দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

খাওয়ার চেয়ে আড্ডা হলো বেশি। আমার হারিয়ে যাওয়া নিয়েও গল্প হলো। ঠাট্টা করা হলো নানাভাবে। চীনা কোন সুন্দরীর পাল্লায় পড়েছিলাম কিনা তা নিয়েও সহযাত্রীদের কৌতূহলের অন্ত ছিলনা। আমার বেদিশা হয়ে যাওয়ার রহস্য উদঘাটনে সহকর্মীদের টিপ্পনিতে বেশ মজা পাচ্ছিলেন তারা, আমিও। হাসিতে আনন্দে এবং গল্পে গল্পে আমাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। খাওয়া দাওয়ার চেয়ে আমাদের গল্পগুলোই যেন মূখ্য হয়ে উঠছিল। রেস্তোরাঁর নানা কিছুর মাঝে কি খেলাম কে জানে, তবে কফির সেই চিরচেনা স্বাদ অক্ষয় রয়েছে। চীনের গুয়াংজু বিমানবন্দরের রেস্টুরেন্টেও আমেরিকার হলিউডের স্টারবাকসের মতো কফি খাচ্ছিলাম বলে মনে হচ্ছিল।

রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে আবারো সামনের দিকে হাঁটছিলাম আমরা। কত বড় বিমানবন্দর, কত মানুষ! কত মানুষ যে কত দিকে যাচ্ছেন। একসময় মনে হতো, ভারতের ডোমেস্টিক টার্মিনালে মানুষ গিজগিজ করে, এখন গুয়াংজ বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক টার্মিনালে মনে হচ্ছে শুধু ভারতে নয়, চীনেও লাখ লাখ মানুষ বিমানে যাতায়ত করে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সাংহাই। ডোমেস্টিক এই ফ্লাইট ধরতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি আমরা।আমাদের আশে পাশে ছুটছে মানুষের কাফেলা। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে ডোমেস্টিক টার্মিনালে, কেবলই ছুটছে। ইতোমধ্যে আমাদের চেক ইন হয়ে গেছে। লাগেজ দিয়ে দিয়েছি। ঝাড়া হাত পা নিয়ে হাঁটছি আমরা। শুধুমাত্র ছোট্ট কেবিন ব্যাগটি রয়েছে আমাদের সাথে। অবশ্য তাও হাতে নেয়ার দরকার হয়নি, তুলে দিয়েছি দারুণ সুন্দর একটি ট্রলিতে। আলতো ছোঁয়ায় ট্রলিটি সামনে ছুটছে, আমার চেয়ে দ্রুতগতিতে।

লায়ন ফজলে করিম আমার দিকে তাকালেন, বললেন মজা দেখবেন? আমি আর কি মজা দেখানোর বাকি আছে বুঝতে পারছিলাম না। তার চোখে চোখ রাখলাম। তিনি আমার বোর্ডিং কার্ডটি চেয়ে নিলেন। কার্ডটি ট্রলির স্কিনে ছোঁয়ালেন। ছোট্ট একটি আওয়াজ করে তা স্ক্যান হয়ে গেল। মোবাইলের স্কিনের মতো ট্রলির স্কিনে ভেসে উঠলো একটি ম্যাপ। তাতে আমার সাংহাইর ফ্লাইটটি কত নম্বর গেট থেকে উড়বে এবং আমি যেখানে রয়েছি সেখান থেকে কোন পথে ওই গেটে যেতে হবে তা দেখিয়ে দেয়া হচ্ছিল। ফ্লাইটটি কখন উড়বে এবং আমার হাতে আর কতক্ষণ সময় আছে তাও জানান দিচ্ছিল। গাড়িতে জিপিএস যেভাবে কাজ করে এখন এই ট্রলিতেই সেভাবে জিপিএস কাজ করছে বলেও আমার মনে হলো। আমি ভাষা হারিয়ে লায়ন ফজলে করিমের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম যে, আসলে চীন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! ফজলে করিম আমাকে বললেন, চীনের প্রায় প্রতিটি বিমানবন্দরেরই এই ধরনের ট্রলি রয়েছে। যেগুলো শুধু আপনার লাগেজই বহন করবে না, আপনাকে পথও দেখিয়ে দেবে। আমি আশ্চর্য হয়ে ট্রলিতে হাত বুলিয়ে দেখছিলাম। গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাকচিক্যই শুধু নয়, ট্রলিও আমাকে মুগ্ধ করলো।

