চট্টগ্রামই জাতীয় অর্থনৈতিক সৌধের মূল ভিত্তিভূমি

ড. অনুপম সেন | রবিবার , ১০ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ


ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বের প্রসিদ্ধতম বন্দরগুলোর একটি ছিল চট্টগ্রাম। বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম বহু প্রাচীন। সম্ভবত খ্রিস্ট-পূর্ব ৪০০ বছর আগেও চট্টগ্রামকে সমুদ্রযাত্রার জন্য বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নবম শতকে আরব বণিকরা এ উপমহাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করেছেন। মার্কো পোলো ও ইবনে বতুতা দুজনই বিশ্ব পরিভ্রমণের পথে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিলেন।
ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে আসন পেতে বসে। তারা চট্টগ্রামকে বলত পোর্টো গ্রান্ডো বা বড় বন্দর আর হুগলীকে বলত পোর্টো পিকুইনো বা ছোট বন্দর। চট্টগ্রাম পর্তুগিজদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে তাদের প্রসিদ্ধ মহাকাব্য লুসিয়াদ-এ, যে মহাকাব্যের প্রধান নায়ক ভাস্কো দা গামা, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের উল্লেখ রয়েছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে চট্টগ্রামেই তৈরি হতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জন্য বৃহৎ সব রণতরী ও নৌযান (উল্লেখ্য, তখনো বাষ্পচালিত ও ইস্পাতের তৈরি নৌযান আবিষ্কৃত হয়নি)।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় কলকাতাই হয়ে উঠেছিল পুরো বাংলার সর্ববৃহৎ এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক পর্যন্ত ভারতেরও বৃহত্তম বন্দর। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব কিছুটা ম্লান হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই, তবুও চট্টগ্রামের গুরুত্ব একেবারে কম ছিল না। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর যে জায়গায় অবস্থিত তা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১৮৮৭ সালে) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে বন্দরের অবস্থান ছিল কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে সমুদ্র তীরবর্তী দেয়াঙে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে সর্বমোট পাঁচ লাখ টন পণ্য খালাসের ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি জেটি ছিল। বর্তমানে জেটির সংখ্যা ৫১ আর মোট পণ্য খালাসের ক্ষমতা দুই কোটি আশি লাখ টন। বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সাল থেকে চট্টগ্রামই বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর। পাকিস্তান আমলে মোংলা বন্দর গড়ে তোলা হলেও বন্দরটি জাতীয় অর্থনীতিতে, দেশের আমদানি-রপ্তানিতে যে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়েছিল, তা করতে সমর্থ হয়নি। বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যের প্রায় ৮৫ ভাগ এবং রপ্তানি বাণিজ্যের ৮০ ভাগই পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। কাজেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব যে কী অসীম তা ব্যাখ্যা করা বাহুল্য মাত্র। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৮.৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্যই রপ্তানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এ রপ্তানি সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে প্রধানত তৈরি পোশাক (ওভেন গার্মেন্টস ও নিটঅয়্যার সামগ্রী), হিমায়িত মৎস্য, চামড়া ও চর্মজাত পণ্য, কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য ইত্যাদি। একই সময় দেশে মোট আমদানি হয়েছে ১৩.