, যার এক বিশ্রুত মূর্তরূপ বঙ্গবন্ধুর সার্বভৌম বাঙালি তর্জনীর উদ্ধত প্রতীকে স্বাধীনতার ঘোষণা। ভীরু বাঙালিকে বীর মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করেছে নজরুলের এই ব্যক্তিক ও সামষ্টিক শক্তিসাধনা। তারই ফলশ্রুতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আত্মশক্তিহীন ব্যক্তি মৃত ব্যক্তি। নজরুল মনে করে মানুষ বা জীব ‘শক্তি-সিন্ধু’র মধ্যেই বাস করে। যে এই শক্তি ধারণ করতে ব্যর্থ, সে প্রাণহীন।
শক্তি-সিন্ধু মাঝে রহি হায় শক্তি পেল না যে,
মরিবার বহু পূর্বে জানিও মরিয়া গিয়াছে সে।
(শক্তি, ন.ক.স. পৃ৯৬২)
আসলে নজরুল কেবল উচ্চারণ-সর্বস্ব কবি নন, তিনি বীররস ও শক্তিদর্শনজাত এক প্রবুদ্ধ উপলব্ধির কবি। স্বাধীনতা ও মুক্তি যে এ পথেই আসবে, তারও রূপরেখা তৈরি করেছিলেন নজরুল, সেই ১৯৪২ সালেই।
বঙ্গবন্ধু তখন তেইশ বছরের টগবগে এক শক্তিমন্ত তরুণ। তিনি ততক্ষণে নিশ্চিতভাবেই নজরুলের শক্তিমন্ত্রেই সুদীক্ষিত। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাঁর আভাস মেলে। ১৯৪১ সালের মধ্যে তিনি নজরুলের দেখা পেয়েছেন। ফরিদপুর ছাত্র লীগের জেলা কনফারেন্সে নজরুল এলেন আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে কবি তখন তাঁর বন্ধু হুমায়ুন কবিরের বাসায় বসে সকলকে গান শোনালেন। তরুণ মুজিব শুনলেন, দেখলেন ও তাঁর দর্শনে স্বদীক্ষিত হলেন। আসলে সেই শৈশব থেকেই তিনি নজরুলে আসক্ত। সেই প্রেরণা অমোঘ সত্য হয়ে এলো কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ দর্শনের পর। তারও কয়েক বছর পরে ১৯৫২ সালে তিনি যখন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে করাচি যাচ্ছেন একটি রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে, তখন তাঁর কয়েকজন সফরসঙ্গীর আনুরোধে আবৃত্তি করে শোনালে নজরুলের কবিতা :
“আমার কাছে তাঁরা নজরুলের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকে ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’্ত আরো কয়েকটি কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম।”
প্রথম কবিতাটি শোষণমুক্ত সমাজ, দ্বিতীয়টি লৈঙ্গিক বৈষম্যহীন মানব-সমতা ও তৃতীয়টি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজের বার্তাবহ। অর্থাৎ তখন থেকেই নজরুলের মতোই শোষিতের গণতন্ত্র-ভিত্তিক সমাজতন্ত্র ও সমতাসুখী সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন তরুণ মুজিব।
এরও আগে ১৯৫০ সালে তরুণ শেখ মুজিব নজরুলের কবিতা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এতে ‘নজরুলের কবিতার বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্রোহী জীবনযাত্রার এক নিখুঁত আলোচনা’ ছিল বলে জানা যায়। দৈনিক ইত্তেফাকের একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলা হয়,
“পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর ১৫০ মোগলটুলীতে ২৩ অক্টোবর (শুক্রবার) বেলা পাঁচ ঘটিকায় রবীন্দ্র-নজরুল জন্মবার্ষিকী উৎসব পালিত হয়। …পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান এই সময় করাচি থাকায় তাঁহার প্রেরিত এক প্রবন্ধ জনাব মোশাররফ হোসেন চৌধুরী পাঠ করে শোনান। ” (জাতীয় নজরুল সম্মেলন মৌলভীবাজা, ১৭-১৯ এপ্রিল ২০১৯। পৃ. ২৭/ জাতীয় কবি ও জাতির পিতা, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক রচিত প্‌্রবন্ধ থেকে)
