হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

পিকনিক, বনভোজন, চড়ুইভাতি। কত নামে ডাকা হয় একই বিষয়কে। বদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে, প্রকৃতির মাঝে দল বেঁধে হই চই করে, নাচে গানে, কৌতুকে, গল্পে মেতে গোটা দিন কাটিয়ে আবারো দিনান্তে নিজ নিজ ডেরায় ফিরে আসা, যেমন করে নীড়ে ফিরে আসে পাখি দিনাবসানেএরই নাম তো পিকনিক, বা বনভোজন কিংবা চড়ুইভাতি। এই পিকনিক কিন্তু আজকের আবিষ্কার নয়।

সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এর শুরু। তখন পিকনিক মূলতঃ সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের অর্থবান ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে। যদ্দুর জানি ফরাসীদের হাত ধরে পিকনিকের যাত্রা। সে সময় সবাই নিজ বাড়ি থেকে কিছু খাবার, পানীয় নিয়ে আসতেন, খোলা আকাশের নিচে, পিকনিকে যোগ দিতে। সেখানে তারা নাচগান করতেন, হৈ হুল্লোড় করতেন এবং দিনশেষে বাড়ি ফিরে যেতেন। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব সব বদলে দেয়। জীবনের ভয়ে অভিজাত শ্রেণী গোষ্ঠী দেশ ত্যাগ করে স্থায়ী আবাস গড়েন অস্ট্রিয়া, পুরুসিয়া ও আমেরিকায়।

তবে বেশির ভাগ ঘাঁটি গড়েন বৃটেনে। লন্ডনে যখন তারা নতুন জীবন শুরু করেন তখন তাদের আর আগের সেই প্রাচুর্য নেই। কিন্তু তারা ধরে রেখেছিলেন তাদের পুরানো ঐতিহ্য, পিকনিক। তারা ইংল্যান্ডে চালু করেন পিকনিককালচার। প্রত্যেক সদস্য সাথে করে নিয়ে আসতেন একটি ‘ডিশ’। সেটি নির্ধারণ করা হতো লটারির মাধ্যমে। এবং ছয় বোতল মদ। খাবার শেষে হতো গান, নাচ এবং জুয়া খেলা। সেখানেই সীমিত নয়। প্রধান এন্টারটেইনমেন্ট ছিল নাটক। তবে যারা পরিচালনা ও অভিনয় করতেন তারা সবাই সৌখিন শিল্পী। সংক্ষেপে এই হলো পিকনিকের ইতিহাস। তবে পিকনিক বা বনভোজনের ইতিহাস লেখার জন্যে আমার আজকের এই লেখা নয়।

আজ লিখবো আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কতিপয় অভিজাত ও অর্থবানদের পিকনিকের কথা। এই পিকনিকেও সবকিছুর আয়োজন ছিল। ছিল প্রচুর পরিমাণে খাবার, গান, কৌতুক, মাছ ধরা, লটারী, পুরস্কার এবং সব কিছু ঘটেছিল খোলা আকাশের নিচে, পাহাড় এন্ড সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে। তবে তার সাথে ছিল অর্থহীনদের পাশে দাঁড়ানোর কর্মকাণ্ড। সে কথা বলতে গেলে শুরু থেকে শুরু করতে হয়।

সপ্তাহ খানেক আগে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে চিটাগং ক্লাব গিয়েছিলাম রোটারি ক্লাব অব চিটাগং রেইনবোর তাদের ভাষায় এক ‘রেগুলার মিটিংএ’। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু, রোটারিয়ান এম নাসিরুল হক। ক্লাবের আর কারো সাথে তখনও আমার জানাশোনা নেই। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে মনে হয়নি তাদের সাথে এই আমার প্রথম দেখা। ঘন্টা দেড়েক ছিল সে মিটিংএর স্থায়িত্ব, কিন্তু এরই মধ্যে তারা, ক্লাবের প্রতিটি কর্তাব্যক্তি ও সদস্য আমায় অতি আপন করে নিলেন।

ক্লাবের সদস্য হবারও প্রস্তাব রাখলেন কেউ কেউ। প্রায় সবাই জানান তারা আমার লেখা পড়েন, পছন্দ করেন, এমনতর প্রশংসাবাণী। প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে, সত্যি হোক বা মিথ্যে। আমার সব লেখা যে আহামরি গোছের তা নয়। তা সত্ত্বেও প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে। মনে মনে বলি ‘এই মনিহার আমায় নাহি সাজে’, কেননা এর যা কিছু কৃতিত্ব তার সবটুকুই দৈনিক আজাদীর প্রাপ্য, লেখকের নয়।