১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী। এ আমদানি পণ্যের ৮৫ শতাংশ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এই যে বিপুল আমদানি ও রপ্তানি কারবার, তাতে চট্টগ্রাম কেবলমাত্র মুখ্য ভূমিকাই পালন করেনি, বাংলাদেশের রাজস্ব আয়েরও এক বিরাট অংশ এসেছে এ আমদানি ও রপ্তানির ওপর আরোপিত বিভিন্ন শুল্ক ও কর থেকে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে এই খাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের মাধ্যমে আহরিত রাজস্ব আয় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই খাতে গত পাঁচ বছরের আহরিত রাজস্বের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়াও বন্দরের আয় থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত এক দশকে সরকারি কোষাগারে (কর ব্যতিরেকে) দিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বন্দরের তহবিলে জমা রয়েছে। তাই এটা অতিশয়োক্তি নয় যে, জাতীয় অর্থনীতিকে দেহ হিসেবে কল্পনা করলে চট্টগ্রাম তার হৃৎপিণ্ড। এখান থেকেই অর্থনীতির দেহের শিরা-উপশিরায় রক্ত, প্রাণপ্রবাহ বা জীবনীশক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম কেবলমাত্র বন্দর নয়, চট্টগ্রামই দেশের প্রধানতম শিল্প কেন্দ্র, চট্টগ্রামেই রয়েছে দেশের কয়েকটি মুখ্য শিল্প কারখানা। দেশের একমাত্র জ্বালানি শোধনাগারটি চট্টগ্রামেই অবস্থিত। এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম দুটি সার কারখানার (চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা ও কাফকোর) অবস্থানও চট্টগ্রামে। জাতীয় অর্থনীতিতে সার কারখানা দুটির অবদান যে অসামান্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চট্টগ্রামেই ছিল দেশের একমাত্র বৃহৎ ইস্পাত শিল্পের কারখানাটি। এই কারখানা ধ্বংস হয়েছে রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত অযত্ন-অবহেলায়। কারখানাটি বন্ধ করে দেয়ার সময় অজুহাত দেখানো হয় যে, এটি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যা আসলে ছিল গভীর এক চক্রান্ত। এই ইস্পাত কারখানাটির ব্যবহার্য কাঁচামাল আমদানির সময় আমদানি-শুল্ক ও কর বাবদ আদায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে যে পরিমাণ শুল্ক ও কর রাষ্ট্র আহরণ করত, তা থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে যদি কিছুটা রেয়াত বা রেহাই দেয়া হতো, তাহলে সেটি আজো সগৌরবে টিকে থেকে আমাদের ইমারত, নির্মাণশিল্প ও গৃহস্থালি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উন্নত, উৎকৃষ্ট ইস্পাতের চাহিদা মেটাতে পারত। আজ যখন বিশ্বজুড়ে নানাভাবে ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠছে এবং ইস্পাতের চাহিদাও ক্রমবর্ধমান, আমরা তখন আমাদের একমাত্র ইস্পাত কারখানাটিকে কেবলমাত্র দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছি। একই বক্তব্য প্রযোজ্য পতেঙ্গায় অবস্থিত জিএম প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরিটি সম্পর্কেও।
ইস্পাত কারখানা ধ্বংসের পর আমাদের ক্রমবর্ধমান ইস্পাত ও লোহার চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রামের সমুদ্র-বেলাভূমিতে এক নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে যেটির নাম জাহাজভাঙা শিল্প। এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই যে, চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ক্ষেত্রটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ বেলাভূমি-বিস্তৃত জাহাজভাঙা শিল্প। জাহাজভাঙা লোহাই আমাদের জাতীয় চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ মেটাচ্ছে। এ ছাড়া এই খাত থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই শিল্পে প্রায় ২৫ হাজার লোক সরাসরি নিয়োজিত আর ভাঙা জাহাজ থেকে পাওয়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর, বয়লার, ইলেক্ট্রনিঙ পণ্য, দামি আসবাব ও তৈজসপত্র ইত্যাদি বেচাকেনা মেরামতসহ নানা কাজে আরো লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
