হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৮ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

তুষারপাতের কারণে প্লেন ওড়েনি

কাতার এয়ারওয়েজের বিশালাকারের ৭৭৭ বোয়িং উড়োজাহাজটি উড়াল দেবার কথা দুপুর সোয়া তিনটায়। প্লেনে চড়েছি তার আধ ঘন্টা আগে। সিট বেল্ট পড়ার ঘোষণা দেয়া হলো। নিয়ম মাফিক ক্ষণিক বাদে প্লেনের দরোজাও বন্ধ হলো। কিছুটা সময় পার হয়ে গেল, ভাবি এই বুঝি উড়াল দেবে। কিন্তু না, উড়াল দেবার কোন লক্ষণ নেই। এমন সময় আবারো ঘোষণাবলা হলো, প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে প্লেন উড়তে পারছে না। রানওয়ে তো বটেই, প্লেনের বিশাল আকারের পাখাতেও জমেছে বরফ। উড়োজাহাজের ভেতর আমরা কয়েকশ যাত্রী। মুরগির খোপের মত ছোট ছোট কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেই। দেখি পেঁজা তুলার মত সফেদ বরফ পড়ছে শূন্য থেকে। রানওয়ে, আশপাশ এমন কী টারমাকে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনগুলো সাদা হয়ে গেছে। কোনটা যে কোন এয়ার লাইনসসের বুঝা মুশকিল। এমন সময় দেখি উঁচু সাইজের এক ক্রেন এসে থামলো আমাদের প্লেনের পাখার একেবারে কাছাকাছি। সেখান থেকে হোসপাইপের মত একটি বড় পাইপ থেকে পানি জাতীয় কোন পদার্থ ছিটিয়ে চলেছে। প্লেনকে ‘ডিআইসিং’ অর্থাৎ বরফ নাগলানো পর্যন্ত উড়াল দেয়া সম্ভব নয় এবং আমাদের অনুরোধ জানানো হলো যেন একটু ধৈর্য্য ধরে থাকি। এমন পরিস্থিতিতে এ ছাড়া উপায় বা আর কী থাকে। প্রায় আড়াই ঘন্টা আমাদের এইভাবে সময় কাটাতে হলো প্লেনের ভেতর বসে, ‘ধৈর্য’ ধরে। ধরেই নিয়েছিলাম কাতারের রাজধানী দোহায় কানেকটিং ফ্লাইট নির্ঘাৎ মিস করবো। কেননা ট্রানজিটে আমার প্লেন বদলানোর সময় ছিল মাত্র দেড় ঘন্টা। এমন পরিস্থিতে আগে টেনশন বেড়ে যেত। এখন আর হয়না। যখন যা হবার তাই হবেমনে মনে এটিই উচ্চারণ করে চুপ করে থাকি। ধৈর্য্য ধরে থাকার চেষ্টা করি। যদিও আমার দুই আত্মজআত্মজাসপ্তর্ষি ও অতীশ এবং তাদের মায়ের মতে এই ‘ধৈর্য্য’ পদার্থটি আমার মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সন্তানদের কিছু বলিনে কিন্তু কৌতুক করে মাঝে মধ্যে ওদের মাকে বলি, ‘তোমার সাথে যে গত ৩৪ বছর ধরে সংসার করে চলেছি, এতেই কি প্রমাণ মেলেনা যে আমার ধৈর্য্যের কমতি নেই’। কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই, যাকে লক্ষ্য করে এই কথা বলা তিনি বলেন, ‘ঠিক একই কথা তো আমার দিক থেকেও আসতে পারে। কথা বাড়াইনে। সংসারে একেঅন্যকে ধৈর্য্য ধরেই তো চলতে হয়। এর যে বিকল্প নেই। তাতেই সুখ, তাতেই শান্তি।

