প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

মুসলিম বিশ্বের মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি দরদের দিক দিয়ে তুরস্ক এগিয়ে। রোহিঙ্গারা আরাকানে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত। বংশ পরম্পরায় সে দেশে থাকলেও তাদের ভোটাধিকার নেই।

শতকরা কয়েকজন বাদে বাকী সবাই মুসলমান। তাদের প্রতি দরদ দেখায়ে তুরস্ক যেভাবে এগিয়ে এসেছে তা আমাদের ভাববার বিষয়। তুরস্কের সাথে আমাদের রয়েছে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গারা যখন সে দেশে অর্থাৎ আরাকানে নির্যাতিত হয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, তখন তুরস্কের ফাস্ট লেডি তথা এরদোগানের স্ত্রী এমিন এরদোগান তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে বাংলাদেশ সফর করেন। শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে তথায় গমন করেছিলেন।

পরবর্তীতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে বিশেষ বিমানে বাংলাদেশ সফর করেন।

বিগত ৫ বছরের ব্যবধানে রোহিঙ্গা শরণার্থীগণের কল্যাণে তুরস্ক থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একাধিক বার ডেডিকেটেড বাংলাদেশ সফর করেন। গমন করেন কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

সর্বশেষ ৮ জানুয়ারী শনিবার সকালে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে দেশ থেকে বিশেষ বিমানে কক্সবাজার বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আরও এসেছেন এ মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার, সেই দেশের দু’জন এম.পি। ঢাকা থেকে গিয়ে তাদের সাথে মিলিত হন তুরস্কের রাষ্ট্রদূত। তারা বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যান। সেদিন সকালে তুরস্কের ৩ মন্ত্রী ও ২ এম.পি বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গমন করেন। তুরস্ক সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কল্যাণে তথায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে এ পর্যন্ত ৭ লাখের মত রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে।

গত বছর ২২ মার্চ অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় এই হাসপাতাল। পরবর্তীতে তুরস্ক সরকার পরিচালিত পুনঃ নির্মিত হাসপাতাল উদ্বোধন করেন ৫০ শয্যার এ ফিল্ড হাসপাতাল। সাথে সাথে অগ্নিকান্ডে আশ্রয় হারা রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণাধীন আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।

ঐ সময় ১৭ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তুর্কি রেড ক্রিসেন্টের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এবং তুরস্কের ফাউন্ডেশন পরিচালিত রোহিঙ্গা দ্বারা সাবান তৈরির কারখানাও পরিদর্শন করেন। এতে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলায়মান সায়লু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে বিশ্বে তা বিরল বলে উল্লেখ করেন।

হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা বাদেও তুরস্ক সরকার শরণার্থীগণের কল্যাণে ব্যবহারিক ও খাদ্য সামগ্রী প্রদান করে আসছে। তুরস্ক যেহারে রোহিঙ্গা শরণার্থীগণের কল্যাণে দরদ দেখিয়ে ভূমিকা পালন করছে, মনে হয় না মুসলিম বিশ্বের অন্য কোন দেশ এভাবে এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে সৌদি আরবসহ উপ সাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর কথা মনে পড়ে। তাদের দায়িত্ব ছিল বর্তমানের চেয়ে শরণার্থীগণের কল্যাণে আরও অধিক ভূমিকা পালন করা। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঐদিন বিকেলে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে। বাংলাদেশের সাথে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। রাতেই ঢাকা থেকে তুরস্ক রওয়ানা হন।

আমাদের সৌভাগ্য যে, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে তুরস্কের মত শক্তিশালী দেশ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

১৯৭০ এর দশকে সৌদি বাদশাহ ফয়সল মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে মিশরের সাথে ইসরাইলের ১৭ দিনের যুদ্ধে আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলে ইসরাইলের অস্তিত্ব থাকত কিনা বলা মুশকিল। এতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের পাশে ছিলেন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল। বাদশাহ ফয়সালের পর অঘোষিতভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে আসেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ।

বর্তমানে বিশ্বে মুসলমানগণের খুব নাজুক অবস্থা। অনেক দেশের মুসলমানরা অবহেলিত নিষ্পেষিত। অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক নানান প্রতিকূলতায় সৌদি আরব আজ অসহায়। বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানগণের কল্যাণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিকল্প নেই।