অর্থাৎ নজরুলের চেতনায় নজরুলের নানাকৌণিক সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা শুরু থেকেই প্রভাব বিস্তার করে ছিল। আমাদের হাতে বঙ্গবন্ধুর অন্য যে রচনাটি আছে আরো পরে সেটি ১৯৭২ সালে রচিত। সে বিষয়ে আমরা যথাস্থানে পরে আলোচনা করবো।
অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতে নজরুল তাঁর “পূর্ণ-অভিনন্দন” কবিতায় ‘জয়-বাংলা’ শব্দাস্ত্রটিও উচ্চারণ করেছিলেন। তারও আগে ১৯২২ সালে তৎসম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে উচ্চারণ করেছিলেন উপমহাদেশ তথা এই বাংলাদেশেরও পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা।
“ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে।”
সহজেই বোঝা যায়, যে মুক্তি, স্বাধীনতা ও বাঙালির বিজয়-নিনাদ নজরুলের চিরজয়ী বীরসত্তা, তা-ই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে ও কর্মে-ধর্মে প্রত্যাশিত বাস্তবতা। তাই নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় একই বোধের বিববর্তন-সঞ্জাত অভিন্নতা। বিবর্তনসঞ্জাত এ-কারণেই যে, সভ্যতার সত্যান্বেষণ মানুষের পূর্বজ্ঞান, আত্মজ্ঞান ও অর্জিত নবজ্ঞানের ধারাস্রোতে নবায়িত হতেই থাকে। এটিই কালের স্রোতে মানবজাতির নিত্যনবায়নপ্রবণ প্রজ্ঞার অবয়ব। বোধের এই বিবর্তনের নিরিখেই আমরা সংক্ষেপে নজরুল-বঙ্গবন্ধুকে আরো কিছুটা পরিবীক্ষণ করবো। তবে তারও আগে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে আধুনিক বাঙালির একটি পরিশ্রুত প্রতিকৃতি সনাক্ত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমাদের মতে, নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর চেতনালোকে বাঙালির এই প্রমিত প্রতিকৃতি প্রায়-অভিন্ন।
২. বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও মনোজাগতিক বিবর্তন
ডঃ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব’ নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থে বাঙালির যে আদি পরিচয় উপস্থাপন করেছেন, তা একদিকে যেমন ইতিহাস-সম্মত, অন্যদিকে তেমনি নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত। তাঁর মতে, রাজমহল পাহাড়ের অধিবাসী মালেরা সম্প্রদায়ই বাঙালির আদি বংশধর তথা আদি বাঙালি। ছোটখাট চেহারার এই কালো মানুষগুলো দেখতে সিংহলের ভেড্ডাদের মতো। তাই এদের নৃতাত্ত্বিক নাম ভেড্ডিড। ভাষাগত দিক থেকে এরা দ্রাবিড় ভাষাভাষী।
কিন্তু, ঐতিহাসিক ঘাত-প্রতিঘাতের কারণেই এই দ্রাবিড়-ভাষাভাষী ভেড্ডিড সম্প্রদায়ের স্থান, চেহারা ও ভাষা তথা সামগ্রিক পরিস্থিতি এক জায়গায় স্থির থাকেনি। ডঃ রায় যথার্থই লক্ষ্য করেছেন, এদের পাশাপাশি এদেশে ‘মঙ্গলপ্রতিম জনধারা’ এবং ‘ইন্দোআর্য দীর্ঘমুন্ড ধারা’ সেই আদি যুগেই (আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে) প্রথমোক্ত জনধারার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে। ফলে সেই ভেড্ডাপ্রতিম জনসাধারণ বিচিত্র মেলামেশার ফলে পাঁচমিশালী জাত হয়েও কালক্রমে একটা নিজস্ব গঠনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ফলে বেশির ভাগ বাঙালির চেহারাই মাঝারি গোছের, মাথার গঠন লম্বাও নয়, গোলও নয়, নাক লম্বাও নয়, চ্যাপ্টাও