সড়কে মৃত্যুর আহাজারি থামাতে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি

| বৃহস্পতিবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত টিভি, এফএম, রেডিওতে জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। রাস্তায় বড় বড় বিলবোর্ডে লেখা আছে সচেতনতামূলক নানা কথা। বানানো হচ্ছে পথ নাট্যসহ কমিকও। তারপরও থেমে নেই সড়ক দুর্ঘটনা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআই-এর হিসেবে গত দশ বছরে বাংলাদেশে ২৯ হাজার ৪৩২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৬৮৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৫৪৮ জন। নিরাপদ সড়ক চাই’এর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০১৬ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৪৪ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫২২৫ জন। ২০১৫ সালের তুলনায় এই সংখ্যা কমেছে ৩১০টি। তবে ঈদের সময়টাতে দুর্ঘটনা পরিমাণ বাড়ছে অনেক। গত বছরে শুধুমাত্র ঈদুল আযহাতে বাসসৃষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে ৫২ শতাংশ।
দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক দুর্ঘটনায় কার কতটা দায়, সে বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমাদের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনার তদারকি-সব ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা। সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসড়কে লোকাল গাড়ি ও পথচারী আসার কথা নয়। শ্রেণিবিন্যাসের দিক থেকে স্থানীয় রাস্তা, মধ্যম পর্যায়ের রাস্তা, প্রধান সড়ক; তার পরে ধমনি সড়ক বা মহাসড়ক। সংজ্ঞা অনুসারে মহাসড়ক কোনো এলাকাকে রাজধানীর সঙ্গে অথবা বন্দরনগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং এর মান হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এই মান আসে ব্যবহারকারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা দিয়ে। সব ব্যবহারকারী যদি সমগতির হলে সড়কের ঝুঁকি কম থাকে। সে কারণেই মহাসড়কে দ্রুতগতির ও বড় গাড়ি চলে বিধায় স্থানীয় চলাচলের গাড়ি ও পথচারীদের কোনোমতেই মিশতে দেওয়া হয় না। তারা নিচ দিয়ে বা ওপর দিয়ে চলে যায়। এর জন্য প্রতিবন্ধকতা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে যত্রতত্র মহাসড়কে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। এটা পরিকল্পনার বিশৃঙ্খলার প্রমাণ। সে অর্থে আমাদের দেশে সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসড়ক/ধমনি সড়ক নেই। কিন্তু এটা দরকার অর্থনৈতিক তৎপরতাকে গতিশীল করা এবং উৎসবে বড় আকারে মানুষ চলাচলের জন্য। যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোথাও হোঁচট খেতে না হতো, তাহলে কী পরিমাণ সময় ও অর্থ বেঁচে যেত!
তিনি বলেন, আমাদের সড়কে চলছে পরিকল্পনার এবং ভূমি ব্যবহারের বিশৃঙ্খলা। গাড়ির লাইসেন্স ও চালকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াও দুর্নীতিগ্রস্ত। এসবের কারণেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে। মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী, একজন চালকের লাইসেন্স দেওয়ার আগে তাঁর ৩৫ মিনিটের মহাসড়কে গাড়ি চালানোর পরীক্ষা ও তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিতে হয়। এটা করার জন্য সরকারের লোকবল খুবই কম। বিআরটিএর হাতে এককভাবে সব দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত। তারা রেজিস্ট্রেশন করবে, লাইসেন্স দেবে, ফিটনেসও পরীক্ষা করবে! কোথাও এটা হয় না। সরকারের খুব দ্রুত বিআরটিএর সংস্কারে যাওয়া দরকার। বিআরটিএর হিসাবে গাড়ি আছে ২১ লাখ, চালক আছে ১৩ লাখ। তার ওপর একটা বাণিজ্যিক গাড়ি চালাতে গেলে একাধিক চালকের প্রয়োজন হয়। সে কারণে ঘাটতি প্রায় ১৫/১৬ লাখ। এ অবস্থায় নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময়ই সরকার আসলে সেই গাড়িটা হেলপার দিয়ে চালানোর অবস্থা সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই নতুন গাড়ির নিবন্ধন দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। এভাবে সরকার নিজেই স্বঘোষিত চালক সৃষ্টিকে উৎসাহিত করছে। তার মানে, ঝুঁকি কমানোর বদলে সরকারই তা বাড়াচ্ছে। আবার দুর্ঘটনার তদন্তও তারাই করে, এবং তাতে নিজেদের দায় অস্বীকার করে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। তাঁরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়কে মৃত্যু কমছে না। পরিবহন খাতের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য বন্ধ করতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। সরকার ও পরিবহনমালিকদের বিরুদ্ধেই বারবার আঙুল উঠছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, পরিবহনমালিকেরা সে দলের আশ্রয়পুষ্ট ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠেন। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন প্রয়োগও হয় না, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশও মানা হয় না। তাই সড়কে মৃত্যুর আহাজারি থামাতে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে