স্মরণ : মেধা-মননে অনন্য নুরুল আলম চৌধুরী

মোস্তফা কামাল পাশা | বুধবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

কাজের স্বীকৃতি আশা করলে কোনো ভাল কাজে মনোযোগ একদম অসম্ভব। ভাল কাজ করতে হয় মানবিকতার দায় ও টানে। বিপদগ্রস্ত মানুষের দুঃখ মুছে দিয়ে তাদের মুখের এক চিলতে হাসিতে যারা স্বর্গসুখের তৃপ্তি খুঁজে পান, তারা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বৈরি পরিস্থিতিতেও ভাল কাজ করে যাবেনই। এদের থামানোর সাধ্য কারো নেই।

কিন্তু কর্মকীর্তির স্বীকৃতি লাভ এযুগে বিরল প্রাপ্তি। কাজ করতে হয় নীরবে নিভৃতে, প্রাণের টানে। খারাপ খবর হচ্ছে, এদেশে যে কজন আপন কর্মের সর্বজনীন স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, তাঁদের মানবিক গুণ আর গণমুখী চরিত্রেও চাটুকারিতার সর্দি মেখে দিচ্ছে অসংখ্য ভাগ্যশিকারী ভাঁড়। সর্দির শিরনিতে চাপা পড়ে যায় মহৎজনদের কীর্তি ও ত্যাগের মহিমা। জ্ঞানবিমুখ ভোগবাদী সভ্যতার উপজাত, ভাঁড় সংস্কৃতি। জ্ঞান, শুদ্ধ মনন, মেধার সুদৃঢ় প্রতিরোধ দেয়াল গড়া ছাড়া ভাঁড় সংস্কৃতি নির্মূল অসম্ভব। এটাও সত্য, বৈরি একটি পক্ষ কীর্তিমানদের কীর্তিতে কালি লেপ্টে মুছে দিতে সবসময় টিনের বাক্সভর্তি বিটুমিন হাতে প্রস্তুত থাকে নির্দেশের অপেক্ষায়। এটাই এদের উপর অর্পিত মিশন ও ভিশন! জাতির মহান জনক সর্বযুগের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও চরিত্রেও এরা টানা বিটুমিন লেপ্টে যায়, তাই অন্যদের প্রসঙ্গ না আনাই সঙ্গত।

আরেকটি কথা, সুরভিত ফুলের বর্ণাঢ্য একাধিক মালা ঝুলানোর মত বিরল ভাগ্যবান মানুষ খুব কমই জন্মায় এমাটির ভুবনে। শুধু দেশে নয়, পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই। আসলে হঠাৎ হঠাৎ এমন সৌভাগ্যবান কেউ কেউ জন্মান। এদের একজন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তুখোড় নেতা নুরুল আলম চৌধুরী। জন্ম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় হলেও মরহুম চৌধুরী দেশ বিদেশে টানা কীর্তির আলো ছড়ানোর মত বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। দুদফা ফটিকছড়ি আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। গত শতকের ৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের হয়ে প্রথম জাতীয় সংসদের সর্বকনিষ্ঠ এমপির স্বীকৃতিও তাঁর ঝুলিতে। এর বাইরে তিনি একমাত্র রাজনীতিক যাঁর মুকুট শোভিত করেছে অসংখ্য বিরল কীর্তির পালক। দুদফা নির্বাচিত এম পি. ছাড়াও ওমানের রাষ্ট্রদূত, রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের পরিচালক এবং উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত। এছাড়াও সফল বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, .বি. ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চা বোর্ড সদস্য, . বি. প্রথম সিনেট সদস্য, রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন মরহুম চৌধুরী। নুরুল আলম চৌধুরীর জীবনের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেও তিনি আমলার লোভনীয় পদ গ্রহণ করেননি। ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেবেন কিনা, বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুমতি চাইতে যান তিনি। বঙ্গবন্ধু পিঠে আদরের হাত বুলিয়ে তাঁকে আরও বড় উপহারের জন্য তৈরি থাকতে বলেন। ওই উপহারটি ছিল, ফটিকছড়ি আসনে ৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন প্রাপ্তি। পরে এম পি পদে নির্বাচিত হয়ে আসার বিরল সৌভাগ্য। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে বহু বড় মাপের নেতা আছেন, কিন্তু এক জীবনে নুরুল আলম চৌধুরীর মত এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য সম্ভবত অন্য কারো হয়নি। এটা সত্য, বঙ্গবন্ধু, দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি মরহুম চৌধুরীর বুকভরা দরদ ছিল। ৭৫ এর ভয়াল আগষ্ট বিভীষিকার পর তিনি বঙ্গভবনে বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোসতাককে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখান। তেজগাঁ এমপি হোস্টেল আটকে পড়া এমপিদের সমর্থন আদায়ে তাদের বঙ্গভবনে ডেকে নেন মোসতাক। তখন নুরুল আলম চৌধুরী খুনির চোখে চোখ রেখে তাকে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু খুনের জন্য চ্যালেঞ্জ করে বসেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসীম দরদ এদিন আবেগি নেতাটির মৃত্যুভীতি কেড়ে নেয়। এসময় বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের জনক প্রথিতযশা আইনজীবী ও কসবার মরহুম সিরাজুল হক এমপিও তাঁর সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।