নয়, মাথায় লম্বাও নয় বেঁটেও নয়। এই মাঝারি গোছের চেহারাকেই বলা যায় মার্কামারা বাঙালির চেহারা। ডঃ রায় আরো লক্ষ্য করেছেন যে, বাংলাদেশের বুকে বিভিন্ন জাতির রক্তমিশ্রণের এই ধারা প্রাগৈতিহাসিক যুগ পেরিয়ে ঐতিহাসিক কালের প্রাচীন বাংলায়ও সমানে বয়ে চলল। সে-ধারা আজো থামেনি। আজো নানান জলের নানান রক্তধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছে। এসেছে মালব, চোড়, খস, হূণ, কুলিক, কর্ণাট, লাট, যবন, কম্বোজ, খর, দেবলা বা শাকদ্বীপী। এসেছে উন্নত নাসা, গৌরবর্ণ, দীর্ঘ দেহ আর্যনরগোষ্ঠি। তবু বাঙালির সেই আদি চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এমনকি, তুর্কী বিজয়, নোয়াখালী চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরবী মুসলমানদের আগমন, হাবসী সুলতানদের রাজত্ব এবং বাংলার উপকূলবর্তী জেলাসমূহে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে জলদস্যুদের এন্তার উৎপাতের পরেও বাঙালি একটি শংকর জাতিতে পরিণত হলেও সাধারণভাবে তার আদি চেহারার খুব একটা হেরফের হয়নি।
কিন্তু আদি বাঙালির ধ্যানধারণা? তার সংস্কৃতি? না, আদি বাঙালির সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণাও কালের প্রবাহে সম্যকভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। এদেশে যতই নরগোষ্ঠী এসেছে, এসেছে যতই শাসকগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়, ততই এদেশের মানুষের জীবন-দর্শন, উপচার ও ধ্যানধারণা নতুনভাবে গড়ে উঠেছে। আর্যপূর্ব যুগে এদেশে গ্রামদেবতা, ধ্বজাপূজা, যাত্রা, ব্রত, চড়ক, ধর্মঠাকুর, হোলী, অম্বুবাচী, মনসাপূজা, জাঙ্গুলী, পর্ণশবরী, শারদোৎসব, ষষ্ঠীপূজা প্রভৃতির প্রচলন ছিলো। গুপ্তপর্বে, খৃস্টে জন্মের প্রায় দেড়শ বৎসর আগে ভূমধ্যীয় যন্ত্রণা, মধ্য এশীয় শক-কুষাণদের ঢেউ এসে লাগে এদেশে। খৃস্ট্রীয় প্রথম শতকে ঘটে আরবীয় বাণিজ্যিক যোগাযোগ। এ সময় পূর্বোক্ত আচার-উপচারের সঙ্গে যুক্ত হলো বৈদিক ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম, সৌরধর্ম, জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম। পাল-চন্দ্র পর্বে বিকশিত হলো বৌদ্ধ ধর্ম। সেনবর্মণদের পর্বে বৈদিক পৌরাণিক, বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত ও সৌর ধর্মের প্রাধান্য ঘটলো। ভাটা পড়লো বৌদ্ধ ধর্মে। আর সেনবর্মণদের পতের সঙ্গে সঙ্গেই এ দেশে আবির্ভাব ঘটেছে মুসলমান বিজেতাদের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ডঃ রায় এদেশের বুকে শাসক হিসেবে গুপ্ত, পাল-চন্দ্র, সেন-বর্মণ প্রভৃতি রাজবংশকে সহজভাবে মেনে নিলেও মুসলমান বিজেতাদের আবির্ভাবকে সহজভাবে মেনে নেননি। ত্রয়োদশ শতকের পর বাংলাদেশের কোথাও আর স্বাধীন হিন্দুনরপতির নাম শোনা যায় না। তিনি যদিও স্বীকার করেছেন যে, এ দেশে বৈদেশিক মুসলিম রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা মোটেই একটি আকস্মিক ঘটনা নয়, কার্যকারণের অনিবার্য শৃঙ্খলে বাঁধা, তবু তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘সেদিন সময় বয়ে যেতে দিয়ে যে বিপ্লবের সুযোগ আমরা হারিয়েছি তার দাম আজও আমরা দিয়ে চলেছি’। গুপ্ত পালচন্দ্র, সেন-বর্মণ প্রভৃতি শাসক সম্প্রদায় এদেশ থেকে উদ্ভূত আর মুসলমানদের আগমন বিদেশ থেকে। শুধু কি এ কারণেই এই আক্ষেপ?
