হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফেলে আসা আরো একটি বছর- এলোমেলো ভাবনা
আর একটি বছর পিছু ফেলে এলাম। স্বজন, আত্মীয়, পরমাত্মীয়, কাছে-দূরের বন্ধু, চেনা-অচেনা অনেককে হারালাম ফেলে আসা এই বছরে। খুব কম ব্যক্তিই আছেন যিনি বা যারা গেল বছর কোভিডের কারণে কাছের বা দূরের কাউকে না কাউকে হারাননি। প্রবাসে যাদের স্থায়ী বসবাস তাদের অনেকের দেশে যাওয়া হয়নি এই দুঃসময়ে। আবার যারা দেশে বেড়াতে বা প্রয়োজনে গেছেন তাদের কাউকে কাউকে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ঠাঁই নিতে হয়েছে হাসপাতালে। এরই মাঝে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, দুর্যোগ, দুর্ভোগ পিছু ফেলা আসা ২০২১ সালকে আলোচিত-বছর হিসাবে দাঁড় করিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বোধকরি সব চাইতে আলোচিত বিষয় বা ঘটনা ছিল গেল বছরের শুরুতে (৬ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি উস্কানিতে তার উগ্র-সমর্থকদের ‘ক্যাপিটল হিল’ আক্রমণের ঘটনা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চেয়েছিলেন জনমতের রায়কে উপেক্ষা করে ছলে-বলে-কূট-কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে। কিন্তু বিধি বাম। বিশ্ব একটি বড়সড় রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেল। বিশ্ব- এই কারণে বলছি, আমেরিকায় ভালো বা মন্দ কিছু ঘটলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বাইরের দেশগুলিতে পড়তে বাধ্য। ক্ষমতায় এলেন ডেমোক্রেটিক দলীয় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, জো বাইডেন। কিন্তু আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হলেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বরঞ্চ ক্ষমতায় না থেকেও মার্কিন রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ন হলেন সমালোচিত, বিতর্কিত ও নিন্দিত এই প্রেসিডেন্ট, ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাস্তবিক, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। আফ্রিকার কোন দেশ নয়, কিংবা নয় কোন আরবীয় বা ল্যাটিন আমেরিকার দেশ। গণতন্ত্রের ‘চ্যাম্পিয়ন’ দাবিদার খোদ আমেরিকায় গণতন্ত্রের কী অবাক-করা অবক্ষয়, গণতন্ত্র কী চরমভাবে ভুলুন্ঠিত।
ফেলে আসা বছরটিতে আরো বেশ কিছু ‘চমক’ দেখা গেল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রাতের আঁধারে মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটালো। অনেকটা পালিয়ে বাঁচার মত। আফগানিস্তান থেকে হুট করে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘পলায়ন’ বিশ্বের চোখে নিন্দিত ও সমালোচিত হলো। কোন প্রতিরোধ ছাড়া জয়ী-বেশে ক্ষমতায় এলো উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী তালিবান। সাধারণ আফগানরা প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়তে লাগলো, কেউ কেউ উড়ন্ত মার্কিন উড়োজাহাজের সাথে দৌঁড়াতে লাগলো। যেভাবেই হোক এ দেশ ছাড়তে হবে। কেননা তালিবানদের উপর তাদের কোন আস্থা নেই। তারা (তালিবান) বলছে বটে, তারা ২০ বছর আগের পর্যায়ে নেই। তারা অনেক ‘মডারেট’ হয়েছে, তারা এখন অনেক ব্যাপারে সহনশীল। কিন্তু তারা যে ‘তারাই’ সে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবাই টের পেতে শুরু করলো। নারীদের আবারো ঘরে ঢুকানো শুরু করলো। নারী-শিক্ষায় বাঁধা দিতে লাগলো এমনি আরো অনেক। আফগানিস্তান এখন অনেকটা শান্ত। কিন্তু কিসের বিনিময়ে। গেল দুই দশকে তালিবান ও তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সন্ত্রাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারালো ২৫০০ মার্কিন সেনা সদস্য ও ৪ হাজার মার্কিন সিভিলিয়ান কন্ট্রাক্টরস। অন্যদিকে নিহত হলো প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার আফগান নাগরিক। