হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকারের উপর লেখাটি গেল সংখ্যায় এই কলামে প্রকাশিত হবার পর বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। বলা বাহুল্য, ইতিবাচক। বাংলাদেশ-প্রেমিক এই ব্যক্তিটির প্রতি তারা শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন, ওনার সম্পর্কে যেন আরো কিছু লিখি। লেখাটা পাঠক-সমাদৃত হয়েছে দেখে ভালো লেগেছে বলে নয়, একটি দায়বদ্ধতা থেকেও আমার এই লেখা, এই অন্যন্য ব্যক্তিকে নিয়ে। একাত্তরে দেশের বাইরে বিশেষ করে নিজ জন্মভূমি পাকিস্তানে বসে, জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি হয়ে, বিপদ হবে জেনেও পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী তথা পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের তীব্র সমালোচনা করা ও নিন্দা জানানো, কেবল নীতিবান ও সাহসী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। আর এদের অবদান, এদের অজানা কথা পাঠকের কাছে, আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা কর্তব্য মনে করি। বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকারের মতো শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিকে দেখে দুঃখ হয়, ক্ষোভ হয়, এই কারণে আমাদের দেশে জন্ম নিয়ে, স্বাধীনতার ফল ভোগ করে এখনো অগণিত লোক আছেন যারা ‘একাত্তর’ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দগুলি শুনলে ঠিক ‘কমফোর্ট’ ফিল করেননা। স্বাধীন বাংলাদেশে, দেশের বাইরে এমন বাংলাদেশী অনেক আছেন যারা এখনো আক্ষরিক অর্থে স্বাধীনতা-বিরোধী। তাদের কাউকে কাউকে এমনও বলতে শোনা যায়- পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম। তারা এখনো স্বপ্ন দেখেন একদিন পাকিস্তান আগের ফর্মে ফিরে যাবে। এমন মন মানসিকতার লোকজন সরকারের মধ্যেও গুটি মেরে বসে আছেন, বড় পদে আসীন তারা। দিন কয়েক আগে ফোনে কথা হচ্ছিল কানাডায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার, ড. খলিলুর রহমানের সাথে। দীর্ঘ ফোনালাপে ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, প্রবাসে বাংলাদেশের কোন কোন মিশনে এমন লোক বসে আছেন যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন না, যারা কেবল চাকরির খাতিরে ‘জয় বাংলা’ বলেন। তিনি ইউরোপের দু-একটি মিশনের উল্লেখও করলেন, আকারে-ইঙ্গিতে নাম বললেন। বললেন, ‘আমি এখানে (কানাডা) আসার পর ঘোষণা দিয়েছি যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেননা তাদের কোন ‘কনস্যুলার সার্ভিস’ দেয়া হবে না। সেটি আমি চালিয়ে যাব যদ্দিন আমি এখানে আছি।’ সেটি কতটুকু বাস্তবসম্মত বা তাতে কতটা কাজ দেবে জানিনে। যাই হোক, ফিরে আসি পাক-বিচারপতি প্রসঙ্গে।
জাতিসংঘের সাইড ইভেন্টে বক্তব্য রাখতে এসে বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার সাথে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে গ্রহণ করা ক্রেস্ট। মঞ্চে আসন নিয়ে সেটি রাখলেন টেবিলের উপর, তার সামনেই। সেটি দেখিয়ে দর্শকদের লক্ষ্য করে সত্তরোর্ধ এই বাংলাদেশ-প্রেমিক বলেন, এই ম্যাজিক পুরস্কারের কারণে আজ আমি এখানে, যা আমাকে দেয়া হয় ২০১২ সালে। কেন? কারণ ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছিল, তখন পাকিস্তানে বসে এই ভয়াবহ গণহত্যা সম্পর্কে কিছু বলা ছিল অচিন্তনীয় ব্যাপার। সেই সময় আমি লাহোর, পাঞ্জাবে, একটি জাতীয়তাবাদী ন্যাশনাল পাঞ্জাবি পার্টির অন্যতম ছাত্র নেতা। এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করি। কবি হিসাবে এর বিরুদ্ধে কবিতা লিখি। ফলে আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়। কেবল জেলেই তারা আমাকে ভরলো না। আমার উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হলো, আমাকে রাখা হলো সলিটারি কনফাইনমেন্টে। কিন্তু তার চাইতেও বড় শাস্তি ছিল, আমাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে চিহ্নিত করা হলো। জনগণ আমার মুখের উপর থুতু ছিটাতে লাগলো, কারণ আমি বাঙালি জনগণকে সমর্থন দিচ্ছিলাম, তাদের পক্ষে কথা বলছিলাম। আমাকে বলা হলো আমি ভারতীয় এজেন্ট, আমি বাঙালিদের এজেন্ট।
পাকিস্তানি এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি যখন তার বক্তব্য রাখছিলেন তখন পুরো হলে ছিল পিন-পতন নীরবতা। দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা তো আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলো, কিন্তু তার চাইতে বড় কষ্টকর ছিল যে বাঙালিরাও আমাকে এই বলে ঘৃণা করতে শুরু করলো যে, ‘তুমি এক নিষ্টুর পাঞ্জাবি’। আমি তাদের বুঝাতে পারছিলাম না যে আমি নিষ্টুর বা বর্বর পাঞ্জাবি নই। তোমাদের জন্য আমি কষ্ট, নির্যাতন ভোগ করেছি। সারাটা জীবন আমি চিহ্নিত হলাম বিশ্বাসঘাতক হিসাবে। এই নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি এলো ২০১২ সালে, যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, স্বীকৃতি দেয় ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ হিসাবে। পাঞ্জাবি হবার কারণে যে ঘৃণা আমি বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম, তা এই অমূল্য