এ মানবদরদি, মুসলিম দরদি এরদোগান রোহিঙ্গাগণের কল্যাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশে এসে দাড়িয়েছেন ইহা আমাদের দেশের জন্য সৌভাগ্যের।

তুরস্কের সাথে আমাদের রয়েছে ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক। সুলতানী আমলে তুরস্কের সুলতানগণ কর্ণফুলী শীপ ইয়ার্ড থেকে জাহাজ ক্রয় করে নিয়ে যেত। যেহেতু এখানকার নির্মিত শীপ ছিল মজবুত টেকসই। যদিওবা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তাদের নিজস্ব শীপ ইয়ার্ড ছিল (মিশর তখন তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে)

তুর্কি সুলতানগণ প্রায় ৪/৫ শত বছর বর্তমান সৌদি আরবের হেজাজ শাসন করে গেছেন। এ হেজাজ অঞ্চলে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার অবস্থান। হেজাজের কারণে ভারতবর্ষের সাথে তুরস্কের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।

আমাদের সরকারের দায়িত্ব হবে এ ইতিহাসকে সামনে রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তুরস্ককে পাশে রাখা। এতে দেশের অর্থনীতিতে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশের বহুবিধ কল্যাণ সাধিত হবে।

তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাহসিকতায় তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

সুলতানী আমলে ইস্তাম্বুল রাজধানী কেন্দ্রিক তুরস্ক পশ্চিম এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল শাসন করে গেছে শত শত বছর। সুলতানী আমলের শেষের দিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, আর্থিক প্রতিকূলতা, ব্রিটিশ, ফ্রান্সের প্রতিহিংসা তুরস্কের বিশাল সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপরও আজ ১০ লাখ ১ হাজার ৫ শত বর্গকিলোমিটারের তুরস্ক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যার এরিয়া বাংলাদেশ থেকে ৬ গুণ বড়। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাহসী প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তিনি মানবদরদী, মুসলিম দরদী।

রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলামী কল্যাণ পার্টি থেকে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ভাষণের কারণে তিনি ৪ মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত ছিলেন। পরবর্তীতে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মধ্যপন্থি রক্ষণশীল এ.কে পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নির্বাচনে জয়লাভ করে এরদোগান প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৩১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এসে রাষ্ট্রপতি হন। শাসনতন্ত্র সংশোধন এবং তাঁর অনুকূলে ভোট পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন। ২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হন এরদোগান। আমেরিকায় বসবাসকারী এরদোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফতুল্লা গুলেন, তুরস্কসহ বিশ্বের অনেক দেশে তার দল, সংগঠনের ব্যাপক কর্ম তৎপরতা রয়েছে। ফতুল্লা গুলেনকে সাথে নিয়ে আমেরিকা অভ্যুত্থান ঘটায় বলে বিশ্বে বহুল প্রচারিত। তবে এরদোগানের প্রতি তুর্কি জনগণের বিশাল জনপ্রিয়তা থাকায় তাঁর আহ্বানে হাজার হাজার সাহসী জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে আসে । যার কারণে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়।

বর্তমানে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব এরদোগানকে সহ্য করতে পারছে বলে মনে হয় না। তার মূলে বিশ্ব মুসলমানের কল্যাণে তার সাহসী ভূমিকা। তুরস্কের অভ্যন্তরে এরদোগানের দেশপ্রেম, সাহসী পদক্ষেপ মুসলিম বিশ্বের কল্যাণে ভূমিকাপালনে বিরোধীরা সুবিধা করে উঠে পারতেছে না। বস্তুত আরাকানে মুসলমানরা নিপীড়িত, নিষ্পেষিত। অন্টারিও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির রিপোর্ট অনুসারে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে প্রায় ২৪ হাজার রোহিঙ্গাকে সে দেশে হত্যা করা হয়েছে। ১ লাখ ১৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। ১৮ হাজার নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। যা বিশ্বের ইতিহাসে একটি লোমহর্ষক নিধনযজ্ঞ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। তৎমধ্যে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।

পরিশেষে তুরস্ক সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তুরস্কের জনপ্রিয় সাহসী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রতি। আমাদের সরকারের প্রতি আবেদন রাখছি দেশের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বৃহত্তরস্বার্থে তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি যাতে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : মেধা-মননে অনন্য নুরুল আলম চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধচলো সবাই