পরিবেশ নারীবাদ চাই চর্চায় ও মননে

সীমা তাসনিম | শনিবার , ১ জানুয়ারি, ২০২২ at ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ

সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতি ও নারীর মধ্যে এক বিশেষ বন্ধুত্ব বিদ্যমান। প্রকৃতির ওপর মানুষের যে নিপীড়ন তার সঙ্গে নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য ও নিপীড়নের এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য আমরা লক্ষ্য করি। একে ভিত্তি করেই উল্লেখিত ‘পরিবেশ নারীবাদ (ঊপড়ষড়মরপধষ ভবসরহরংস)’ বা সংক্ষেপে ‘ইকো ফেমিনিজম’ তত্ত্বটির উদ্ভব। পরিবেশ নারীবাদ একটি বিশেষ দার্শনিক অবস্থান তথা দৃষ্টিভঙ্গী যা সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধকল্পে পরিবেশের সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে। প্রকৃতির ওপর মানুষের যে নিপীড়ন তার সঙ্গে নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য ও নিপীড়নের যে সাজুয্য তা-ই পরিবেশ নারীবাদের ভিত্তি। গত শতকের সত্তর-আশি এই দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সভা-সমিতির মাধ্যমে পরিবেশ নারীবাদের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে ফরাসি নারীবাদী লেখক ফ্রাসোয়াঁ দ্যুবন প্রথম ‘পরিবেশ নারীবাদ’ শব্দটি তাঁর দখব ঋল্কসরহরংসব ড়ঁ ষধ গড়ৎঃ’ (‘নারীবাদ নাকি মৃত্যু’) গ্রন্থে ব্যবহার করেন। অবশ্য এই তত্ত্বের বিপক্ষেও মত রেখেছেন, ফ্রাসোয়াঁ দ্যুবনের ধারণার সমালোচনা করেছেন অনেকে যেখানে মনে করা হয় নারীত্বের কোমল প্রবৃত্তির গুণে পরিবেশ নারীবাদ গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা নিশ্চয় জানি যে, সৃষ্টির একেবারে প্রথম থেকেই নারীরা প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোততভাবে জড়িয়ে রয়েছে বলেই পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ নারীবাদের জন্ম। ফ্রাসোয়াঁ দ্যুবন থেকে শুরু করে ক্যারেন ওয়ারেন, ভাল প্লামউড, মারে বুকচিন, জিম চেনি, বন্দনা শিবা, মারিয়া মেইজ প্রমুখ লেখক ইতিমধ্যেই এই তত্ত্বটি নিয়ে নিজেদের মন্তব্য রেখেছেন। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য ভিন্ন হলেও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাই যে প্রকৃতি ও নারী উভয়ের নিপীড়ন ও শোষণের জন্য দায়ী তা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবার পরিবেশের ওপর পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের এক ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক মডেল উপস্থাপন করেন রোজ মেরি রুথার। ১৯৭৫ সালে তার প্রকাশিত মডেলে রুথার ব্যাখ্যা করেছেন, মাতৃতান্ত্রিক কৃষিভিত্তিক সমাজ পদ্ধতিতে পরিবেশ ছিল সংরক্ষিত ও অক্ষত। পরবর্তীকালে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসানের সঙ্গে শুরু হয় পরিবেশের ওপর অবিচার। সৃষ্টির একেবারে প্রথম থেকেই নারীরা প্রকৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। তাই পরিবেশ সুরক্ষায় নারীদের গুরুত্ব অপরিসীম। নারী সমাজকে স্নেহ-মমতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়ে সযত্নে লালন পালন করে। ঠিক সেভাবেই প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করা এবং উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করা যেতেই পারে। কৃষিকাজের ক্ষেত্রে নারীরাই বহু বছর ধরে বীজ রক্ষার কাজ করে আসছে। নারীসুলভ গুণসমৃদ্ধ সমাজ পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি যত্নবান হবে। তাই এই মতবাদ দ্বারাই পরিবেশ সংরক্ষণ ঘটানো সম্ভব হবে মনে করা হচ্ছে।
তবে পরিবেশ সুরক্ষায় নারীর যে ভূমিকা তা কিন্তু সমাজের সব স্তরের নারীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় না। কর্পোরেট বা ব্যবসায়ী শ্রেণির নারীদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার কোনও দায় দেখা যায় না। আমাদের কর্পোরেট শাসিত সমাজের এই ব্যাপারে উদাসীন থাকাটাই স্বাভাবিক। পুঁজির মুনাফা ছাড়া তাদের অন্যকিছু উপলব্ধি করার কথাও নয়। সাধারণত নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত, মাটির কাছাকাছি থাকা নারীদের মধ্যেই পরিবেশ রক্ষার এই তাগিদ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী সমাজের পাশাপাশি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকেও সমানভাবে হাত মেলানো দরকার। প্রাকৃতিক সম্পত্তি ব্যবহার এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণিরই বিশেষভাবে তৎপরতা অবলম্বন করা উচিৎ। তবেই এক সুন্দর, সবুজ, সতেজ ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারবো আমরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনে আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শনে বিভাগীয় কমিশনার
পরবর্তী নিবন্ধহাজার মন্দিরের প্রত্নতাত্ত্বিক বাগানে