জাহাজভাঙা শিল্পের কথায় আসি। জাহাজ থেকে কোন্‌ প্রকৃতির কী পরিমাণ বর্জ্য- আমাদের বেলাভূমিতে ও সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা জানা যায় না। অন্যান্য দেশে জাহাজভাঙা শিল্প যেখানে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, আমাদের দেশে এ শিল্পে সে ধরনের কোনো শৃঙ্খলাই দেখা যায় না। মাঝে মাঝে পত্রিকার খবরের বরাতে এই শিল্পের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রচণ্ডভাবে দূষিত ও বিঘ্নিত হওয়ার দু’একটি সংবাদ আমাদের চরমভাবে উৎকণ্ঠিত ও উদ্বেগাকুল করে কিন্তু সরকার এখনো প্রতিকারের তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এই শিল্প আমাদের সমুদ্র ও তার তীরবর্তী এলাকার অধিবাসীদের বিরাট ক্ষতি যেন না করে সে জন্য অবিলম্বে যৌক্তিক, সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আইন প্রণয় ও প্রয়োগ প্রয়োজন।
জাতীয় অর্থনীতিতে বর্তমানে গার্মেন্টসের এক বড় ভূমিকা যে রয়েছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এই খাতে প্রায় বিশ লাখ নারী শ্রমিক কর্মরত। গার্মেন্টস শিল্পের এক বিরাট অংশ চট্টগ্রামে অবস্থিত। শুধু ইপিজেডেই বেশ কয়েকটি বড় গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। কিন্তু এ শিল্পকেও যথাযথ যত্নের সঙ্গে পরিপোষণ করা হচ্ছে না।
চট্টগ্রামে অন্যান্য কয়েকটি শিল্পেরও বিকাশ ও কেন্দ্রীভবন হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিমেন্ট, ভোজ্য তেল, প্লাস্টিক, ঢেউটিন, রি-রোলিং মিল, পাটনির্ভর শিল্প ও কাচশিল্প। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এদের অবদান বিরাট না হলেও খুব কম নয়। (এসব শিল্প প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও এখনো প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে একটি ঝুঁকি-গ্রহণকারী, জাতীয় বুর্জোয়া-শ্রেণি বা পুঁজিপতি-শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। এসব শিল্পও নানা সমস্যায় জর্জরিত। শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু শিল্পকে সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের অভাবের ফলে অনেকেই ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছেন)। এই শিল্পগুলোর অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর প্রান্ত থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড় ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী যে সরু সমতলভূমি রয়েছে, তার মধ্যে। এসব শিল্পকারখানার বর্জ্যও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাল বিল দিয়ে সমুদ্রে পড়ছে। এ ব্যাপারেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও রাষ্ট্র উদাসীন বলেই মনে হয়।
এটা সর্বজনবিদিত যে, চট্টগ্রাম এ উপমহাদেশের একটা অপূর্ব সুন্দর অঞ্চল। এখানে অরণ্য-আচ্ছাদিত-পাহাড়, সমুদ্র ও নয়নাভিরাম বিভিন্ন খরগ্রোতা নদী রয়েছে। প্রকৃতির অপূর্ব ও অকৃপণ এসব দান আজ মানুষের আঘাতে বিপন্ন। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় বাংলাদেশে মোট বনাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল ২২ শতাংশ, আজ তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ শতাংশে। বনের অধিকাংশই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে। যাদের এ বনজসম্পদ রক্ষার দায়িত্ব, সেই বন-সংরক্ষকরা এবং প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন লোকের লোভ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বনভূমির এক বিশাল অংশ উজাড় করে ফেলছে। এর পরিণামে শুধু যে বনজসম্পদই ধ্বংস হয়েছে তা নয়, বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগেও চট্টগ্রাম ছিল প্রকৃতির কোলে এক রম্য নগরী। পুরো শহর ও এর প্রান্তরজুড়ে ছিল অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়। ভূমিদস্যুদের আক্রমণে এদের প্রায়ই আজ নিশ্চিহ্ন। সেখানে অপরিকল্পিতভাবে দালানকোঠা গড়ে তোলা হয়েছে। আজ নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক যে পথ ছিল, পাহাড় কাটার ফলে বৃষ্টিবাহিত সঞ্চিত বালি সে পথ করেছে রুদ্ধ। ফলে সামান্য বর্ষণেও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে এবং আবদ্ধ এ জল (যা কেবল বৃষ্টির নয়, সঙ্গে থাকে ত্রুটিযুক্ত স্যুয়ারেজ লাইন-নিঃসৃত বর্জ্য) সহজে সরতে পারে না, যে কারণে জনপদ ও লোকালয় থাকে দীর্ঘক্ষণ জলাবদ্ধ। মানুষ সৃষ্ট এসব বিভিন্ন ত্রুটি ও সমস্যা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম আজো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরী।