যাই হোক, দিন কয়েক ধরে হল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় প্রচন্ড বরফ পড়ছে। এ বছর একটু আগবাড়িয়ে এই তুষারপাত। সাথে বাতাস আর বৃষ্টি। এমনিতে শীত, বাতাস যখন বইতে থাকে তখন শীতের তীব্রতা যায় বেড়ে। দেশ থেকে ফিরেছি মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে। দেশে ছিলাম মাস আড়াই, অনেক লম্বা, একটানা এতদিন হল্যান্ড থাকার ৩৩ বছরে এই প্রথম। হল্যান্ড ফিরে প্রথম দুদিন তো মনে হলো এই বুঝি আমার প্রথম ইউরোপ আসা। প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগছিল, এমন কী ঘরের মধ্যে সেন্ট্রাল হিটার অন করার পরও। অথচ গায়ে জড়িয়েছি গরম পোশাক, নিচে প্যান্টের ভেতর ‘ইনার’, ঘরের ভেতর মাথায় উলের ক্যাপ। দেখে মনে হচ্ছিল যেন আইসল্যান্ডে আছি। তারপরও মনে হচ্ছিল ঠান্ডা আমায় পেয়ে বসেছে। অবশ্য দিন কয়েক বাদে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো। ‘মানুষ অভ্যেসের দাস’ বলে একটা কথা আছে। বাসা থেকে এয়ারপোর্টের দূরত্ব আনুমানিক ৪০ কিলোমিটার। ভীড় তেমন ছিলনা, কিন্তু ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর হালকা বরফ। যাই হোকবসে আছি প্লেনের ভেতর। যাত্রীদের ব্যস্ত রাখার জন্যে কাতার এয়ার লাইন্সের রমণীয় রমণীরা অর্থাৎ এয়ার হোস্টেজরা ট্রে হাতে যাত্রীদের ড্রিংকস আর বাদামচিপস জাতীয় সস্তা খাবার দিচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে কোন উচ্চবাচ্য নেই, কোন অভিযোগ নেই। সবাই যার যার আসনে বসে সিটের পেছনের স্ক্রিনে কেউ ছায়াছবি, কেউ ভিডিও গেইমস কেউবা ভিন্ন কিছু দেখছিল। আমার কোনটাতেই আগ্রহ ছিল না। কেবল বার কয়েক মেসেজ পাঠিয়ে বাসায় জানালাম আমার দশা। তিনজনা সিটের ‘আইল’ সিটে আমি। আকাশ ভ্রমণে আইলসিট আমার চাই। তার জন্যে প্রয়োজনে বাড়তি কড়ি গুনতেও প্রস্তুত। তাতে ইচ্ছে মাফিক অন্য যাত্রীদের বিরক্ত না করে উঠা যায়, টয়লেটে যাওয়া যায়, দীর্ঘ যাত্রায় একটু হাঁটাহাঁটি করা যায়। জানালার ধারে কিংবা মাঝে বসলে অনেক সময় ‘নিম্নচাপ’ থাকলেও তা দমিয়ে রাখতে হয়। আমার ডানের সীটে এক ডাচ তরুণী। বয়স বড়জোড় ২২২৫, গায়ে জন্ডিস রঙের গরম কাপড়। কটকটে হলুদ। সে যাচ্ছে ব্যাংকক। তারও শংকা দোহায় কানেকটিংফ্লাইট মিস করবে। তার পাশে জানালার ধারে নাকবোঁচা আধবয়েসী বেটেখাটো মহিলা। খুব সম্ভবত ইন্দোনেশীয়। উনি মোবাইলে বরফগলানোর দৃশ্য ভিডিও করছেন।