কিন্তু শুধু আক্ষেপ করে ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। এবং ডঃ রায়ও তা করেন নি। আধুনিক বাঙালির মানস-বিবর্তন তথা আচার-অনুষ্ঠানের বিবর্তনে শেষোক্ত বৈদেশিক মুসলমানদের আগমন যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে, তা আজ সর্বজনবিদিত। আদি বাঙালির মানস-বিবর্তনে যেমন এদেশে থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন রাজশক্তি ও রাজবাহিত ধর্মের প্রভাব পড়েছিলো, তেমনি বাঙালির পরিণত পর্বের মানস-বিবর্তনে মুসলমান সংস্কৃতি ও ইসলাম ধর্মের প্রভাব প্রধানভাবেই বিদ্যমান। ডঃ রায় বিকশিত বাঙালির তথা আধুনিক বাঙালির ইতিহাস লেখেননি, তার মানস-বিবর্তনের ইতিহাসও নয়। আমাদের মতে, বৈদেশিক মুসলিম বলে যতই আক্ষেপ করা হোক না কেন, আসলে এদেশে মুসলমানী আচার-অনুষ্ঠান ও ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশের লগ্ন থেকেই আধুনিক বাঙালির ইতিহাসের শুরু। সময়টি অবশ্যই দ্বাদশ শতকের শেষাংশ।
বিকশিত বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালির মানস-বিবর্তনে, এ কারণেই, ইসলামী লোকাচার ও ধ্যান ধারণা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। আজ বাঙালির মানসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে যে একটি বিতর্ক আছে, তা এই সত্যটিকে অস্বীকার করার প্রবণতারই ফল মাত্র। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই অস্বীকার করার প্রবণতাটি উদ্ভূত। উগ্র মুসলমান যেমন বাঙালির মানস-ঐতিহ্য ও আদি বাঙালির সংস্কৃতিকে স্বীকার করে না, তেমনি উগ্র হিন্দুও পরিণত পর্বের বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করে বা করতে চায়।
তবে এই অস্বীকারের বিষয়টি নিষ্পত্তির দায়িত্ব হিন্দুদের উপর যতখানি বর্তায়, তার চেয়ে অনেক বেশি বর্তায় মুসলমানদের উপর। আশার কথা এই যে, পরিণত পর্বের বাঙালি সংস্কৃতিকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানরা পিছিয়ে নেই। আবদুল ওদুদ যথার্থই বলেন, ‘হিন্দু ঐতিহ্য মুসলিম ঐতিহ্য এ দুয়ের সংমিশ্রণের দায়িত্ব মুসলমানেরই, হিন্দুর নয়, কেননা হিন্দুর দুই উত্তরাধিকার নয়। মুসলমানের দুই উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকারের ব্যাপকতায় মুসলমান হিন্দুর চেয়ে বড়; মাতৃসম্পত্তি ও পিতৃসম্পত্তি উভয়েই ওয়ারিশ। মুসলমান যদি এই দুই সংস্কৃতিকে স্বীকার করে, তবে তার দ্বারা এক বড় সৃষ্টি সম্ভব। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মন্থনদণ্ডে মণ্ডিত করে সে দুই সংস্কৃতিকে এক বিরাট নবসংস্কৃতিতে পরিণত করতে পারে।’

৩. নবসংস্কৃতি ও নজরুল ইসলাম
নজরুল আবদুল ওদুদ বর্ণিত সেই নব-সংস্কৃতিরই কাব্যিক প্রবক্তা। এই নব-সংস্কৃতিকে আমরা আধুনিক বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। জীবনাচরণে ও সাহিত্য-চর্চায় তিনি এই বিরাট ও সংকটবহুল কাজটি সমাধা করেছেন। এই দুই সংস্কৃতির মিশ্রিত রূপই যে আধুনিক বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, নজরুলের আগে অন্য কোনো বাঙালি কবি এই সত্যটি সম্যক অনুধাবন করেননি, কিংবা করলেও তা তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়নি। একজন মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এমনটি হওয়া সম্ভব ছিলো না। কেননা মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁরা অতোটা পরিচিত নন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে তো এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে আলাওলের প্রচেষ্টাটি প্রসংগত উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আলাওল কতটা সচেতনভাবে এ কাজটি করেছিলেন, তা আজো প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা আলওলের জীবনাচরণে কিংবা তাঁর অপরাপর রচনায় এ প্রচেষ্টার ব্যাপক বা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ চোখে পড়ে না।
আসলে সাম্প্রদায়িক চেতনা অধিকাংশ মুসলমান লেখকের মানসিকতাকে আদ্যোপান্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর যাঁরা নিজেদের সাম্প্রদায়িক বিভ্রান্তির থেকে মুক্ত বলে ভাবে, তাঁরা আরো এক ধাপ এগিয়ে বাঙালিয়ানায় মুসলিম ঐতিহ্যকে সমূলে অস্বীকার করে গর্বে বুক ফুলান। এটি যেমন বেদনাবহ, তেমনি আত্মঘাতী। নজরুলকে নিয়ে, তাঁর ঐতিহ্যবোধ নিয়ে যে বিতর্ক, তা-ও একারণেই।
ঐতিহ্য কোনো একপেশে ব্যাপার নয়, ঐতিহ্য সামগ্রিক অর্থেই একটি ঐতিহাসিক বোধ (ঐরংঃড়ৎরপ ংবহংব)। (চলবে)
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক; মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি

পূর্ববর্তী নিবন্ধই-সময় আর ই-প্রতারণা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনায় আরও ১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৩৬