এই নগরীর ভৌত কাঠামোর অনেক অসুবিধাই রয়েছে। ক্রমবর্ধমান নগরবাসীর জলের চাহিদা মেটাতে ওয়াসা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই শহরে বহু পুকুর-দিঘি ও মাঠ ছিল। পুকুরগুলোর প্রায় সবগুলো ভরিয়ে ফেলা হয়েছে বাড়িঘর নির্মাণের জন্য। এখন সেগুলোর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। আশকার খাঁর দিঘি ও লালদিঘিসহ অন্য দিঘিগুলো আর নেই। শহরে অসংখ্য খেলার মাঠ ছিল। যেগুলোর প্রায় সবই সরকারি-বেসরকারি সৌধ নির্মাণের কারণে বিলীন হয়েছে দালানকোঠার নিচে। পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামে অনেকগুলো স্কুল-কলেজ গড়ে তোলা হয়েছে কিন্তু শিক্ষার একটা অপরিহার্য অংশ যে খেলাধুলা সে বোধ আমাদের বিদ্যোৎসাহী বিদ্বজ্জনের মধ্যে রয়েছে বলে মনে হয় না। মাঠের অভাবে শিশু-কিশোর ও নবীন যুবকরা খেলাধুলার সুযোগ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে নানা ধরনের চিত্তদৈন্য, একঘেয়েমি, আলস্য ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের নবীন প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনে দালান-ইমারত ভেঙে বহু মাঠ তৈরি করতে হবে।
চট্টগ্রাম শহরের প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী নদী এককালে চট্টগ্রামের নাগরিকদের সকাল ও সান্ধ্য ভ্রমণের জায়গা ছিল। শহরবাসীর উল্লেখযোগ্য অংশ এর তীরে নিয়মিত বেড়াতে যেত। আজ আর তার কোনো পথ বা অবকাশ নেই। কর্ণফুলীর পুরো তীরই বিলুপ্ত বিভিন্ন স্থাপনার আড়ালে যা কখনোই হওয়া উচিত ছিল না। এর পুরো তীরজুড়ে, বিশেষত সদরঘাট ব্রিজ থেকে আগ্রাবাদের মোড় পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর পুরো উত্তর তীরে পার্ক বিনির্মাণ করলে জনগণ সকালে ও বিকালে কিছুটা সময় এই তীরে বসে নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশুদ্ধ হাওয়ার স্পর্শে স্নিগ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে। এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএ’র দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কর্ণফুলী কেবলমাত্র শহরবাসীর নয়, এই নদী সারাদেশের প্রাণপ্রবাহী, কারণ এর ওপরই প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বন্দর। এ নদীর প্রবাহকে যে কোনো মূল্যে বহমান রাখতে হবে। কারণ এর ওপরই জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি, এর ওপরই নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরের অস্তিত্ব। কর্ণফুলীর দক্ষিণে বিশাল জনপদের সঙ্গে দেশের যোগসূত্র রাখার জন্য এর ওপর একটি বড় সেতু নির্মাণের দাবি সমগ্র চট্টগ্রামবাসীর। সেতুটি অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। সরকার কয়েকবার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে, বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। সরকারের শেষ সময়ে মাত্র তিন মাস সময় হাতে রেখে টেন্ডার দিয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সেতুটির একটি ব্লু প্রিন্ট বা রূপরেখা দেয়া হয়েছে যাতে দেখা যায় সেতুটি মূলত স্তম্ভনির্ভর। বিশ্বের যেখানে যে সমস্ত নদীর ওপর অর্থনীতির প্রবহমানতা কিছুটা হলেও নির্ভরশীল, সেসব নদীর নাব্যতা, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ প্রবহমানতা নিরুদ্ধ রাখার জন্য স্তম্ভহীন সেতু নির্মাণই কাম্য। এর জন্য কোনো মূল্যই বেশি মূল্য নয়। আমরা এ পর্যন্ত যে আলোচনা