ঠিক পাঁচটা পনের মিনিটে অর্থাৎ স্থানীয় সময় পাঁচটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে প্রচন্ড শব্দে আমাদের উড়োজাহাজ উড়াল দিলো। ঘড়ি ধরে দেখছিলাম। তিন মিনিটের মাথায় মেঘ ছাড়িয়ে যখন উপরে উঠে গেল, তখন দেখি মুরগির খোপের মত জানালাগুলি দিয়ে সূর্যের চমৎকার আলো প্লেনের ভেতর এসে লুটোপুটি খেতে লাগলো, আবার পরক্ষণেই সরে যাচ্ছে, আবার আসছে, যেন ‘হাইড এন্ড সিক’ গেইম খেলছে আমাদের সাথে। মনে পড়ে ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়/ লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে/ সাদা মেঘের ভেলা রেভাই, লুকোচুরি খেলা’। গলা বাড়িয়ে নিচে তাকাই। গোটা হল্যান্ড যেন বরফে ঢাকা। মন্দ আবহাওয়ার কারণে প্লেন ঝাঁকুনি দিচ্ছিল বেশ। স্ক্রিনে দেখতে পেলাম ২২৩৬০ ফিট পর্যন্ত বেশ ঝাঁকুনি হচ্ছিল, সেটি বন্ধ হলো যখন আমাদের উড়োজাহাজটি সাড়ে তেইশ হাজার ফিট উঁচুতে পৌছুলো। মিনিট বিশেক উড়ার পর সিট বেল্ট খোলার সাইনবাতি জ্বলে উঠলো। শুরু হলো যাত্রীদের দুপুরের লাঞ্চ দেবার আয়োজন। সেটি ঘন্টা দুয়েক আগে দেবার কথা। যাত্রীদের কেউ কেউ উঠে টয়লেটের দিকে, কেউবা খালি সিটের খোঁজে, যদি পাওয়া যায়, তাহলে সটান শুয়ে যাওয়া যাবে। পরে দেখলাম কয়েকটি সিটে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে কয়েক যাত্রী। ভাবলাম, সময় নষ্ট করার মতো সময় তো হাতে নেই। দেশে পৌঁছে তো শুরু হবে বিরামহীন ঘোরাঘুরিকাজে ও অকাজে। লেখার সময় বের করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। ওভারহেড বিন খুলে কাগজকলম বের করে লিখতে বসি। ভাবি পুরোটা লেখা না হলেও অন্তত কিছুটা তো এগিয়ে নেয়া যাবে। বাকিটুকু দেশে গিয়ে কাজ আর অকাজের ভীড়ে বের করে নেয়া যাবে। এখন সেটিই হচ্ছে। লেখায় মনোযোগ দেয়া মুশকিল, যদিও বা মনযোগ কেড়ে নেবার মত কেউ নেই। হিন্দী ছবি দেখলে কেমন হয়? খুঁজে খুঁজে বের করলাম ‘দসভি’, যার অর্থ ‘দশম’ বা (হাই স্কুল ডিপ্লোমা)। মূল চরিত্রে অভিষেক বচ্চন, অশিক্ষিত, উদ্ধত এক রাজনৈতিক নেতা, সাথে আইপিএস চরিত্রে জামী গৌতম ধর। আকাশপথের অনেকটা সময় কেটে গেল এই এক ঘন্টা চব্বিশ মিনিটের ছবি দেখে। দোহা এসে প্লেন থেকে নেমেই দেখি ওই প্লেনের বিভিন্ন গন্তব্যস্থলের নামধারী ‘বোর্ড’ নিয়ে অপেক্ষমাণ কাতার এয়ার ওয়েজের কতিপয় কর্মচারী। এক মহিলা কর্মচারী ধরে আছে একটি বোর্ডতাতে লেখা ঢাকা, করাচী। তার কাছে গিয়ে পুরানো বোর্ডিং কার্ড দেখাতেই তিনি নতুন বোর্ডিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন। ‘ট্রান্সজিট’ সাইনবোর্ড ধরে এগিয়ে যাই। এখন কোন তাড়া নেই। যে প্লেনে ঢাকা যাবার কথা ছিল সেটি চলে গেছে অনেক আগেই। পরবর্তী ফ্লাইট আরো সাত ঘন্টা পর। ক্ষিদে খুব একটা ছিল না, তারপরও ভাবি কিছু না খেলে তো চলে না। বড়সর বিমানবন্দর, তার ভেতর বেশ কটি রেস্তোরাঁ। বার্গার কিংএর দিকে এগিয়ে যাই। চিকেন বার্গার আর পানির বোতল নিয়ে এক কোণায় বসে পড়ি। শরীর ক্লান্ত। এমন