যাই হোক মিটিংএ সিদ্ধান্ত হলো দুদিন বাদে ক্লাবের সদস্যরা যাবেন পিকনিকে। স্থান রাউজান উপজেলার ইয়াছিননগর, হলুদিয়া। উপজেলার দক্ষিণে বয়ে গেছে কর্ণফুলী, পশ্চিমে হালদা। নানা কারণে রাউজান বিখ্যাত। মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মস্থান এই রাউজান। এখানে জন্মগ্রহণ করেন ফজলুল কবির চৌধুরী, আব্দুল হক চৌধুরীর মত ব্যক্তি। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাউজানের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

একাত্তর সালের ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী রাউজান উপজেলার পাহাড়তলি ইউনিয়নের উনসত্তরপাড়ায় হত্যাহাজ্ঞ চালিয়ে ৪৮ নিরীহ নাগরিককে হত্যা করে। একই দিন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে (বর্তমানে চুয়েট) পাক বাহিনী হত্যা করে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, প্রফেসর দিলীপ কুমার চৌধুরী, শেখ মোজাফ্‌ফর আহমদ, আব্দুর রব ও ইউনুসকে। এই রাউজানেই হানাদার বাহিনী হত্যা করে দানবীর নূতন চন্দ্র সিংকে। পরবর্তীতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে সাকা বাহিনী।

এনডিপির সশস্ত্র ক্যাডারদের জন্যে আমরা নিজ বাড়িতে থাকতে পারিনি, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল এই স্বাধীন বাংলাদেশেও’, বললেন সেই ভয়াল দিনের সেইসব কাহিনী স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোহাম্মদ শফি। তখন আমরা ইয়াছিননগর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম এহেছানুল হায়দর চৌধুরী, যিনি বাবুল নামে সমধিক পরিচিত তার চমৎকার বাড়িতে বসে গল্প করছিলাম। আমরা যখন তার ড্রয়িং রুমে বসে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলছিলাম তখন তিনি এসে পৌঁছাননি।

তিনি ছিলেন চট্রগ্রাম বিমানবন্দরে, ঢাকা থেকে আসা আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে অভর্থনা জানাতে। যাই হোক

পিকনিকে আমার নিমরাজি থাকার কারণ, ভোরে উঠা। রোটারিয়ানদের মিটিংয়ে যখন বলা হলো সকাল সাতটায় রওনা দেয়া হবে, তখন মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম এ আমার হবার নয়। কেননা ভোরে ঘুম থেকে উঠা আর হিমালয়ে উঠা দুটোই আমার কাছে কঠিন কাজ।

এমন নয় যে ভোরে উঠতে হয়না বা পারিনা। ঠেকায় পড়লে সবই করতে হয়। তবে মিটিংয়ে সবাই এমন করে বলছিলেন যে নাকরতে পারিনি।বিশেষ করে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জাহেদা আকতার মিতা, চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির ডাইরেক্টর সাবিনা কিউ দোভাষ, চেয়ারম্যান এহেছানুল হক চৌধুরীর আত্মজা রোটারিয়ান তাসনুভা হায়দার নোভা, নাসির ভাইয়ের তাগাদা তো ছিলই। সেদিনের মিটিংয়ে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রোটারিয়ান খায়ের আহমদ বললেন, সকালে বাসা থেকে আমায় তুলে নেবেন তার বাহনে। তিনি থাকেন আমার ধারেকাছে।

রাতে ফোন করে খায়ের সাহেব জানালেন, সকাল সোয়া আটটায় তিনি আমার বাসার নিচে আসবেন। একটু রিলিফ, মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আর বিছানায়যাবে। সময় মেনে চলা আমার অভ্যেস।

সোয়া আটটার খানিক আগে প্রস্তুত। ভাবছি ফোন দেব কিনা, এমন সময় খায়ের ভাই ফোনে বললেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরুচ্ছি। অক্সিজেনের কাছাকাছি একটি স্থান থেকে আমাদের গাড়িতে উঠলেন নাসির ভাই। গায়ে পাঞ্জাবি, তার উপর পাতলা একটি গরমের কাপড়। চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। তেমন শীত নেই। গাড়ি এগিয়ে চলে রাউজানের দিকে। এগিয়ে চলে আমাদের আড্ডা। আমাদের সাথে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ রোটারিয়ান এরশাদুল হক।