করেছি, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, চট্টগ্রামই জাতীয় অর্থনৈতিক সৌধের মূল ভিত্তিভূমি। এই ভিত্তিভূমি রক্ষা পেলেই উপরি সৌধ রক্ষা পাবে, তার বর্ধিতকরণ সম্ভব হবে। সুতরাং আজ ভাবতে হবে চট্টগ্রামের সমাজ, অর্থনীতি ও নাগরিক জীবন যেসব সমস্যায় জীর্ণ ও দীর্ণ, তা থেকে উত্তরণের পথগুলো কী? জাতীয় অর্থনীতির প্রবাহ সচল রাখতে হলে চট্টগ্রামের অনিরুদ্ধ বিকাশের কোনো বিকল্প নেই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভারতবর্ষে রেললাইন স্থাপন করা হয়। রেলওয়ে পুরো উপমহাদেশকে একটি একক সত্তাবিশিষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাহায্য করেছিল। রেলপথ স্থাপনের ফলে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে বিরাট উন্নয়ন ঘটে তাকে প্রায় বিপ্লবই বলা চলে। পুরো ভারতে বিশেষভাবে বাংলা, আসাম ও বিহারে রেলওয়ের দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল। মনে রাখা প্রয়োজন ১৯১১ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশের রাজধানী ছিল কলকাতা। কলকাতা কেবলমাত্র ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীই ছিল না, এটি ছিল উপমহাদেশের প্রধান বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র। পূর্ব-ভারতের রেল ব্যবস্থা, যা আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে নামে পরিচিত ছিল, এক সময় তার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল চট্টগ্রামে। আমাদের শৈশবে ও কৈশোরে দেখেছি, চট্টগ্রাম শহরের উত্তর পশ্চিমাংশের অধিকাংশ জমিই রেলওয়ে-স্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। পুরো পাহাড়তলী ও তার আশপাশের সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চল রেলওয়ের জমি বলে চিহ্নিত ছিল। এখানে ছিল লাল-সুরকির রঙের অপূর্ব সব নয়নাভিরাম রেলওয়ের অট্টালিকা, পাহাড়ের উপরে অবস্থিত বাংলো এবং ছায়াচ্ছন্ন নগর বা নগরবীথি। পাকিস্তান আমলেও পূর্ব পাকিস্তানের রেলওয়ের প্রধান কেন্দ্র বা সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। বস্তুত আশির দশক পর্যন্ত রেলকেন্দ্রিক সব কিছু নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতো চট্টগ্রাম থেকে। রেলওয়ের প্রধান কারখানাটিও ছিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে। এখনো তা আছে কিন্তু প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থায়। সারা বাংলাদেশেই রেলওয়ে যেভাবে ধুঁকছে, রেলওয়েকে যেভাবে অবহেলা করা হচ্ছে, তার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়ের যে বিরাট অবদান ছিল, সেখানে চট্টগ্রাম যে মুখ্য ভূমিকা পালন করত, তার যেন অবসান হয়েছে। আজো বিশ্বজুড়ে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম রেলওয়েই; জলপথের পর রেলপথই সবচেয়ে কম ব্যয়সাধ্য পরিবহন মাধ্যম। আমাদের দেশে কেন যে পাকিস্তান আমল থেকে সহজ ও সস্তা এই যোগাযোগ মাধ্যমটাকে এমনভাবে অবহেলা করা হলো তার যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বোঝা যায়, পাকিস্তান যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে গণ্য করত, পূর্ব পাকিস্তানে রেলওয়ের শ্রীবৃদ্ধি তাই সেখানকার শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ কাম্য বা অগ্রাধিকারভুক্ত ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে রেলওয়ের প্রতি উপেক্ষার কারণ দুর্বোধ্য।