পুরস্কারের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো। শেষ হলো তাদের কাছ থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ ভবনে আয়োজিত এই সাইড ইভেন্টের দিন দুয়েক আগে ফোনে তিনি বললেন, এই পুরস্কার গ্রহণ করার জন্যে বাংলাদেশ গিয়ে সকল স্তরের জনগণের কাছ থেকে যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছি তা আজীবন আমার কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। তারা (বাংলাদেশের জনগণ) আমার সাথে এমন আচরণ করছিলেন আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একজন ‘ন্যাশনাল হিরো’। বাঙালি জনগণের কাছে আমি ঋণী, তাদের আমি জানাই ধন্যবাদ। জেনেভার জাতিসংঘ ভবনের ওই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলেন। একাত্তরের গণহত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সকল গণহত্যা বন্ধ হওয়া উচিত, হওয়া উচিত বিচারও। বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য এই গণহত্যা বন্ধে তাদের নিজ নিজ স্থান থেকে দায়িত্ব পালন করা। যে সমস্ত গণহত্যা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক কমিটি কর্তৃক বিচার হওয়া দরকার।’ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা প্রসঙ্গে বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার বলেন, ‘যদি কোন কমিশন গঠন করা হয় তাতে কোন পাকিস্তানিকেও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে কোন জেনারেল বা বিচারপতিকে যেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কেননা আমার মন হয় প্রায় সকল বাঙালি মনে করেন যে সকল পাকিস্তানী নাগরিক এন্টি-বাঙালি, তারা মনে করেন সকল পকিস্তানি অমানবিক (ইনহিউম্যান)। কিন্তু তা সত্যি নয়। একাত্তরে কিছু পাকিস্তানি ছিলেন যারা বাঙালি জনগণের পক্ষে ছিলেন এবং সমর্থন দিয়েছিলেন। আমি এখনো মনে করি, এখনো অনেক আছেন যারা সত্যি বলেন।’ এই প্রসঙ্গে তিনি হামিদুর রহমানের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘হামিদুর রহমান একজন পাকিস্তানি। কিন্তু তিনি যে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেন তাতে গণহত্যার বর্ণনা ছিল। এই ধরণের আরো অনেক হামিদুর রহমান পাকিস্তানে থাকতে পারে।’ তার বক্তব্যের শেষে তিনি শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বলেন, বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তিনি উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আশা প্রকাশ করে বলেন, তার (শেখ হাসিনা) এই পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে।
অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি এই বিচারপতির সাথে আমার জানাশোনা দিন-ক্ষণের পরিমাপে মাত্র সপ্তাহ কয়েক। কিন্তু তার সম্পর্কে যত জানছি ততই শ্রদ্ধা বাড়ছে। আজ দুপুরে কাজের ফাঁকে খানিক অবসরে তার লেখা বই, ‘ফরবিডেন ওয়ার্ডস’ পড়ছিলাম। জাতিসংঘ ভবনে অটোগ্রাফ দিয়ে বইটি তিনি বিদায় নেবার আগে আমাকে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে জোরদবস্তি ‘উর্দু’ চাপিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি ‘আওয়ার ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ উর্দু এন এনিমি অব পাঞ্জাব নেশন’ শীর্ষ প্রবন্ধে লেখেন, ‘পাকিস্তান সম্ভবত এই বিশ্বের একমাত্র জাতি যারা কোন যুক্তির পরোয়া বা উদ্বেগ ছাড়াই অদ্ভুত এবং অনন্য নিয়ম এবং ব্যবস্থা অনুসরণ করে এবং সর্বোপরি তারা সীমাহীন শত্রুতা ও আগ্রাসনের সাথে পাকিস্তানের জনগণের গলা চেপে ধরে। তাদের অন্যায় কাজের কেউ প্রতিবাদ করলে সাথে সাথে তার গায়ে লাগিয়ে দেয়া হয় ‘কাফের’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ জাতীয় তকমা। ‘ইসলামকে রক্ষা কর, ইসলাম বিপদে’ এবং ‘উর্দুকে বাঁচাও, এটি বিপদে’- এমনিতর মিথ্যে ধুঁয়া তুলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন পাকিস্তানি শাসকরা। তারা এমন একটা ভাব করেন যেন উর্দু ইসলামের ভাষা, যা বাস্তবে সত্যি নয়। তারা যে উর্দুকে ইসলামের ভাষা হিসাবে দাবি করেন, তা কোরানে উল্লেখ নেই বা কোন খলিফা বলেননি। তদুপুরি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে মুসলিমরা যেখানে ইসলাম প্রচারে গেছেন তারা কোথায়ও স্থানীয় ভাষাভাষীর উপর আরবী ভাষা চাপিয়ে দেননি। বিচারপতি ভাষা প্রসঙ্গে আরো বলেন, এমনও ধারণা দেয়া হয় যে কায়েদে আযম উর্দুকে পাকিস্তানের অভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে কার্যকর করতে চেয়েছেন। কার্যত উর্দুকে শিক্ষা ক্ষেত্রে ও অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে কার্যকর করা ছিল বৃটিশদের এজেন্ডা। দ্বিতীয়ত যে ব্যক্তি (কায়েদে আযম) এই ভাষা জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তার নিজের এই ভাষা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলনা, তার জীবনে তিনি কখনো এই ভাষায় কথা বলেননি এবং এই ভাষা শেখেননি। এটি ছিল স্রেফ রাজনৈতিক চাল।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী শিক্ষকতায় অনন্য আদর্শ
পরবর্তী নিবন্ধমন্দা উত্তরণে উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র বিকল্প