হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ

নির্বাচনোত্তর সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণতন্ত্রকে যেভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছেন তাতে কেউ কেউ অবাক হলেও হতে পারেন। আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। বরঞ্চ তিনি যদি এমন ‘কর্মটি’ না করতেন তাহলে অবাক হতাম এই ভেবে, গণতন্ত্রের প্রতি, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাহীন-ব্যক্তি ট্রাম্পের পক্ষে এ কী করে সম্ভব। নির্বাচনে পরাজয় হলে ট্রাম্প যে এমনটি করবেন তা বার কয়েক এই ‘কলামে’ লিখেছিলাম। তিনিও তা কোন রাখঢাক না করে জানান দিয়েছিলেন এই বলে, ‘নির্বাচনে আমি জিতবো সে নিশ্চিত, তবে যদি হেরে যাই ধরে নিতে হবে কারচুপি হয়েছে’। বিশ্ব-গণতন্ত্রের মোড়ল দাবীদার যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ক’দিন আগেও ট্রাম্পের প্রিয়ভাজন, সেক্রেটারি অফ স্টেট পম্পিডু ইরান, চীন, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে বেড়িয়েছেন। এখন তারা কোন মুখে যে সমস্ত দেশে গণতন্ত্র লুন্ঠিত তাদের গণতন্ত্রের ‘সবক’ দেবেন। গত চার বছরে এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতা যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, রাজনীতিবিদ বিশেষ করে রিপাবলিকান পার্টির নেতা-সদস্যদের হাসির পাত্র বানিয়েছে। বিষয়টি ট্রাম্প উপলব্ধি করতে না পারলেও তার দলের নেতাদের কেউ কেউ ঠিক বুঝতে সক্ষম। কিন্তু সাহস করে মুখ খুলতে পারছেন না। এই বিষয়টি ক’দিন আগে উঠে আসে যখন ডেমোক্রেটিক দলের জনৈক নেতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘দলের (রিপাবলিকান) মধ্যে অসন্তোষ আছে। অনেকেই ট্রাম্পের এমন আচরণ ও কার্যকলাপে সন্তুষ্ট নন। কিন্তু তারা সাহস করে মুখ খুলছেন না। তাদের ভয় তাতে ট্রাম্প ক্ষেপবেন এবং তিনি ক্ষেপা মানে তার ভোটাররা ক্ষেপা। তারা জানেন ট্রাম্পের একটি বিশাল ভোট ব্যাংক আছে’।
যেদিন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেয়া হলো, সেদিন গণতন্ত্রকামী মার্কিন নাগরিকদের পাশাপাশি বিশ্ব অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল, এই কারণে বিগত চার বছরের ‘উদ্ভট’ ও ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়ায় দেশ শাসন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুক্তি পেলো। কিন্তু কথায় আছে ‘ম্যান প্রোপোজেস গড ডিসপোজেস’, অর্থাৎ মানুষ চায় এক, সৃষ্টিকর্তা লেখেন ভিন্ন’। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের জয়কে ট্রাম্প অস্বীকার করে ‘ভোট গণনায় কারচুপি হয়েছে’ এই অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোর্টে গেলেন। তার নিয়োগকৃত আজ্ঞাবাহী এটর্নী জেনারেল দিন কয়েক আগে ভোট কারচুপির অভিযোগ তদন্ত করার নির্দেশ দিলেন। তদন্তে অনুমান করা হচ্ছে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সময়ক্ষেপণ হবে এবং ক্ষমতা-হস্তান্তর প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে, সাধারণ জনগণের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে এবং যে বিভাজন ইতিমধ্যে বিগত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প করেছেন তা আরো বাড়বে। সেটি গোটা দেশকে নিয়ে যাবে এক অনিশ্চয়তার দিকে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে রাশিয়া, চীন, আইসিস, আল-কায়দার মত যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষ শক্তিগুলো। এমনতর আশংকা প্রকাশ করেছে নাইন-ইলেভেন কমিশন। পেন্টাগন সহ গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেবার জন্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ‘ট্রানজিশন পিরিয়ডে’ ইতিমধ্যে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বিশেষ করে যারা কোন কোন ব্যাপারে তার সাথে একমত পোষণ করেননি বা তিনি অন্যায়ভাবে যা করতে বলেছেন তা করেননি, তাদের চাকরিচ্যুত করেছেন, নতুন নিয়োগ দিয়েছেন তার আজ্ঞাবহদের, বসিয়েছেন ‘ইয়েস স্যার’ জাতীয় ব্যক্তিদের। সমস্ত রীতিনীতি ভেঙে ট্রাম্প ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সময়ে আগামী প্রেসিডেন্টকে অর্থাৎ জো বাইডেনকে তার যে নিয়মিত ব্রিফিং দেয়ার কথা তা দিচ্ছেন না। এমন কী জো বাইডেনের টিমের সাথে কোন ধরনের সহযোগিতা না করারও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রশাসনকে। ফলে জো বাইডেন এই মুহূর্তে কিছুটা আর্থিক সংকটে পড়েছেন, যদিও বা তারা এর বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে প্রকাশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যত চেষ্টাই করুক না কেন, যত টালবাহানা করুক না কেন ক্ষমতা ধরে রাখার, তাকে ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউস ত্যাগ করতে হবে। অনেকের মনে প্রশ্ন- যদি তাকে শেষতক ক্ষমতা ছাড়তেই হয়, সেটি কি তার চিরদিনের তরে রাজনীতি থেকে বিদায়? না, তেমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। অনেকেই মনে করেন তাকে যদি নানা চাপের মুখে এবারকার মত ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে তিনি আবার চার বছর পর ফিরে আসবেন, দ্বিগুণ ক্ষমতাশীল প্রেসিডেন্ট হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ক্লিভল্যান্ড হচ্ছেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি প্রথম দফায় চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর, কয়েক বছর পর আবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। ক্লিভল্যান্ড ১৮৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন ১৮৯৩ সালে, অর্থাৎ মাঝখানে চার বছরের বিরতির পর। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র অনুয়ারি কোন ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, কিন্তু পরপর দুই টার্ম কিনা তার কোন উল্লেখ নেই। ট্রাম্পের প্রাক্তন উপদেষ্টাদের কেউ কেউ বলেন, ট্রাম্প আবার নির্বাচন করবেন। তার প্রাক্তন চীফ অব স্টাফ, মিক মুলভেনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদে যে শর্ট লিস্ট হবে তাতে তিনি থাকবেন’। পাশাপাশি এটিও শোনা যাচ্ছে ট্রাম্প যদি আর নির্বাচন না করেন তাহলে তার ছেলে হান্টার বাইডেন ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ট্রাম্প নামটি এখন ‘ট্রেড মার্ক’ হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা কেবল তৃতীয় বিশ্বে এতদিন দেখা যেত। আমেরিকায় এক সময় ছিল ‘কেনেডি’ পরিবার, পরিবারের নামেই ছিল আমেরিকানদের এক ধরনের মোহ, যা এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। তাই ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও মার্কিন নাগরিকদের এই ‘ডোনাল্ড পরিবার’ এত সহজে ‘ছাড়’ দেবে বলে মনে হয় না। ভাগ্য ভালো, ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা না হলে আমরণ-তক মার্কিনীদের হয়তো ট্রাম্প পরিবারের শাসনের নামে ‘অত্যাচার’ সহ্য করতে হতো। ১৯৫১ সালের আগ পর্যন্ত দু-বারের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করা যাবে না এই মর্মে কোন শাসনতান্ত্রিক বাধা-নিষেধ ছিল না। থিওডোর রুজভেল্ট ১৯২১ সালে তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কিন্তু উইড্রো উইলসনের কাছে হেরে যান।
