স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষা আন্দোলনের গান

বাসুদেব খাস্তগীর | মঙ্গলবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

আমাদের জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা একটি গৌরবজনক অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও এ তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করেছে একুশের চেতনা। আমাদের দেশের ইতিহাসে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক বটে এবং এ ঘটনা আমাদের চিরায়ত রাজনীতির ধারাকে এক নতুন বাঁকে ধাবিত করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনকে সে সময়ের স্বৈরাচার বিরোধী শুধু একটি আন্দোলন কিংবা শুধু ভাষার জন্য দাবি ভিত্তিক একটি আন্দোলন চিন্তা করলে খণ্ডিত করেই এর মূল্যায়ন করা হবে। একুশের চেতনা শক্তি এতটাই দৃঢ় ছিল যে, এর দ্যুতিময় গতি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলেও ছড়িয়েছে। যে কারণে আমরা দেখি একুশের চেতনায় শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং এ চেতনা প্রতিনিয়ত আমাদের মনে সঞ্চারিত হয়। দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে এই দৃশ্যমান শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে লালন করে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকেও সমুজ্জ্বল করে তুলছে। একুশের মধ্যরাত বা ভোরে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক দিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো একটি সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। কোনো চেতনা বা কোনো ভাবাদর্শ যখন সমগ্র গোটা জাতির অস্তিত্বে মিশে যায় তখন তার প্রকাশ রীতি ব্যাপক রূপ ধারণ করে। আমাদের মহান একুশ তারই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। একুশ পরবর্তী সময়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তারই সফল পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। একুশের মধ্যেই আমরা বাঙালি সত্তাকে খুঁজে পাই। একুশের মিছিল, একুশের গান সেই অপশক্তিকে রুখবার জন্য আমাদের সামনে এসেছে বারবার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবিস্মরণীয় একটি ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গান, রবীন্দ্রনজরুলের গান, দেশাত্মবোধক গানসহ স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত নানা ধরনের গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছে। এসব গানের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বেজে উঠতো একুশকে নিয়ে রচিত কিছু গান। একুশের ইতিহাস যেমনি গৌরবময়, তেমনি একুশের গানের ইতিহাসও তাৎপর্যময়। একুশকে বলি আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের প্রথম সিঁড়ি। একটি অসামপ্রদায়িক বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের স্বপ্নবীজ একুশেই রচিত হয়েছিল। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেরই সেই আন্দোলন সংগ্রামে অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। এই ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখা ব্যক্তিকে আমার ভাষা সংগ্রামী বা ভাষা সৈনিক নামে অভিহিত করে থাকি। একুশের সেই আন্দোলন সেই সময়ের কবি সাহিত্যিকদের মনকেও ছুঁয়ে গেছে। সময়ে সময়ে তাঁরা সৃষ্টি করেছেন কিছু কালজয়ী একুশের গান। স্বাধীনতা পূর্ববতী সময়ে সেইসব গান আমাদের নানা প্রেরণা যুগিয়েছে নানা আন্দোলন সংগ্রামে। একুশকে নিয়ে গানের যে চর্চা সেটা একুশ পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় বা পররবর্তী সময়ে বিদ্যমান ছিল এবং এখনো আছে। এই কারণে আমাদের শিল্পী সাহিত্যিকদের কাছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একুশের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দুটি অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে আছে। একুশের কথা আসলেই প্রথমেই যে গানটির কথা মুহূর্তেই মনকে একটা দারুণ আবেগে আচ্ছন্ন করে রাখে সে গানটি হলো আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।’ এ গানটি শুনলেই মনে পড়ে রক্তে রাঙা রাজপথে ছেলেহারা মায়ের অশ্রুভেজা দুনয়নের করুণ আর্তনাদ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তৎকালীন ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন; যা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সে সময় ছাত্রজনতার মাঝে বিলি করে। সে সময় তিনি ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে গিয়ে দেখতে পান সেখানে পড়ে আছে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের মরদেহ। এ লাশ দেখে মনে হয়েছিল এটি যেন তার আপন ভাইয়েরই রক্তমাখা মরদেহ। এ সময়ই তাঁর মনের ভেতর এ কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো প্রস্ফূটিত