রাউজান এর আগেও আমার যাওয়া হয়েছে। বেশ প্রশস্ত রাস্তা। রাস্তার দুধারে চোখে পড়ার মত সারিবদ্ধ বড়সর গাছ। গাছ প্রকৃতিগত কারণে সুন্দর, তার উপর প্রলেপ দেয়া হয়েছে রং দিয়ে, ‘পিঙ্ক কালার’। এ যেন চোখধায় তেমন সুন্দরীর চোখে কাজল পড়ানো। আমার ভালো লাগে না। যা কিছু স্বাভাবিক তাই তো সুন্দর। কালো মেয়ে, তারও বিশেষ রূপ আছে, আছে সৌন্দর্য্য। রবি ঠাকুরের গানের কথায় বলতে হয়, ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণচোখ’।

গাছের গায়ে এই পিঙ্কপ্রলেপ ভালো লাগেনা। তাতে গাছের আদি সৌন্দর্য্যে ভাটা পড়ে। কিন্তু তাতে কার কী এসে যায়। স্থানীয় এম পি ফজলে করিমের ভালো লাগাটাই হলো বড় কথা। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, তিনি তার এলাকাকে চমৎকার করে সাজিয়েছেন। রাস্তাঘাট বড় করেছেন, দুধারে গাছ লাগিয়েছেন। অনেক পরিপাটি করে রেখেছেন, যা চাটগাঁর অন্যান্য এলাকায় দৃশ্যমান বলে মনে হয় না। তার সাথে একবার দেখা হয়েছিল জেনেভায়, তার হোটেলে। জেনেভায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত ভাগ্নী রিমি ও তার জামাই সসীম তার (ফজলে করিম) খুব প্রিয়ভাজন। জেনেভা এক সময় তিনি প্রায়শঃ যেতেন, কাজে।

আমারও কাজে জেনেভা বছরে বার কয়েক যাওয়া হয়। একবার একই সময়ে উনি সেখানে ছিলেন। সসীম নিয়ে গিয়েছিল তার সাথে পরিচয় করাতে। দিন কয়েক আগে কে যেন বললে, তার কারণে সিআরবির শিরীষ তলা রক্ষা পেলো গাছখেকো হায়েনাদের হাত থেকে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তাকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। এই কলামে এই নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছিলাম বিগত দিনে। যাই হোক

ইয়াছিননগর ভালো লাগে। ভালো লাগে সকল রোটারিয়ানদের আন্তরিকতা ও যত্ন।

সেখানে দেখা,পরিচয় ও প্রাণ খুলে আড্ডা দেয়া হয় মাহফুজুল হকের সাথে। তখনও জানতাম না উনি কে। লক্ষ্য করি সবাই তার কখন আসা হচ্ছে এই নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ও আগ্রহী। এগারটার দিকে আমাদের সকালের নাস্তা যখন শেষ তখন তিনি এলেন। পরিচয় হলো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে একটি কামরায় মুখোমুখি বসে। সবাই তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত।

জানতে পারলাম ইনি বিখ্যাত ‘ইকুইটির’ চেয়ারম্যান। বয়সে তরুণ, প্রাণোচ্ছল ও সহজে অন্যকে আপন করে নেবার গুণ রয়েছে তার মধ্যে। যখন জানতে পারলেন আমার কোথায় অবস্থান তখন সমস্ত মনোযোগ দিলেন লেখকের প্রতি। জানতে চাইলেন ডাক্তার ইউসুফ চাচার কথা। প্রবীণ ও সবার শ্রদ্ধাভাজন এই আত্মভোলা মানুষটি যখন হল্যান্ডের রটারডামের এক বিশেষ মেডিকেল সেন্টারে জীবনের সায়াহ্নে শেষ নিঃস্বাশের ক্ষণ গুনছিলেন তখন সস্ত্রীক তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

তখন তিনি নির্বাক। মাহফুজুল হক জানালেন ডাক্তার ইউসুফ তার খুব কাছের ও আস্থাভাজন ছিলেন। আমাকে পেয়ে, আমার সাথে ডাক্তার ইউসুফ চাচা ও তার পাকিস্তানী ডাক্তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জেনে মাহফুজ সাহেব যেন পুরানো দিনকে ফিরে পেলেন। পুরানো দিন হাতড়িয়ে বেড়াতে থাকি আমরা দুজন। আমাদের আশপাশে যারা উপস্থিত তারা নির্বাক শ্রোতা।

(চলবে)

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএছলামাবাদী প্রতিষ্ঠিত বরকল এস. জেড. হাই স্কুল সম্মিলন
পরবর্তী নিবন্ধব্যক্তি-দলীয় চরিত্রের মেরামতই কাম্য