হাজার মন্দিরের প্রত্নতাত্ত্বিক বাগানে

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১ জানুয়ারি, ২০২২ at ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ

ইরাবতী নদীতীরের ‘বাগান’ নামক প্রাচীন নগরীর উদ্দেশ্যে আমার আর জাপানী ভ্রমণকারী মিকার যাত্রা শুরু হলো। বাস কাউন্টার থেকে সকালে দেয়া কাগজের টুকরো টোকেন সাথে নিয়ে রওনা দিলাম বাস ধরার জন্য। মনের ভেতরে শঙ্কা, যদি এই কাগজের টোকেন নকল হয়, তাহলে রেঙ্গুনে আটকে থাকতে হবে আগামী কয়দিন। বাস কাউন্টারে গিয়ে হাজির হতেই শঙ্কা কেটে গেল। অনেক যাত্রী এসে হাজির হয়েছে। টোকেন জমা দিয়ে এবার আসল টিকেট হাতে পেলাম। বেশীরভাগ যাত্রীই স্থানীয় মানুষ পরিবারের সাথে নববর্ষের উৎসবে যোগ দিতে বাড়ি যাচ্ছে। আমি আর মিকা ছাড়া দু’জন পশ্চিমা ভ্রমণকারীও ছিল। রেঙ্গুনে বিদেশি মানুষের জন্য সুবিধার হলো বেশিরভাগ মানুষ এখানে ইংরেজিতে কম- বেশি যোগাযোগ করতে পারে। ইংরেজ জাতি হল আমাদের পরের ধনে পোদ্দারি করা জাতি আর চোরের মায়ের যেমন গলা উঁচু তেমনি তাদেরও। এরা দুনিয়া ঘুরে চুরি করে, ডাকাতি করে মানুষের ধন-সম্পদ নিজের দেশে নিয়ে গেছে, এরা এমনই নির্লজ্জ চোরের জাতি যে চুরি করা রত্ন মুকুটে বসিয়ে এরা আবার সারা দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে বেড়ায়। এরা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি চাপিয়ে বেড়িয়েছি অধীনস্থ সকল জাতির উপর। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটাই ইতিবাচক দিক হল, বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে ভাষাগত যোগাযোগের একটি সেতু তৈরি হয়েছে। ইরাবতী নদীতীরের যে অঞ্চলে যাচ্ছি, সেখানেও ইংরেজদের একটি ফাঁড়ি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান বাহিনী লড়েছিল জাপানী বাহিনীর সাথে। টেকনাফ শহরের ঢোকার মুখেই পাহাড়ে এখনও সেই যুদ্ধকালীন সময়ে নিক্ষেপিত বোমার ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। যে অঞ্চলে জাপানীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পরাজিত হয়েছিল, সেই অঞ্চলে বেড়াতে যাচ্ছি এক জাপানী মেয়ের সাথে।
বাসে উঠে বসতেই আমরা দু’জনই খুব আনন্দিত এবং উত্তেজিত হলাম। এসি বাস, সিট খুব আরামের এবং বেশ বড়সড়, সাথে আবার একদম ধুয়ে প্যাকেট করা কম্বল, পানি এবং বিস্কুটের প্যাকেট। যে টাকায় টিকেট কিনেছিলাম এই উৎসবের আকালের দিনে, তাতে কোনরকম একটা বাস আশা করেছিলাম। মিকা উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো জাপানে এই বাসের টিকেটের অনেক দাম হত, এত ভাল ব্যবস্থা বিশ্বাসই করতে পারছে না। বাস চলতে চলতেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। চাকরি এবং ব্যাক্তিগত কারণে অনেক বেশি জার্নি করতে হয় বলে গাড়িতে ঘুমানোর অভ্যাস বেশ ভাল রপ্ত করেছি। মাঝ রাতে গাড়ি বিরতি দিল। বেশ রমরমা বাজারমতো জায়গা। সারিবদ্ধ সব খাবারের দোকান, তার সামনের খোলা জায়গায় বসবার ব্যবস্থা। আবার কোন কোন খাবার বিক্রেতা খোলা জায়গাতেই দাউদাউ আগুনে রান্না করছে। আবার খাবার ছাড়া টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করছে কেউ কেউ। থাইল্যান্ডের বিরতিস্থানে টয়লেট খুব ভাল হয়। এখানে কেমন হবে বুঝতে পারছিলাম না বলে আমি বা মিকা কেউই টয়লেটে যেতে সাহস করছিলাম না। আমাদের বাসের এক মেয়েকে টয়লেট পরিষ্কার কিনা জিজ্ঞেস করাতে জানালো নির্ভয়ে ব্যবহার করতে পারব। আসলেই বেশ পরিষ্কার। এরপর আমি আর মিকা এটা সেটা খেলাম।
আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই ‘বাগান’ হল মান্দালয় অঞ্চলের প্রাচীন বার্মার প্রথম রাজধানী শহর যার নাম ছিল ‘পাগান’। চীনের ইউন্নান অঞ্চল থেকে বামার বা বারমানরা এসে ইরাবতী উপত্যকার এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। তারপর তাদের সংস্কৃতিকে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিতে থাকে এবং বার্মার প্রায় দেড়শ’র কাছাকাছি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বামারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। ধারণা করা হয় অষ্টম শতকের মাঝামাঝি ৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাগান শহরের গোড়াপত্তন করে বামাররা, যাদের শাসনকাল অটুট থাকে বারশ শতকের শেষে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে মঙ্গলীয়রা দখল নেবার আগ পর্যন্ত। এটি বার্মার প্রথম রাজ্য যেটি বর্তমান বার্মার সকল অঞ্চলকে একীভূত করেছিল। এই একীভূতকরণ সম্ভব করেছিল সম্রাট আন্বারাতা এগারশ শতকে। তাঁকে ধরা হয় আধুনিক বার্মার জাতির পিতা। তার জন্যই কম্বোডিয়ার প্রভাবশালী খমের সাম্রাজ্য এই অঞ্চল দখলে নিতে পারেনি। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া তখন ছোডিয়ায় খমের সাম্রাজ্য। এই অঞ্চলে পাগান সাম্রাজ্যের ৪০০ বছরের শাসনামলে বিসর করেছিল থেরাবেদা বৌদ্ধ ধর্ম, পাগান হয়ে উঠেছিল শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে। ১০৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছিল প্রায় ১৩০০০ বৌদ্ধ মন্দির। সাত-আটশ বছর পরে নানা যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পার হয়ে এখনও সেখানে টিকে আছে প্রায় ২০০০ এর কিছু বেশি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আর আমরা যাচ্ছি কালের সাক্ষী সেইসব মন্দির দেখতে।
গন্তব্যের কাছাকাছি আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আস্তে-আস্তে করে বাইরে আলো ফুটছে। আমি আর মিকা মহা আগ্রহ নিয়ে চোখের মনি বের করে আধো অন্ধকারে দেখার চেষ্টা মন্দির দেখার। গুগলের ছবিতে যা দেখেছি তাতে মন্দির দেখার আগ্রহ দমিয়ে রাখা মুশকিল। ভোরের কুয়াশামাখা আলোতে অনেক দূরে আবছামত প্রথম মন্দির দেখতে পেয়ে আমরা উত্তেজিত হয়ে আপেক্ষা করলাম আরও মন্দির দেখার। ততক্ষণে আঁধার প্রায় কেটে গেছে। বাস আমাদের নামিয়ে দিল রাস্তার উপরে যেখান থেকে মূল শহর বেশ দূরে। আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম কোনও পাবলিক গাড়িতে করে যাব। স্বল্প বাজেটের ভ্রমণে পাবলিক গাড়ির কোনও বিকল্প নেই। এছাড়া পাবলিক গাড়িতে স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ হয় এবং তাদের সম্পর্কে একটা ধারণাও তৈরি হয়। কিন্তু, এত ভোরে কোনও পাবলিক গাড়ি ছিল না। এদিকে ট্যাক্সির ভাড়া শুনে মাথা খারাপ অবস্থা। সব ট্যাক্সিই অনেক ভাড়া হাকাতে লাগল। ছ্যাঁচড়ার মতো অনেক দামাদামি করে ভয়ে-ভয়ে একটা ট্যাঙি ভাড়া করলাম হোস্টেল পর্যন্ত। অপরিচিত জায়গায় সে-দেশ হোক বা বিদেশ, ছ্যাঁচড়ার মতো ট্যাক্সি ভাড়া দামাদামি অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়। যদিও সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তারপরেও যেসব চালক সহজে কম ভাড়ায় রাজি হয়ে যায়, আমি তাদের এড়িয়ে চলি। আমার মনে হয় এদের খারাপ অভিপ্রায় থাকে বলেই এরা সহজে রাজি হয়ে যায়। বার্মা তো বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ারই প্রতিবেশী, তাই ভোররাতে দুজন মেয়ের ভয় পাওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। এখানে বড় অসুবিধা হল, মোবাইলের সিম কেনা বেশ ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার। তাই আমি বা মিকা কারোই সিম কেনা হয়নি। অচেনা জায়গায় গেলে গুগল ম্যাপ বা ম্যাপের মোবাইল অ্যাপ হলো পথের বন্ধু। সিম নাই বলে সব জায়গায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবো না জেনে অফলাইন এই অঞ্চলের একটা ম্যাপ গুগলে ডাউনলোড করে রেখেছিলাম। অফলাইনে ডাউনলোড করে রাখলে ইন্টারনেট ছাড়াও ম্যাপ দেখা যায়। গাড়িতে উঠেই আমি ম্যাপ খুলে বসলাম যাতে ড্রাইভার উল্টাপাল্টা জায়গায় নিয়ে যেতে না পারে। আমরা কোন হোস্টেলে উঠবো জানার পর ড্রাইভার হেসে আমাদের আরাম করে পথের দৃশ্যাবলী দেখতে বলল।
