সামাজিক অস্থিরতার শিকার যখন নারী

রিতু পারভী | শনিবার , ৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

মানুষ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। অস্থিরতার তীক্ষ্ম নখরে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে নিত্যকার জীবন। কে কীভাবে অন্যের জীবনকে প্রভাবিত করবে তার প্রতিযোগিতা চলে অহর্নিশ, বিচারের মজলিস বসে পথেঘাটে আর নারী এর সহজ শিকার। নারীর চলন বলনকে আক্রমণ করে অবদমনের সকল দ্বেষ উগড়ে দেয়া হয় আর আক্রমণের হাতিয়ার হয় ধর্ম যা দিয়ে নাজেহাল করা যায় অতি সহজে।
কোন এলাকার জীবনযাত্রার সাথে সেই এলাকার হাজার বছরের সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে। একেকটি এলাকার একেক ধরনের সামাজিক বৈশিষ্ট্য আছে, আছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং তা জড়িয়েই সেই এলাকার মানুষের নিত্যজীবন, আচারআচরণ, পোশাক-আশাক, সামাজিক রীতিনীতি কালক্রমে বহমান। এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন কৃষ্টির গোষ্ঠীর বাস। ধর্মীয় প্রভাব উপরিভাগে কিছু পরিবর্তন আনলেও জীবনযাত্রায় হাজার বছরের যে অভ্যাস তাতে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। তাইতো বাঙালি মুসলিম গোষ্ঠী মাছ, ভাত, ভাজি, ভর্তা, শাকসবজি, পান্তা ইলিশ, দই চিড়া খাওয়ার যে অভ্যাস তা পালটে খেজুর আর শুকনা রুটি করতে পারে না। শাড়ি, লুঙ্গি ফেলে দিয়ে জোব্বায় অভ্যস্ত হতে চায় না। খাবার, পোশাক প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতির এক অতি জরুরি অনুষঙ্গ যা চাপিয়ে দিয়ে পরিবর্তন করা অসম্ভব।
বিশ্বের প্রেক্ষাপট অতি দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেকগুলো বড় বড় ঘটনা অস্থির করে তুলেছে সামাজিক জীবন যার সরাসরি প্রতিক্রিয়া পড়ছে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। ধর্মের বাড়াবাড়ি অনেক ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে সীমা। ধর্মকে অস্ত্র করে নারীকে আক্রমণের সহজতম পথটা ব্যবহার করা হচ্ছে যথেচ্ছা। উচ্চ শিক্ষিত হতে অশিক্ষিত সকল অবস্থানের মানুষ, কী পুরুষ কী নারী এই অস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের অবদমনকে খুব বাজে ভাবে ব্যবহার করছে। ধর্মই যদি এর মূল কারণ হতো তাহলে সমাজে শান্তি বিরাজ করতো। কেউ ঘুষ খেতো না, অন্যায় করতো না। অতি দরকারী ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর ব্যাপক চর্চা হতো কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাই বোঝাই যায় ধর্ম এখানে একটা অস্ত্র বৈ কিছু না। অন্যের ধর্ম পালন এবং মতামতের সম্মান দেয়াকে সকল ধর্মেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কারণ সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তা জরুরি।
অতি সমপ্রতি নারীদের টিপ পরিধান নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যে তোলপাড় তা মূলত এক প্রতীকি প্রতিবাদ। নারীকে অবদমনের যে কূট কৌশল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মাত্র। টিপ পরিধান এই এলাকার সংস্কৃতির একটা অংশ। অনেক ধর্মপ্রাণ নারীও নিজেকে নিজের মতো সাজাতে টিপ পরিধান করে। একটি বিশেষ ধর্মের নারীদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ টিপ এই চিন্তা করে তারা টিপ পরিধান করে তা কিন্তু মোটেও না। বাঙালি বহু বছরের সংস্কৃতির অংশ এই সাজ। নারীদের মাথা ঢেকে রাখা অন্য অনেক ধর্মের রীতি। সেটা নিতে যদি সমস্যা না হয় তাহলে অন্য সংস্কৃতির অনেক কিছুই অন্য ধর্মের অংশ হতেই পারে। আর টিপ পরিধান নিয়ে ধর্মীয় যে ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে তাতেও গরমিল আছে, তথ্যের ভুল উপস্থাপন হচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বোঝা যায় অসহিষ্ণুতার চর্চা ভীষণভাবে বেড়ে গেছে অথচ সকল ধর্মে অসহিষ্ণু হওয়াকে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
সমাজের মধ্যে বিরাজমান অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ খুব জরুরি। সকল অনিয়ম, অযাচার, বাড়াবাড়ির রাশ এখনই টেনে না ধরলে, নারীকে পথেঘাটে, বাসে-ট্রেনে, ওয়াজ-মাহফিলে, মেলা-আড্ডায়, রাস্তাঘাটে হেয় করা বন্ধ না করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বর্ণ প্যাগোডার দেশে নারী কেবল সেবাদাসী, সন্ন্যাসী নয়
পরবর্তী নিবন্ধমানুষের সেবা করতে বিত্তের পাশাপাশি চিত্তের প্রয়োজন