হয়। গানটিতে প্রথম আবদুল লতিফ সুরারোপ করলেও আলতাফ মাহমুদের সুরই এটিকে অনন্য এক উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে এবং ১৯৫৪ সালে প্রভাতফেরিতে এ সুরে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। তারপরে তো সবই ইতিহাস। এ গানটি প্রথম চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন জহির রায়হান ১৯৬৯ সালে। স্বাধীনতার আগে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে এ গানের ব্যবহার তাঁর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। গানটি গাওয়া হয়েছে ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, হিন্দিসহ মোট ১২টি ভাষায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এ গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। একুশের গান এভাবেই জাগরিত করেছে মুক্তিযুদ্ধকেও। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রখ্যাত গীতিকার ফজলখোদা রচিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম /সকল শহীদ স্মরণে’ এই গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতো। এ গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী আব্দুল জব্বার। সংগীত শিল্পী আবদুল লতিফের কথা ও সুরে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটি লেখা হয়েছিল ১৯৫১এর শেষের দিকে। নিজের ভাষার গুরুত্বকে কী সুন্দরভাবে শিল্পী আবদুল লতিফ উপস্থাপন করলেন এবং সকল বাঙালির হৃদয়কে যেন ছুঁয়ে গেলেন। অনবদ্য এক কথ্যভাষায় রচিত এ গানটি মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অন্যান্য দেশপ্রেমমূলক গানের পাশপাশি বেজে উঠতো প্রতিনিয়ত। গানটি যেন এখনো প্রতিটি বাঙালির মনেরই কথাই বলে। এছাড়াও আবদুল লতিফের আরেকটি গান ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারো দানে পাওয়া নয়।’ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি জাতির ত্যাগও স্বাধিকার আন্দোলনকে হৃদয়স্পর্শী সুরের দোলা দিয়ে গানটিতে ভিন্ন এক আবহ তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশিত গানগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম একটি গান। লোকজ গানের গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদ লিখেছিলেন রফিক, সালাম, বরকতের রক্তে ভেজা রাজপথ স্মরণ করে মর্মস্পর্শী একটি গান– ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি/তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।’ অনেকটা পল্লীগীতির ঢঙে সুরারোপিত গানটি এখনও বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ কথাটির মধ্য দিয়ে একাত্তরের গণহত্যার চিত্রও ভেসে উঠতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এ গানও আমাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল। ভাষা সংগ্রামী গাজিউল হক অমর একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখা ‘ভুলবো না ভুলবো না/ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি/ ভুলবো না’গানটি একুশের প্রথম গান। তিনি তাঁর লেখনীতে তা উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৩৫৫ সাল পর্যন্ত একুশের প্রভাতফেরিতে গাওয়া হতো শীর্ষস্থানীয় ভাষা সংগ্রামীর এই গানটিই। গাজীউল হকের ছোটভাই নিজামউল হকের সুর করা এ গানে তাঁরা দুজন মিলেই গানটি প্রথম কণ্ঠ দেন। গণসংগীতের আদলে এ গানটিও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শিল্পীদের কণ্ঠে পরিববেশিত হতো। তবে অনেকের মতে, মোশারফ উদ্দীন আহমেদ নামে একজন ব্যক্তি ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম একুশ নিয়ে ‘মৃত্যুকে যাঁরা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ শিরোনামে একটি গান লেখেন। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় আমাদের একুশের দুটি গান স্থান পায়। এতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি তৃতীয় এবং ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ১২তম স্থান লাভ করে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন তখনকার রাজনীতির ধারাকে ভিন্ন এক দর্শনের দিকে ধাবিত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে শিল্প সাহিত্য ও রাজনীতিতে একুশ একটি অনিবার্য স্থান দখল করে নেয়। এই একুশকে নিয়ে শুধু এ গানগুলো নয়, আরো বহু গান রচিত হয়েছে। এখানে উল্লেখিত গানগুলো শুধু একুশের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বৃত্তে আবদ্ধ থাকেনি। গানগুলো ভাষা আন্দোলনের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণার উৎস হিসাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পীদের কণ্ঠে অস্ত্র হয়ে উঠেছে বারবার।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্কুল কারিকুলাম
পরবর্তী নিবন্ধপরিবেশ-বান্ধব বিনিয়োগ ও বাস্তব পর্যালোচনা