হোস্টেলে পৌঁছে অনেক ডাকাডাকি করার পর একজন বেরিয়ে এসে জানালো এখন আমরা ওদের অফিসে ব্যাগ রাখতে পারবো, কিন্তু বেলা বারোটায় রুম দেয়ার নিয়ম। আর রুম যদি আগে খালি হয়ে যায় তাহলে ঠিকঠাক করতেও ওদের সময় লাগবে। মিকা সাথে করে জাপানী ভাষার একটা ট্রাভেল গাইড নিয়ে এসেছে এবং গোঁড়া জাপানী চরিত্রের ধারক-বাহক এর প্রতিফলন স্বরূপ মিকা তার ট্রাভেল গাইডে যা যা দেখতে বলেছে সেইগুলা অবশ্যই দেখতে চায়। এর মধ্যে অন্যতম হল সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা। তাও আবার ২০০০ মন্দিরের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটা মন্দির থেকেই দেখতে হবে। আমি সবচেয়ে বেশি চাই স্থানীয় মানুষের সাথে মিশতে এবং অলিগলি ঘুরে দেখতে। এতে অবশ্য ওর কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু সাথে ওর গাইড বইয়ে উল্লেখ করা জায়গা গুলাও দেখতে হবে। আমরা ব্যাগ হোস্টেলে রেখে পাড়া বেড়াতে বের হয়ে গেলাম। পূব আকাশে আস্তে-আস্তে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে। কয়েকটি পোড়া মাটির মঠের দেখা পেতেই আমরা লাফালাফি শুরু করে দিলাম। স্থানীয় পথচারীরা ঘুরে-ঘুরে আমাদের দেখছিল। পাড়ার ঘরগুলো বাংলাদেশের মফস্বলের ঘরের মতোই। কিছু কিছু টিনের, কিছু কিছু ইটের। বেশীরভাগ বাড়ির সীমানা টিন দিয়ে ঘেরা। আর সেইসব বাড়ির আশেপাশেই প্রাচীন পোড়া মাটির মঠ এবং মন্দির। সারিবদ্ধ কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লাল গোল সূর্যটাকে দেখলাম একটা মঠের ঠিক চূড়ায় এসে স্থির হয়েছে। বাগানের প্রথম সকাল লম্বা ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করে দিল। স্থানীয় এক ফটোগ্রাফার বছরের শেষ সূর্যোদয়ের ছবি তুলছে।
ঘুরতে-ঘুরতে আমরা চলে এলাম স্থানীয় বাজারে। এই ভোরেই জমে উঠেছে বাজার। বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা প্রায় সবাই নারী। বাজারের সামনে খোলা জায়গায় স্থানীয় কুমার মাটির বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বসেছে। মাটির ছোট ছোট তিনটা ঘুঘু পাখির লেজের নিচে গোল ছিদ্র করা, ফুঁ দিলেই পাখির মতো ডেকে উঠছে। বিক্রেতা বুঝিয়ে দিল এগুলো হল মা-ঘুঘু পাখি, বাবা-ঘুঘু পাখি আর তাদের ছানা। ফুঁ দিলে মা-বাবা আর ছানা যার-যার সুরে বেজে উঠে। এক সেট কিনে ফেললাম দেশে ঘরের পিচ্চিদের জন্য। বাজারে বছরের শেষদিনের ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যগত রীতি পালনের জন্য নারকেল পাতা, নিম গাছের আর জাম গাছের ছোট ডাল একসাথে মুঠো হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এই দিনে বাংলা বছরের শেষদিনে বাঙালিরাও, বিশেষত বাঙালি হিন্দুরা ঘরে নিম গাছের পাতা ঝুলিয়ে রাখে পুরানো বছরের রোগ-জীবাণু দূর করে নতুন বছরের স্বাস্থ্যকর নিমের হাওয়ায় ঘর শুদ্ধ করবার জন্য। বার্মার প্রাচীন নগরের একবিংশ শতকের মানুষের সাথে বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহ্যগত সাদৃশ্য এক লহমায় মানুষগুলোকে কাছের করে ফেলল।
বাগানের আসল মন্দির এখনো দেখা বাকি। একটু বিশ্রাম নিয়েই বের হব বহু কাঙ্ক্ষিত মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা মন্দির দেখতে।
ইমেইল: ৎঁঢ়ংনফ@মসধরষ.পড়স <সধরষঃড়:ৎঁঢ়ংনফ@মসধরষ.পড়স>

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশ নারীবাদ চাই চর্চায় ও মননে
পরবর্তী নিবন্ধসদারঙ্গের দ্বি-মাসিক শাস্ত্রীয় সংগীতানুষ্ঠান