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ২,৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে, যা দৈনিক হিসাবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। দুই দশক পর ফলাফল শূন্য। কেবল শুভঙ্করের বিরাট ফাঁকি। তবে ২০২১ সালে অনেক ‘মন্দের’ পর সুখকর ব্যাপার যা তা হলো ‘কোভিড-ভ্যাকসিন’ আবিস্কার। সাধারণত একটি ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে সময় লাগে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর। সেক্ষেত্রে কোভিড ভ্যাকসিন আবিস্কারে সময় লেগেছে এক বছরেরও কম। এর আগে সব চাইতে দ্রুত ভ্যাকসিন বের হয়েছিল ‘মাম্পস’ ভাইরাসের। চার বছর লেগেছিল ‘মাম্পস-ভ্যাকসিন’ আবিস্কার করতে। আমাদের সৌভাগ্য যে কোভিড ভ্যাকসিন এত শীঘ্র বের হয়েছে। তা না হলে যে আরো কত মৃত্যু আমাদের দেখতে হতো কে জানে।
ফিরে আসি হল্যান্ডে। উত্তর সাগর পাড়ের ছোট্ট কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অতি উন্নত এই দেশটিতে গেল বছরের আলোচিত বিষয় ছিল এই দেশের সংসদীয় নির্বাচন। দেড়শত সংসদীয় আসনের জন্য ২০২১ সালের ১৫-১৭ মার্চ ভোট হলেও সরকার গঠনে সময় লেগেছে ২৭১ দিন, প্রায় নয় মাসের কিছু বেশি সময়। এই সময়টা দেশ চালিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দৃশ্যত কোন সমস্যা হয়নি তাতে। সবকিছু ঠিকঠাক চলেছে। আর ডাচরা আমাদের অর্থাৎ বাঙালির মত রাজনীতি নিয়ে অত ‘অবসেস্‌ড’ না। ম্যারাথন-আলোচনা শেষে গেল বছরের শেষ সপ্তাহে এসে ঘোষণা দেয়া হলো চার দলীয় কোয়ালিশন সরকার গঠনে এক মতে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। যে চারটি রাজনৈতিক দল এই কোয়ালিশন সরকারে আছে তা হলো, বর্তমান প্রধান মন্ত্রী মার্ক রুতের ফেই ফেই দে যা ইংরেজিতে পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি, ডেমোক্রেটিক-৬৬, ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক আপীল (সিডিএ) ও ক্রিস্টান ইউনিয়ন। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন হবে নতুন বছরের ১০ জানুয়ারি। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রায় এক বছর দেশ চালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার। অকৃতদার মার্ক রুতে এই নিয়ে চতুর্থবারের মত কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে চলেছেন। নতুন সরকারের বড় চমক হলো ২৯ মন্ত্রীর মধ্যে ১৪ জন মহিলা। ডাচ রাজনীতিতে এই প্রথম কোন সরকারে এক সাথে এত সংখ্যক মহিলা মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। মন্ত্রী সভায় প্রথমবারের মত ঠাঁই পেয়েছেন এমন কয়েকজন অনেককে কিছুটা অবাক করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন তুর্কী বংশোদ্ভূত মহিলা দিলান ইয়েসিলগজ জেগেরিয়াস। আঙ্কারায় জন্ম নেয়া ৪৩-বছরের এই মহিলা পেয়েছেন বিচার ও নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তিনি প্রধান মন্ত্রী রুতের ফে ফেই দের সদস্য। চমক দেখিয়েছেন সিডিএ-এর প্রধান, হোপকে হুক্সট্রা। তিনি আগে ছিলেন অর্থমন্ত্রী। এবার হলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্যদিকে কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগ্রিড কাগ হলেন অর্থমন্ত্রী। কূটনীতিক ও ভালো আরবি-ভাষা জানা এই মহিলা ডেমোক্রেটিক-৬৬ দলের নেত্রী। এই লেখা যখন ছাপার অক্ষরে বের হবে তখন প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রথানুযারী সাক্ষাৎ করবেন দেশের রাজা উইলিয়াম আলেক্সান্ডারের সাথে। তারপর কাজ। দেখা যাক আগামী চার বছর নব-গঠিত চার দলীয় এই কোয়ালিশন সরকার দেশে কী উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