এর জন্য প্রচুর মূল্যও গুণতে হয় তাঁদের। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের শোধ নিতে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মরহুম চৌধুরী। এর বাইরে সাহসী ও রুচিবান নেতা হিসাবে নুরুল আলম চৌধুরী সর্বমহলে সুপরিচিত। জ্ঞান, মনন, মেধায় সবসময় হাল নাগাদ থাকতেন। আত্মসম্মান ও আদর্শিক পথ থেকে একচুলও বিচ্যূত হননি। ৭৩ ও ৮৬ সালে দুদফা এমপি নির্বাচিত হলেও সাধারণ জীবন নির্বাহ করতেন। চলাফেরায় ধোপদুরস্ত হলেও বাড়তি ভোগ, বিলাসে কোনো আসক্তি ছিলই না। ফটিকছড়ির সশস্ত্র শিবির সন্ত্রাস কবলিত রাজনীতিতেও মৃত্যুভয় ভুলে তিনি কর্মী ও মানুষের পাশে ছিলেন সবসময়। মৃত্যুভীতি কখনো রাজনৈতিক দায় ও গণ মানুষের কাছ থেকে তাকে দূরে সরাতে পারেনি। পারিবারিকভাবে সচ্ছল ও অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের পতাকা ধারক নুরুল আলম চৌধুরী আজীবন আওয়ামী লীগের নানা পদে থেকে দেশ ও দলকে অকুণ্ঠ সেবা বিলিয়েছেন হাসিমুুখে। তাঁর বিদুষী সহধর্মিণী মনফুজা খান রোজী হচ্ছেন, চট্টগ্রাম আদালতের যশস্বী আইনজীবী মরহুম অ্যাডভোকেট বদরুল হক খানের একমাত্র আদরের কন্যা। মরহুম চৌধুরী রাজনীতিতে তুমুল ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের সুশিক্ষা ও শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায় টেনে নিয়েছেন রোজী ভাবী।

তাদের তিন সন্তানের বড়জন মেয়ে তানজিনা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ রাজনীতি ও শিল্প বাণিজ্যের প্রাণপুরুষ মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের ছোট ছেলে সম্ভাবনাময় শিল্প উদ্যোক্তা আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমির সাথে সুখের সংসার করছে। জিমির বড়ভাই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ দেশের সফল ভূমিমন্ত্রী হিসাবে পারিবারিক সুনামের পরিসর আরো প্রসার ঘটিয়েছেন। মরহুম চৌধুরীর বড় পুত্র জিসান অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চতর লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় আছেন। তিনি সেখানে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথেও সক্রিয়। ছোট হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব দেশের বেসরকারি নামী ভার্সিটি থেকে এমবিএ করে রাজনীতিতে সক্রিয় এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য। ফটিকছড়িতে বাবার নির্বাচনী এলাকার মানুষের পাশে থাকছেন তিনি। পাশাপাশি সফল ব্যবসায়ী এবং ভিআইপি টাওয়ারের মালিক বিশিষ্ট সমাজহিতৈষী আবুল হোসেনের একমাত্র কন্যার জামাতা তিনি ।

উল্লেখ্য, আমার বড় ভাই মরহুম মীর হাফেজ আহমদের সাথে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে একই ব্যাচে লেখাপড়া ও ছাত্রলীগ রাজনীতি করেছেন আলম ভাই। তখনকার চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাস সংগঠন যাত্রিকএর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তারা। এ কারণে খুবই স্নেহ করতেন, মাঝে মাঝে খুনসুটি লাগলেও অল্পতেই মিটে যেত। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য থাকাকালীন তাঁর আদর ও স্নেহধারায় বারবার স্নাত হয়েছি। রাশভারি হলেও আলম ভাই ছিলেন, হাস্যরসের বিশাল ভাণ্ডার। দুঃখের আগুনে বসে উদ্দীপনার বাঁশি বাজাতে জানতেন। সঙ্কটজনক সময় এমনকী গম্ভীর পরিবেশেও তিনি নির্দোষ হাস্যকৌতুকের ঢেউ তুলে জটিল পরিস্থিতিও জলের মত সহজ করে দিতে জানতেন। আসলেই শুধু ভাগ্যবান না, আওয়ামী লীগ রাজনীতির একজন ক্ষণজন্মা পুরুষও জনাব চৌধুরী। শুদ্ধ রাজনীতির তীব্র খরায় আলম ভাইদের মত মননশীল নেতার এখন বড় বেশি প্রয়োজন। তাঁর তৃতীয় প্রয়াণ বার্ষিকীতে (২৭ জানুয়ারি) সাহসী, মহান রাজনীতিক নুরুল আলম চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