স্বর্ণ প্যাগোডার দেশে নারী কেবল সেবাদাসী, সন্ন্যাসী নয়

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমারের মান্দালে শহরে রয়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বই। তবে এই বই আবার কাগজে ছাপানো না, এই বই ছাপানো হয়েছে মার্বেল পাথরে। ১৮৬০-১৮৬৮ সাল পর্যন্ত ৭২৯ টি মার্বেল পাথরের উপর এই বই খোদাইয়ের কাজ চলে। মূলত বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র ত্রিপিটক এবং আরও কিছু লেখা বার্মিজ ভাষায় লেখা হয় এই মার্বেল পাথরের বইয়ে। মান্দালে শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে কুথোদও প্যাগোডায় এই বই রয়েছে।
প্যাগোডায় ঢুকতেই দরজার কারুকাজ দেখে আমি মুগ্ধ। তারপর দেয়াল জুড়ে নানা পৌরাণিক কাহিনী-চিত্র। সোনালি রঙের মূল প্যাগোডার চারপাশে ঘুরে ঘুরে স্থাপন করা হয়েছে সাদা রঙের মার্বেল পাথরে খোঁদাইকৃত বইয়ের পাতাগুলো। আমরা সরাসরি পাথুরে বইয়ের পাতার ভেতর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বইয়ের ভাষা পড়তে না পারলেও, আমরা জানি এই সব খোঁদাইকৃত পাতায় লেখা আছে একজন দার্শনিকের বাণী যিনি মানুষকে আত্মার মুক্তির কথা বলেছেন, প্রার্থনা করেছেন পৃথিবীর সকল প্রাণীর সুখ এবং শান্তির জন্য।
অনেক বড় খোলা মাঠের উপর সারি সারি মার্বেল পাথরের স্লব দেখে কবরের পাথরের ফলকের কথা মনে পড়ে যায়। এই পাথরের উপরেই লেখা হয়েছে ইহজগৎ থেকে মুক্তির কথা, আবার এই পাথরের ফলকেই লেখা হয় জীবদ্দশায় কৃতকর্মের কথা। তার মাঝে ঝুলছি আমরা- সৃষ্টির সকল প্রাণী। নাকি জীবন বা মৃত্যু কিছুই মানুষকে আসলে ছুঁয়ে যায় না? রবি ঠাকুরের কথার মতো- ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে।’ মানুষ তার মৃত্যুর পরেও কি থেকে যায় তার কাজে বা কথায়? এই যে মহাপুরুষেরা নানা পথের কথা বলেছেন, তাঁদের কি মৃত্যু হয়েছে?
এমন সব ভাবনায় যখন মাথা ভনভন করছে তখন একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি ঘাসের উপর বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে একটা পরিবার। ওরাও ঘুরতেই এসেছে, সাথে নিয়ে এসেছে খাবার। বেশ পিকনিক পিকনিক ভাব। আমি আর মিকাও কিছুক্ষণ বসলাম এক জায়গায়। মাথার উপর বয়সী বৃক্ষের ছায়া। মনে বেশ শান্তির ভাব। আসতে আসতে আমরা মূল প্যাগোডার ভেতরে গেলাম। নানা প্রার্থনা চলছে নববর্ষ উপলক্ষে। এক জায়গায় দোকান সাজিয়ে বসে বিক্রি করছে বুদ্ধের নানা প্রতিকৃতি, আবার রঙ্গিন সব ঘর-সাজাবার জিনিস। একটা পিতলের ভাস্কর্য আমার খুব পছন্দ হল, কিন্তু কেনার সাধ্য নেই। ঘরে আনতে পারিনি তাতে কি, ইচ্ছেমত চোখের তেষ্টা মিটিয়ে নিলাম। আচ্ছা, রাস্তাঘাটে আমরা যে অগণিত চক্ষু লালসার শিকার হই, সেইসব চোখের মালিকদের মাথায় কি এই একই ভাবনা চলে!
বৃটিশরা যখন মান্দালে শহর দখল করে তখন তারা চোখে দেখে শান্তিতে একমত ছিল না, তারা ইচ্ছেমত দখল করে নিয়েছে শহরের যা কিছু পছন্দ সব। লুটপাট করেছে মনি-রত্ন, ধ্বংস করেছে স্থাপনা। এই প্যাগোডাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তালেবান আফগানিস্থানে বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করেছিল বলে পশ্চিমারাই আবার ‘গেল গেল’ রব তুলেছিল। তারা ভুলে গেছে, তাদের তৈরি জালে এই প্রাচ্যের রাজনীতি বন্ধ। সে যাই হোক, বৃটিশ সৈন্যদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নিতে রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে বিশেষ আবেদন করতে হয়েছিল বার্মিজদের। তারপর ১৮৯২ সালে আবার এই মন্দিরের সংস্কার হয়।
মান্দালে শহরের কাছেই রয়েছে নারীদের জন্য একটি বৌদ্ধ আশ্রম। বৌদ্ধ ধর্মে নারীর অংশগ্রহণ দেশভেদে ভিন্ন। যতটুকু জানা যায়, শুরুতে কোন নারীর পূর্ণভিক্ষুত্ব লাভের কোন বিধান ছিল না। গৌতম বুদ্ধের মাসি, যিনি তাঁকে লালন-পালন করেছেন, মহাপ্রজাপতি গৌতমি হলেন প্রথম নারী যিনি ভিক্ষুত্ব লাভ করেছিলেন। এ বিষয়েও নানা মতবাদ প্রচলিত। কোথাও বলা হয়েছে গৌতম বুদ্ধ চারবার মহাপ্রজাপতির আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন। তারপর বুদ্ধের সাথী আনন্দ তাঁকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে রাজি করান। আবার কোথাও বলা হয়েছে এটি সত্য নয়। তবে মহাপ্রজাপতি গৌতমিকে কয়েকটি শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল বলে প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল, একজন নারীকে অবশ্যই দীক্ষা নিতে হবে একজন পুরুষ ভিক্ষুর কাছ থেকে; নারী ভিক্ষু সবসময় পদাধিকার বলে পুরুষ ভিক্ষুর নিচে থাকবেন, পুরুষ ভিক্ষুর কথার প্রতিবাদ করা যাবে না এবং কটাক্ষ করা যাবে না। সব কিছুর পরেও নারী ভিক্ষুর সংখ্যা খুব কম ছিল। এক সময় মিয়ানমার থেকে নারী ভিক্ষুরা শ্রীলংকায় গিয়ে দীক্ষা নিয়ে আসত। কিন্তু, মিয়ানমারে ফেরত এলে নারী ভিক্ষুদের গেরুয়া কাপড় খুলে নিয়েছিল বলে শোনা যায়। আবার তারা যখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাবার সংগ্রহ করত তখন তাদের রান্না খাবার দেয়া হত না, দেয়া হত কাঁচা খাবার যা রান্না করে নিতে হত। বোঝানোর চেষ্টা করা হত যে নারীর কাজ কেবল রান্না-বান্না। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে একসময় মিয়ানমারে আর কোন নারী ভিক্ষু রইল না। পুরুষ ভিক্ষুদের যেমন ভিক্ষুসংঘ আছে, নারীদের ছিল ভিক্ষুণীসংঘ। কালক্রমে সেটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। বিগত কয়েকশ বছরে চেষ্টা করেও ভিক্ষুনীসংঘ আর চালু করা যায়নি মিয়ানমারে। আবার পাশের দেশ চীন থেকে কোন নারী দীক্ষা নিয়ে এলে তাঁকে স্বীকার করে না মিয়ানমারের পুরুষ ভিক্ষুরা। প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতায় আর না যাই। তাহলে প্রশ্ন আসে, নারীদের অবস্থা তাহলে কোথায় মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মচর্চায়? এখানে নারী ‘নান’ হতে পারে, কিন্তু ভিক্ষুণী নয়। বার্মিজ ভাষায় ‘নান’ কে বলে থিলাশিন। এরা গেরুয়া কাপড় পরে না, হাল্কা গোলাপি কাপড় পরে। কয়েকজনের লেখায় পড়েছিলাম, এখনো খাবারের জন্য বের হলে, নারীদের অনেক সময় রান্না করা খাবারের পরিবর্তে রান্নার উপকরণ দেয়া হয়। আবার আশ্রমে ফিরে থিলাশিনদের সেই উপকরণ দিয়ে রান্না করতে হয় নিজেদের জন্য এবং আশ্রমের পুরুষদের জন্য। দিনশেষে নারী ‘নান’দের সাধনার সময়কেও ভাগ করে দিতে হয় অন্যের সেবায়। তবে চীন, জাপানে আবার এই চর্চা নেই। সেখানে নারীও ভিক্ষুত্ব লাভ করার অধিকার রাখেন। প্যাগোডা থেকে ফিরে গেলাম হোস্টেলে। গলির মুখে রাস্তার উপর পাড়ার মেয়েরা বসে পিঠা বানাচ্ছে। আমি আর মিকাও ওদের সাথে হাত লাগালাম। বাংলাদেশের ‘ম্যারা’ পিঠার মত চালের গুড়ার ময়াম করে, দুই হাতের তালুতে ঘুরিয়ে গোল গোল গোল্লা করে তারপর ফুটন্ত গরম জলে সিদ্ধ করলেই হয়ে যায় পিঠা। তারপর পাড়ার সবাই মিলে একসাথে বসে মাংস দিয়ে খায়। পরের দিন আমরা থাকবো বলে আমাদের কিছু পিঠা দিয়ে দিল একটা পলিথিন ব্যাগে করে। ফেরার পথে পথ আটকে দাঁড়ালো পাড়ার কয়েকজন কিশোর। ওরা কয়েকবারই আমাদের পানিতে ভেজাতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা অনুরোধ করাতে আর ভেজায়নি। এখন ওদের আব্দার আমাদের একটু হলেও পানিতে ভিজতে হবে। ওদের সাথে যোগ দিল কয়েকজন শিশু। পিঠা বানাচ্ছে যারা, তারাও সমানে চিৎকার করে উৎসাহ দিল। অগত্যা শেষবারের মত পানিতে ভিজে শেষ করলাম আমাদের বার্মিজ নববর্ষ উদযাপন।
rupsbd@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধকানাডায় ৫০ ভাগ বেড়েছে বাড়ির দাম কিনতে পারবেন না বিদেশিরা
পরবর্তী নিবন্ধসামাজিক অস্থিরতার শিকার যখন নারী