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের কেন্দ্রভূমি। রেলের প্রসার সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন যা প্রয়োজন তা হলো তার আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করা। চট্টগ্রাম এখনো রেলওয়ের হেড কোয়ার্টার হলেও রেলের সব কাজই ইতোমধ্যে রাজধানীতে অবস্থিত রেলভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রাম এখন নামমাত্র রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার। রেলওয়ের সব কাজ ঢাকা-কেন্দ্রিক হওয়ায় কেবলমাত্র সিআরবি ভবনই হতশ্রী হয়নি, রেলওয়ের অপরাপর দৃষ্টিনন্দন ও প্রকৃতি-সখা স্থাপনাগুলো এক সময় যেভাবে চট্টগ্রাম শহরকে অলঙ্কৃত করত এখন আর তা করে না। এই অঞ্চলটি এখন ধীরে ধীরে রুক্ষ জায়গায় পরিণত হচ্ছে। এর দিকে দৃষ্টি দেয়ার অবকাশ যেন রেল কর্তৃপক্ষের নেই। উপরন্তু রেলওয়ের বহু জমি নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করে সেসব জায়গায় বিদ্যমান স্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কুৎসিত সব বাণিজ্যিক ইমারত গড়ে তোলা হচ্ছে। এমনকি অনেক বস্তিও গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম শহরের ওপর এত সব আঘাত সত্ত্বেও এখনো চট্টগ্রামই বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব শহর। ঢাকা ও অন্যান্য শহর থেকে যারা চট্টগ্রাম আসেন তারা চট্টগ্রামের পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন রাস্তার পাশে ও মধ্যভাগে রোপিত বৃক্ষরাজি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন, চট্টগ্রাম এখনো বাসযোগ্য রয়েছে। চট্টগ্রামের প্রতি যথাযথ নজর দেয়া না হলে এক দশক পরে এ শহরও আর বাসযোগ্য থাকবে না।
আমাদের দেশে বড় বড় নগরগুলোর দুর্ভাগ্য হলো এসব নগরের প্রশাসন ত্রিধাবিভক্ত। প্রতিটি নগরে রয়েছেন নির্বাচিত মেয়র ও কমিশনার। কিন্তু নগরবাসীর নির্বাচিত এ প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট নগরের সার্বিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন না। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট প্রভৃতি নগর বা শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসনের দায়িত্ব সেখানকার পুলিশ কমিশনারের। এ ছাড়া সিভিল প্রশাসনের দায়িত্বে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছে নগর উন্নয়ন সংস্থা যেমন সিডিএ, কেডিএ, রাজউক। এসব সংস্থার কার্যক্রমে কোনো সমন্বয় না থাকায় কেবলমাত্র নগর পরিচালনার ক্ষেত্রেই যে নানারকম সমস্যার উদ্ভব ঘটে তা নয়, নগরের জরুরি পরিবেশ খাত যেমন পিডিবি, ওয়াসা, টিএন্ডটি এদের কর্মকাণ্ডের মধ্যেও বিরাট সমন্বয়হীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রকাশ ঘটে। তার ফলে নগরবাসী কেবল প্রত্যাশিত সেবা থেকেই বঞ্চিত হয় না, তাদের জীবনেও নেমে আসে অপরিসীম দুর্ভোগ। এর প্রতিকারের একমাত্র উপায়, দেশের প্রধান প্রধান নগরগুলোতে ইউরোপ ও আমেরিকার ধাঁচে সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে নগরের সার্বিক প্রশাসনের দায়িত্বে থাকবেন সিটি মেয়র। তার ওপরেই ন্যস্ত থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে আরম্ভ করে জরুরি পরিসেবা নিশ্চিত করা ও নাগরিক জীবনের সার্বিক প্রয়োজন মেটানোর ভার। পরিসেবা প্রদানকারী সব প্রতিষ্ঠানকে তিনিই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবেন। এদের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধনের ভারও তার ওপরই ন্যস্ত থাকবে। আমাদের দেশে অনেকেই হয়তো জানেন না, নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, বার্লিন, আমস্টারডাম, লন্ডন প্রভৃতি শহরের প্রধান ব্যক্তি ও প্রশাসক মেয়র। তিনিই নগরের প্রথম নাগরিক এবং নগরবাসীর সার্বিক কল্যাণের দায়িত্ব তারই। নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব সুবিধা-সেবার জন্য দায়ী তিনি এবং তার কাউন্সিলর, কমিশনার ও এল্ডারম্যানরা। চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বড় নগরগুলোতে মেয়রের নেতৃত্বে এ রকম স্বায়ত্তশাসিত নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করলেই নগরের সুষম সমন্বিত ও সুষ্ঠু উন্নয়ন সম্ভব, যেখানে ব্যক্তি তার নাগরিকত্বকে সার্বিক পূর্ণতা দেয়ার অবকাঠামোতে সব সুযোগ পাবে।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী; উপাচার্য, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিখুঁত-চিন্তক আবুল ফজল
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যুবকের মৃত্যু