ট্রলির ম্যাপ দেখে দেখে অগ্রসর হচ্ছিলাম আমরা। কোথাও চলন্ত সিঁড়ি আবার কোথাও এক্সকেলেটর ধরে উপরে উঠে নির্দিষ্ট গেটের দেখা পেলাম। গেটে বসার চমৎকার ব্যবস্থা। আরো বহু লোক বসে আছে। আমরা গিয়েও কয়েকটি খালি চেয়ারে বসে পড়লাম। আমাদের ফ্লাইট উড়াল দেবে আরো কিছুক্ষণ পরে। এখনো গেট খোলা হয়নি। দুই তরুণী নিজেদের মতো করে কি কি যেন কাজ করছিলেন। কতক্ষণে গেট খুলবে কে জানে!

গুয়াংজু থেকে সাংহাই প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। ডোমেস্টিক রুটের ফ্লাইট। এই রুটে বেশ কয়েকটি অপারেটরের সারাদিনই ফ্লাইট চলাচল করে। প্রচুর যাত্রী এই রুটে চলাচল করে। চীনের অন্যতম বৃহত্তম এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর সাংহাই। আবার গুয়াংজুও গুরুত্বপূর্ণ নানাভাবে। ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানাক্ষেত্রে এই দুইটি শহরের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই শহর দুইটির মধ্যে হরদম লোক চলাচল করে। ছুটে চলা লাখো মানুষের কাফেলার অতি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে আমরাও ছুটছি সাংহাইর পথে।

গুয়াংজু থেকে সাংহাই পৌঁছতে আমাদেরকে দুই ঘন্টারও বেশি আকাশে উড়তে হবে। ঘন্টায় সাড়ে সাতশ’ কিলোমিটার বেগে ছুটবে আমাদের বোয়িং। তবে উঠানামা মিলে এই সময় আড়াই ঘন্টায় ঠেকবে। সাংহাইতে পৌঁছে আমাদের লাঞ্চ করার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে ফজলে করিম ওখানের সাগরপাড়ের এক রেস্টুরেন্টে আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছেন। ইন্টারনেট সুবিধায় কি কি সব এ্যাপস ব্যবার করে তিনি বিশেষ ওই রেস্তোরাঁয় টেবিল চেয়ার পর্যন্ত বুকিং দিয়ে দিয়েছেন, খাওয়ার ম্যানুও পাঠিয়ে দিয়েছেন কিনা কে জানে! বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আমরা নাকি সরাসরি নদীর পাড়ের সেই বিশেষ রেস্তোরায় হাজির হবো, সেখানে জমকালো লাঞ্চ সেরেই শুরু হবে আমাদের সাংহাই দর্শন। লাঞ্চের কথায় আমার ভিতরে আবারো উদ্বেগ দেখা দিল। সকালের নাস্তার যেই বেহাল অবস্থা দেখেছি তাতে দুপুরের লাঞ্চের যে কী হবে কে জানে! চীনের খাওয়া দাওয়ার বেহাল অবস্থার কথা ইতোমধ্যে আলোচিত হতে শুরু করেছে। আমাদের সফরসঙ্গীদের কেউ কেউ জানালেন যে, ভুল হয়ে গেছে। কিছু মুড়ি মুড়কি নিয়ে আসলে কাজ হতো। তারা জানান, চীন বেড়াতে আসার সময় অনেকেই কৌটা ভর্তি করে মুড়ি মুড়কি খৈ চিড়া নিয়ে আসে। কেউ কেউ পোড়া মরিচ, গুড়ো মরিচ, লবনও নাকি আনেন। যা দিয়ে রকমারি ফল খেয়ে তারা ক্ষুধা মেটান অনায়াসে।

এসব শুনি, আর আমার ভিতরটা ক্রমান্বয়ে শুকাতে থাকে! কি সাংঘাতিক!! কোন দেশে এসে পড়লাম! চীনা খাবারের এত কদর! এই খাবারের জন্য দেশে আমরা মুখিয়ে থাকি। কত ধরনের বায়না যে আমরা কতজন করি! বাজিতে জিতলে চায়নিজ খাওয়ার আব্দার করা হয়, পরীক্ষায় পাশ করলে খাওয়াতে হয় চীনা স্যুপ চিকেন ফ্রাই। যে কোন খুশীর খবর মানেই চায়নিজ খাবার! যে কোন ভালো খবর মানেই ভালো খাবার, চায়নিজ খাবার! কিন্তু চীনে এসে সেই চীনা খাবারের বেহাল বর্ণনা শুনে পরাণ শুকাতে থাকে! কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক!! নিজের ভিতরটা কেমন যেন ঘুরপাক খেতে থাকে!!!