এদিকে হল্যান্ডে পুরানো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে আহবানের মুহূর্তগুলি কাটলো শংকা আর উদ্বেগে। কোভিডের কারণে ডাচ সরকার আগ বাড়িয়ে আতশবাজি পোড়ানো, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দেদারসে বাজি এসেছে চোরাপথে, প্রতিবেশি দেশ বেলজিয়াম থেকে। মচ্ছব লেগেছিল গোটা দেশ জুড়ে। বাজি পোড়ানোর পাশাপাশি পোড়ানো হয়েছে প্রাইভেট কার, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। হল্যান্ডের প্রায় ৪০০০ স্থানে আগুন লাগিয়ে দেবার ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সাথে হয়েছে সংঘর্ষ। হাক্সবার্গেন নামক স্থানে বাজিতে প্রাণ গেছে ১২ বছরের এক কিশোরের, সে অদূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ৩৩-বছরের এক ব্যক্তি খুঁইয়েছে তার একটি হাত, আর একজন একটি পা। আহত হয়েছে অনেক। জার্মানিতে বাজি পোড়ানোর উৎসবে প্রাণ হারিয়েছেন দু’ব্যক্তি। ফ্রান্সে প্রায় ৪০০ গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবার ঘটনা ঘটেছে। ভিন্ন পরিস্থিতি নয় পাশের দেশ বেলজিয়ামেও। ডাচ সরকার নতুন বছর উৎসবকে ঘিরে যে কোন ধরনের পাবলিক জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ওই যে বললাম, কে শোনে কার কথা, চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। ফলে পুলিশের সাথে স্থানে স্থানে হয়েছে সংঘর্ষ। গ্রেপ্তার হয়েছে অনেক। এমনি এক বাজি-পোড়ানোর উৎসবে শরিক হয়েছিলাম আমরাও, তবে কিছুটা দূরত্বে, কেবল দর্শক হিসাবে। নাচ-গান-খাওয়া শেষে বাসায় যখন ফিরি তখন ভোর চারটা। মাঝে একটি দিন কিছুটা বিশ্রাম। তার পরের দিন ‘বাংলাদেশ হাউজে’ নতুন বছরকে ঘিরে ঘরোয়া-আড্ডা আর দেশীয় খাবারের আয়োজন। হল্যান্ডের অভিজাত শহর ওয়াসেনারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদ উল্লার সরকারি বাসভবনে ছিল দুপুরের আমন্ত্রণ। কোভিডের কারণে হাতে-গোনা কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবার, দূতাবাসের কয়েক কর্মকর্তা ও তাদের সঙ্গী/সংগীনি ছিলেন আমন্ত্রিত। আড্ডা চলে অনেকটা বিকেল অবধি। সে আড্ডায় দেশ, অর্থনীতি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের হালচাল, দূতাবাস, আসন্ন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রদূত একটি বই এগিয়ে দিলেন। হল্যান্ড থেকে প্রকাশিত। বড় আকারের এই প্রকাশনায় অনেক নামি-দামি ডাচ ব্যক্তিত্বের ছবি ও লেখা। তার মধ্যে ডাচ রাজা উইলিয়াম আলেক্সান্ডার, প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাতে ঠাঁই পেয়েছে পূর্ণ-পৃষ্ঠাব্যাপি মনোরম বিজ্ঞাপন, ‘বাংলাদেশ ৫০ টেইলজ অফ এ ডেলটা’। বাংলাদেশকে বহিঃবিশ্বে স্বমহিমায় তুলে ধরার হল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তাতে যথার্থভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- “বিয়োন্ড শার্ট-টু-শিপ ম্যানুফ্যাকচারিং”। অর্থাৎ যুদ্দুর বুঝলাম- কেবল গার্মেন্টসেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সীমিত থাকেনি। শার্ট ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে জাহাজ বিনির্মাণেও। বইটির ব্যাপারে পুরো তথ্য হাতের কাছে নেই। লিখেছি, হাতে এলে পরবর্তীতে আরো লেখার ইচ্ছে রইলো। এমন একটি অতি প্রেস্টিজিয়াস প্রকাশনায় বাংলাদেশকে তুলে ধরার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। দেখতে ভালো লাগে। যেমন দেখতে ভালো লাগে হল্যান্ডের বুকে ‘বাংলাদেশ হাউজ’-এর পরম অহংকারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট্ট বাংলাদেশ দেখতে। গেইটের বাইরে থেকে চোখে পড়ে পতপত করে উড়া বাংলাদেশের লাল -সবুজ পতাকা। গর্বে মন ভরে উঠে। এই ‘পতাকার’ জন্যে আমরা যুদ্ধ করেছি। এই পতাকার জন্যে ত্রিশ লক্ষ লোক আত্মাহুতি দিয়েছে। এক সময় রাষ্ট্রদূতসহ আমরা সবাই বাংলাদেশ হাউজের পেছন দিকটায় এসে দাঁড়াই। বাইরে সহনীয় ঠাণ্ডা। চোখ-মন দুটোই জুড়িয়ে যায়। সামনে খোলা সবুজ মাঠ। ডানদিকে ‘কাভার্ড সুইমিং পুল’। সামনে, ডানে-বায়ে গাছ-গাছালি, যেন প্রকৃতি এসে খেলা করে। ভালো লাগে। এই ভালো-লাগার রেশটুকু সঙ্গী করে এক সময় ফিরে আসি। মনে মনে উচ্চারণ করি কনফিউসাসের বিখ্যাত সেই কটি শব্দ- Wherever you go, go with all your heart.
লেখক : সাহিত্যিক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেম-অপ্রেমের গল্প
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শেয়ারবাজারের মূল্যায়ন