পরিবেশ-বান্ধব বিনিয়োগ ও বাস্তব পর্যালোচনা

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আবুধাবিতে ১৩তম ডব্লিউটিও আয়োজিত মন্ত্রী পর্যায়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সম্মেলনে বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আগামী ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ কারণে ওই সময়ের পরও আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে আরও ছয় বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা বহাল রাখার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করেছে। সাথে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত প্রতিপালনে সম্প্রতি ৪৩টি পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে কৃষি, মৎস্য এবং শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনে ভূর্তকি হ্রাস করা হবে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার অন্যান্য শর্ত পরিপালনে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে অর্থাৎ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি তিনটি বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সংযোগ স্থাপন। স্থানীয় বিনিয়োগের সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ধারায় বিশেষ অবদান রাখে। দেশের উন্ন্‌য়নের সূচনালগ্ন থেকে একটি প্রতিযোগিতামূলক দেশ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। এছাড়াও লক্ষ্য ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করে দেয়া। এখন লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে নিজেদের উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং এটিই দেশের অন্যতম শক্তি হবে। স্বাভাবিকভাবে বেসরকারি খাত নির্ভর প্রবৃদ্ধির জন্য অনেক ধরণের সহযোগিতামূলক বিনিয়োগনীতি প্রণয়ন জরুরি।

সরকার বৃহত্তর বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সারা দেশে ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩৯টি হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ গুলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ আরও বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “এককভাবে কোন দেশ যদি এক খণ্ড জমি চায় আমরা তাও দেব। আবার কেউ যদি যৌথ উদ্যোগও বিনিয়োগ করতে চান সেটাও করা হবে অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে করতে চাইলে সেটাও করা হবে”। বিদেশি বিনিয়োগের সহযোগিতার জন্য সরকার অনেক সংস্থা তৈরি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), বাংলাদেশ ইকোনমিক প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি (এইচটিপিএ) ও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপিএ)। বিনিয়োগের সুবিধার্থে বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ওয়ান স্টপ পরিষেবাও চালুর কথা বলা হয়েছে। কর মওকুফ, রেমিট্যান্স রয়্যালিটি প্রস্থান নীতি, লভ্যাংশ ও মূলধন সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন, আইন দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষা সহ বিনিয়োগ নীতিকে আরও সহজ করার জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগ। সরকারের দেশিবিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ‘জাতীয় শিল্পনীতি২০২২’। এ সরবরাহ খাত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংশ্লিষ্টখাত এবং পর্যটন খাতকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ব্লুুইকোনমি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে সরকার। বাংলাদেশে এখন জ্বালানি, পানি, লজিস্টিকস্‌ ও পরিবহণ খাতে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো গড়ার সুযোগ রয়েছে।

২০২৫ সালের মধ্যে শুধু লজিস্টিকস খাতে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় ও শক্তিশালী রপ্তানি কৌশল এবং শিল্পনীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। ২০৩১ সালের মধ্যে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত করতে চাইছে সরকার।

শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয় সমূহ ও বাণিজ্য সংহত করণের ফলে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশের মাথাপিছু আয় একদশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন খাত ছাড়াও অর্থনৈতিক প্রবদ্ধির এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে ব্যক্তিখাতে ভোগ বৃদ্ধি। যাকে প্রাথমিকভাবে সহায়তা করেছে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ, শক্তিশালী ও জ্বালানি খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

দেশে অধিক বিনিয়োগ মানেই হলো অধিক কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সমূহের স্ববিরোধী নীতি ও দীর্ঘসুত্রিতা বিদেশি বিনিয়োগ ও দেশীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইমেজ সংকট সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ খুবই জরুরি। সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আগ্রহী হতে হবে। নেতিবাচক মনোভাব পরিহার একান্তই জরুরি।

বিনিয়োগকারীদের সর্বাত্মক সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। গ্যাস সরবরাহে দীর্ঘসূত্রতায় বিনিয়োগকারিদের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বেজা কর্তৃপক্ষ ও গ্যাস সরবরাহ কর্তৃপক্ষের মাঝে গ্রাহক সেবায় একপ্রকার অনীহা লক্ষ্যণীয়।

দেশিবিদেশি বিনিয়োগকারিদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের বিষয়ে সরকার প্রধান আন্তরিক হলেও অবকাঠামোগত সুবিধাদি প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা, দীর্ঘসূত্রতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং বিভিন্ন সুবিধাদি প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের নিলিপ্ত ভূমিকা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মাঝে নেগেটিভ বার্তা দিচ্ছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।

শিল্প বিনিয়োগকারীরা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারিদের নিকট জিম্মি। তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছার উপর যেন বিনিয়োগকারির ভাগ্য নির্ভর করে। যা একটি উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে মোটেই কাম্য নয়। স্বাভাবিকভাবে বহিঃবির্শ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডভ্যালু অনেক কম। ইনভেষ্টররা বাংলাদেশের কথা শুনলেই মনে করে ভিন্ন পরিবেশের কথা। চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেড, চট্টগ্রাম রপ্তানিকরণ অঞ্চল (বেপজা) সহ স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা শিল্পাঞ্চল সমূহে গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা এবং অবকাঠামোগত সকল নির্মাণ কাজ ও মেশিনারী আমদানি করে অলস হয়ে বসে থাকলেও গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদনে যেতে পারছেনা। দীর্ঘ সময় ধরে আবেদন করেও কোন সুফল তারা পাচ্ছে না। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অসময়ে বিনা নোটিশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ, গ্যাস স্বল্পতা এবং গ্যাসের চাপগত সমস্যায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এসব কারণে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এক প্রকার শংকার মধ্যে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে এ অবস্থা হতে উত্তরণ জরুরি। এ পরিস্থিতিকে সামগ্রিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ সৃষ্টি করে তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। এবিষয়ে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি। সম্প্রতি চায়না ইকনোমিক জোন, বাঁশখালিতে এস আলম ইকনোমিক জোন, মহেষখালি ইকনোমিক জোনে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও তাদের চাহিদানুযায়ী গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার বিষয়ে তারা সকলেই সন্দিহান।

সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, ‘অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছেন। গ্যাস আমদানির দিকে নজর না দিয়ে আরো দশ বছর আগে স্থানীয়ভাবে গ্যাস উৎপাদনের দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে প্রতিদিন আরো ১ হাজার এমএম সিফটি গ্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। দেশিয় ফিল্ড থেকে গ্যাস প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ৪ টাকা। একই পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে সরকারের খরচ হয় ৬০ টাকা।

সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করণের জন্য সকল বিনিয়োগকারীদেরকে আবেদনের সাথ সাথে প্রয়োজনীয় গ্যাস পানি বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করা একান্তই জরুরি।

তাদের চাহিদানুযায়ী বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন ও উন্নত দেশে পরিণত হতে সরকারের সকল সেবামূলক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। লোকবল ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে শিল্প বান্ধব হতে হবে। সে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে শিল্প বিনিয়োগকারীদেরকে সেবা প্রদানে বিলম্ব ও অসহযোগিতামূলক মনোভাব দেখা যাবে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সততার মানে অসহযোগিতা নয়। এ বিষয়গুলো বুঝা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের সকল পর্যায়ে বিনিয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহারের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে পুরোপুরিভাবে বের হওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষা আন্দোলনের গান
পরবর্তী নিবন্ধ‘ভালোবাসো, ভালো করো, প্রাণ মনে হও ভালো’