আমাদের গেট খোলা হয়েছে। যাত্রীদের প্রায় সকলেই দাঁড়িয়ে গেলেন। এই এক মজা, আমাদের না নিয়ে এই বিমানের উড়াল দেয়ার কোন শক্তি নেই, বোর্ডিং কার্ড নেয়া প্রত্যেক যাত্রীকে খুঁজে খুঁজে হলেও বিমানে তোলা হবে, অতঃপর উড়াল দেবে বিমান। অথচ এখন গেট খোলার সাথে সাথে আমরা সবাই কমবেশি দাঁড়িয়ে গেটের দিকে পা বাড়িয়ে আছি। আমার মনে হলো, শুধু বাংলাদেশী বা বাঙালীই নয়, পৃথিবীর নানা দেশের যাত্রীদেরই ভ্রমণকালীন কিছু সমস্যা কাজ করে। যা সচরাচর ওই জাতির আচরণের সাথে যায় না। অথবা চীনারাও আমাদের মতো হুড়োহুড়ি করা পার্টি, এদেরও তর সয়না।

যাক, আমাদের গেটের দুই তরুণী শুরুতে বিজনেজ ক্লাসের যাত্রীদের ডাকলেন। অতঃপর সিট নম্বরের সিরিয়াল ধরে। পেছনের রো থেকে ফ্লাইটের যাত্রীদের বিমানে চড়ার জন্য আহ্বান করা হচ্ছিল। আমরা মাঝামাঝি রো’র যাত্রী। যখন আমাদের রো ডাকা হলো আমরা ধীরে ধীরে গেটের দিকে অগ্রসর হলাম। বোর্ডিং ব্রিজের গেটে এক তরুণী বোর্ডিং কার্ড চেক করে সিল দিয়ে দিচ্ছিলেন। সেখানে লাগেজ চেক করার সুযোগ রয়েছে। আমার লাগেজটি এয়ারক্রাফটে তোলা হয়েছে কিনা সেটি সেখানে সর্বশেষ চেক করার সুযোগ রয়েছে। যদি না তোলা না হয় তাহলে ওখানে বলে দিলে তারা খুঁজে বিমানে তোলার ব্যবস্থা করে। বিমানে চড়ার ঠিক আগ দিয়ে লাগেজ চেক করার সিস্টেম থাকার বিষয়টি পুরানো হলেও একসময় তা জানতাম না আমি। এতে করে আমার লাগেজ নিয়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সিস্টেমটি জেনে যাওয়ার পর থেকে লাগেজ নিয়ে আর কোন সমস্যা হয়নি। গেটে এক মিনিট সময় বেশি লাগলেও আমি সবসময়ই লাগেজের সর্বশেষ চেকটি করে বিমানের পথে পা রাখি। তরুণী কম্পিউটারের কি টিপে নিশ্চিত হলেন যে, আমার বোর্ডিং কার্ডের বিপরীতে একটি লাগেজ বিমানে তোলা হয়েছে। বিশাল বোয়িং। আমি আর করিম ভাই পাশাপাশি সিটে। লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং মেট্রোপলিটনের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি হিসেবে দারুণ সখ্যতা আমাদের। আমাদের গল্প যেন ফুরোয় না। শহরে নানা প্রোগ্রামে আমরা একসাথে কাজ করেছি। বহু কাজ করেছি শহর বন্দর গ্রামে। কত মানুষের দ্বারে যে আমরা লায়নিজমের ভালোবাসা পৌঁছে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। এখানে লায়নিজম না থাকলেও আমাদের গল্পগুলো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। বিমানবন্দরে কিংবা বিমানে আমরা হরদম গল্প করছি, কথা বলছি। করিম ভাই যখন চীনা তরুণীদের সাথে চোখ নাচিয়ে চাইনিজ ভাষায় অনর্গল কথা বলেন, গল্প করেন তখন আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাখিকে মেরো না
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণ : মেধা-মননে অনন্য নুরুল আলম চৌধুরী