ধরে নিলাম ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকে খত দিয়ে ঠিক করলেন আর রাজনীতি করবেন না। তাহলে বাকী জীবনটায় তিনি কী করবেন? তিনি কি ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্টদের সমন্বয়ে গঠিত ‘এঙ-প্রেসিডেন্ট ক্লাবে’ যোগ দেবেন? এই ক্লাবে আছেন জিমি কার্টার থেকে শুরু করে জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা। তিনি কি এই ক্লাবে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবেন? কিংবা তাকে কি অন্যরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারবেন? তার সাথে তো এনাদের ‘টেম্পারামেন্টে’ মিলবে না। তিনি তো ‘কনভেনশনাল’ রাজীনীতিবিদ নন। কিংবা তিনি কি জিমি কার্টারের মত সেবামূলক কাজে যোগ দেবেন? নাকি লেখালেখিতে ব্যস্ত হবেন (অবশ্য সে ক্ষমতা তার আছে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে)। নাকি অতি লাভজনক ‘স্পীকারর্স সার্কিটে’ যোগ দেবেন? অবসরে যাবার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা সাধারণত প্রকাশকদের সাথে তাদের ‘মেমোয়া’ লেখার জন্যে বিশাল পরিমান অর্থের বিনিময় চুক্তিবদ্ধ হন। যেমন বারাক ওবামা ও তার স্ত্রী মিশেল ওবামা এই ব্যাপারে ৬৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছিলেন। এছাড়া তারা (ওবামা ও মিশেল) নেটফ্লিঙের সাথে ‘মাল্টি-মিলিয়ন’ ডলারের চুক্তি করেন। এটি ছিল এই পর্যন্ত সব চাইতে অধিক পরিমাণ সম্মানি। জর্জ ডব্লিউ বুশ তার স্মৃতিকথার জন্যে ১০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছিলেন। একই ভাবে বিল ক্লিনটন ও হিলারী ক্লিনটন প্রকাশকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ট্রাম্প যদি এর কোনটিতে আগ্রহ না দেখান, তারপরও তার কাজ করার অনেক ‘ক্ষেত্র’ রয়ে গেছে। তার রয়েছে বিশাল সাম্রাজ্য। মুম্বাই, ইস্তানবুল, ফিলিপাইনে রয়েছে ট্রাম্প-ব্র্যান্ডের সম্পত্তি। এছাড়া যুক্তরাজ্য, দুবাই, ওয়াশিংটন ডিসি ও ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে তার গলফ খেলার মাঠ। ভ্রমণ ও প্রমোদ সেক্টরে তার রয়েছে অনেক লাভজনক ব্যবসা। গেল বছর নিউইয়র্ক শহরে তার বিশাল ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ দেখেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। বিশাল ও দৃষ্টিনন্দন সে অনেকটা আকাশ-ছোঁয়া ভবন। স্রেফ কৌতূহলের বশে কড়া নিরাপত্তা-বলয় ছাড়িয়ে ভেতরে গিয়েছিলাম এবং অনুমতি নিয়ে বেশ ক’টি ছবিও তুলেছিলাম। তখন কেবল ভেবেছি কত অর্থ হলে একজন ব্যক্তি অর্থকে অর্থহীন ভাবতে শুরু করে, আদৌ করে কিনা? এতো বিশাল ধনবান হয়েও তিনি গেল বছরে রাজস্ব খাতে ট্যাঙ দিয়েছেন মাত্র ৭৫০ মার্কিন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ কর্মীর দেয়া বাৎসরিক ট্যাঙের চাইতে কম। একজন ব্যক্তি কী পরিমাণ অসাধু ও অসৎ হলে এই ধরনের ‘জোচ্চুরি’ করতে পারেন তা বলা বাহুল্য।
সবশেষ কথার শেষ কথা হলো, ট্রাম্প এখনো ক্ষমতায়। তিনি ‘পরাজয়’ কোনোভাবে মেনে নিতে পারেন না। কথাটি তিনি নিজেও বলেছেন। তার বাবা তাকে শিখিয়েছেন, ‘উইনার’ কিংবা ‘লুজার’- এই দুটোর বাইরে আর কিছু নেই। ট্রাম্প ‘লুজার’ হওয়াকে অপছন্দ করেন। গেল অক্টোবর তিনি বলেছিলেন নির্বাচনে তিনি যদি হেরে যান, তাহলে তার ভীষণ খারাপ লাগবে, তা হবে সহ্যের বাইরে। “তখন হয়তো আমি দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারি, আমি জানি না”। এখন দেখা যাক তিনি কী করেন, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাসূলের (দ.) পথ অনুসরণে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা যায়
পরবর্তী নিবন্ধচিম্বুক পাহাড়ে হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবি ওয়ার্কার্স পার্টির