সময় মেসেজ এলো হল্যান্ড থেকে। পাঠিয়েছে সুমনা, অর্থাৎ গিন্নী। জানালে এই মুহূর্তে দোহা এয়ারপোর্টে হল্যান্ডগামী ফ্লাইটের অপেক্ষায় আছে ওর জেঠাতো বোন অর্থাৎ আমার শ্যালিকা পূরবী ও তার মা। সপ্তাহ দুয়েক আগে পূরবী বাংলাদেশ এসেছিল তার মাকে হল্যান্ড বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে। এই নিয়ে তার মায়ের তিনবার হল্যান্ডযাওয়া। ফোন করে খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হলোনা। ভিনদেশে হঠাৎ দেখাখুব ভালো লাগলো আমাদের সবার কাছে। ওদের সাথে কিছুক্ষণ থেকে এগিয়ে যাই থরে থরে সাজানো খালি বেঞ্চগুলোর দিকে। সেখানে কিছু যাত্রী শুয়ে আছে, কেউ বসে, মোবাইল দেখছে, কথা বলছে। নিরিবিলি কর্নার বেছে একদিকে আমিও বসে পড়ি। ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি। ঘুম অধরাই থেকে যায় গোটা রাত। সকাল সোয়া আটটায় আমার ঢাকাগামী ফ্লাইট। বিরক্তিকর! কিন্তু ঢাকা নেমে মনটা ভালো হয়ে যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ। কোন ঝামেলা নেই। অন্যদিকে, লাগেজ বেল্টে লাগেজ আসা শুরু হবার মিনিট দশেকের মধ্যে দেখি আমার দুটো লাগেজ। এতো তাড়াতাড়ি কখনোই লাগেজ পাইনি। তাই খুব ভালো লাগছিলো। বেল্ট থেকে লাগেজ নিচে নামাতে দেখি ব্যাগের গায়ে কটকটে লাল ট্যাগে বড় অক্ষরে সাদা রংয়ে লেখা, ‘রেপিড ট্রান্সফার’। অর্থাৎ এই ব্যাগ যেন দ্রুত লাগেজ বেল্টে চলে যায়। ব্যাগের মালিককে ফ্লাইট মিস হবার কারণে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে, হয়তো সেই ভেবে এই ব্যবস্থা। কাতার এয়ারওয়েজকে ধন্যবাদ জানাই মনে মনে। তবে বলতেই হয়, তাদের সেবাপ্রদান (এয়ার হোস্টেজ) ও খাবারের মান এমিরাটসের তুলনায় নিম্নমানের। ইমিগ্রেশন খুব স্বল্প সময়ে পার হওয়া ও তাড়াতাড়ি লাগেজ পাওয়াতে মনের ভেতর এক ধরণের আনন্দ আর ভালোলাগা শুরু হলো। কিন্তু সেই ভালোলাগা আর আনন্দ খানিক বাদেই কর্পূরের মত মিইয়ে গেল যখন এয়ারপোর্ট ছেড়ে ঢাকার অসহনীয় ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়লাম। তথাকথিত তিলোত্তমা ঢাকাকে আমার ভারী বিচ্ছিরি মনে হতে লাগলো, মনে হলো ঢাকা ছাড়লেই বাঁচি। সে বাঁচা বাঁচলাম পরদিন সকালে। সকাল আটটার ফ্লাইটে যখন চট্টগ্রাম পৌঁছুলাম। কর্ণফুলী নদীর পাড় ধরে নতুন রাস্তা হয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে শহরের দিকে। আমার প্রাণের শহর চট্টগ্রাম। ড্রাইভার আলমগীরের গাড়িতে বেজে চলে– ‘আবার দেখা হবে, এ দেখাই শেষ দেখা নয়গো’। ক্লান্ত আমি মাথা এলিয়ে দেই পেছনের সিটের উপর, চোখ বন্ধ করে থাকি।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত অর্ঘ্য