সুরসম্রাজ্ঞী-মর্মস্পর্শী গানের শিল্পী গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাখ্যায়

ডা. দুলাল দাশ | শনিবার , ৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যয় বলতে বাংলা গানের ভুবনে প্রতিভাবান এক মরমী শিল্পীর নাম। উভয় বাংলার সাঙ্গীত প্রেমীরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে বাংলা গানের এই প্রবাদ প্রতিম শিল্পীকে। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী, হৃদয়স্পর্শী কিংবদন্তি, বাংলা গানের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়িকা যার কণ্ঠস্বর ছিল মিষ্টি মধুর, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। তার প্রতিটা গান যারা গান ভালোবাসেন নিশ্চয়ই মন-প্রাণ দিয়ে শুনেছেন এবং মনে মনে দৃশ্য পর্ব কল্পনা করেছেন, আমাদের শৈশব, বয়:সন্ধি আমাদের যৌবনে তার গানে মাতোয়ারা ছিলাম এবং এই প্রবীণ বয়সেও সন্ধ্যাদির গান মনে প্রাণে উপলব্ধি করি। যখন স্কুলে পড়তাম অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে উনার গান শোনার জন্য ছুটে যেতাম। দূরে কোথাও রেকর্ড বাজলে কান আলগে করে শুনতাম। আমি যে উনার গানের প্রতি কত অনুরাগী ছিলাম এবং উনার কত বড় ফ্যান তা একটা ঘটনা থেকে বুঝা যায়। বহু বৎসর আগের কথা সিনেমা হলটির নাম ছিল ‘নিরালা সিনেমা’ পরে নাম পাল্টে হল ‘রঙ্গম’। কতদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে মেটিনি শোতে সেই সিনেমা হলের দরজায় কান পেতে থাকতাম অগ্নিপরীক্ষার সিনেমার হৃদয়স্পর্শী সেই গানটি শুনার জন্য ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’/ ‘কে তুমি আমারে ডাকো’। আজ সেসব শুধু স্মৃতি। একবার কোনো এক অনুষ্ঠানে যেখানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে বলা হলো ‘আপনি কোন গানটা শুনতে চান’ সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘গানে মোর কোন ইন্দ্র ধনু’। তিনি অগনীত ছায়াছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন এবং প্রত্যেকটা ছবি হিট হয়েছে। সে সময় এক একটা ছবি তিন চার বার দেখেছি। যেমন সাগরিকা, অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, পথে হলো দেরি আরও অনেক যেখানে সুচিত্রা উত্তম জুটি ছিল। তাদের রোমান্টিক দৃশ্যগুলিতে যে গান থাকত সবকটা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গাওয়া। তাই দৃশ্যগুলি খুবই মনোমুগ্ধকর ও উপভোগ্য হয়ে উঠতো।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর জন্ম ১৯৩১ সালে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন, ছিলেন নিরহংকারী, সদালাপী এবং খুবই অসাম্প্রদায়িক। সেই চল্লিশের দশকে যখন শুধু ‘ছুওনা ছুওনা’ সেই সময় তিনি বড়ে গোলাম আলী খাঁ’র বাড়িতে যেতেন এবং খেতেন। শিল্পী হিসাবে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ’র হাতে। অবশ্য পিতার হাতেও শিক্ষা নিয়েছিলেন। লতা মুঙ্গেশকরের মত তিনিও সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁকে গীতশ্রী সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল তার ১৪ বছর বয়সে। যারা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ ও ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ২০১১ সালে সন্ধ্যাদিকে বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সমাজ তাঁর কণ্ঠ মনে প্রাণে শুনেছেন। নিষ্ঠুর হৃদয়ও তাঁর গানে গলে যায়। মমতার প্রাণের মানুষ ছিলেন তিনি। ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর শবযাত্রা গানে গানে মুখরিত ছিল। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মমতা তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন।
ছাত্র জীবনে দেখেছি চট্টগ্রাম শহরের টেরিবাজার, লালদিঘির পূর্বপাড়, হাজারি গল্লি, জে.এম. সেন হল প্রাঙ্গণ এবং আরও প্রচুর জায়গায় জমজমাট স্বরস্বতী পুজো হতো। তখন কাছের ও দূরের পূজা মন্ডপে মাইকে সন্ধ্যার, হেমান্তর, শ্যামল মিত্রের গান বাজানো হতো এখনও হয়। আমরা পূজা দেখতে গিয়ে এই গানগুলি আমাদের বেশি আকৃষ্ট করতো। তেমনি গ্রামে যখন যেতাম সেইখানেও দূরের গ্রাম থেকে এই জনপ্রিয় শিল্পীদের গান মাইকে ভেসে আসতো, কত মধুর লাগতো। যেহেতু গ্রাম নি:স্তব্ধ ছিল তাই সন্ধ্যাদির জনপ্রিয় গানগুলি মন কেড়ে নিত। আমি যখনকার কথা বলছি তখন ক্যাসেট ছিলনা বিধায় গানগুলি বাজানো হতো হিজ মাস্টার ভয়েজ গ্রামফোন রেকর্ডের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও আমাদের টেলিভিশন ছিল না। এক ব্যান্ডের ফিলিপ রেডিওতে গান শুনতাম। প্রতি রোববার কোলকাতা আকাশ বানী থেকে অনুরোধের আসর বাজানো হতো দুপুর দুই টায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনার জন্য রেডিওর চারিদিকে আমরা গোল করে বসতাম। সেই স্মৃতিগুলি আজও মনে দোলা দেয়। বাংলা সঙ্গীত জগতের এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বাংলাদেশকে খুবই ভালবাসতেন। তিনি নিজের দেশ মনে করতেন এবং জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নে খুব খুশি ছিলেন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল এবং সহযোদ্ধা হিসাবে কাজ করেছেন। ঐ সময় তাঁর গাওয়া গানগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের/মুক্তিবাহিনীর অনেক সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে। তেমনি ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নেওয়া এক কোটি উদ্বাসু্তদের জন্য বিভিন্ন গানের প্রোগ্রামের মাধ্যমে অর্থ জুগিয়েছেন। তিনি ঘুরে ঘুরে উদ্বাসু্তদের খবরা খবর নিতেন। কোলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলে মাঝে মাঝে দেখায় সন্ধ্যাদির সেই কালজয়ী অমর গান যা বাঙালি হৃদয়কে উদ্বেলিত করে এবং স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষদের বাঙ্গবন্ধুর আরও কাছে নিয়ে যায় ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তুমি তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়- ঘরে ঘরে এত খুশি তাই, তা আমি কি করে বোঝাই’ এই গানটি সন্ধ্যাদি গেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসার পর। সন্ধ্যাদি বোম্বেতে লতা মুঙ্গেশকরের সাথে দ্বৈত গান গেয়েছেন। ১৯৫২ সালে বাংলা গানের টানে বোম্বে থেকে কোলকাতায় ফিরে আসেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে গল্প দাদুর আসরে তাঁর প্রথম গান। প্রথম গানের পারিশ্রমিক ছিল ৫ টাকা। বিখ্যাত সুরকার শ্যামল গুপ্তের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। সেই সোনা ঝরা দিনগুলিতে বিখ্যাত সুরকারদের সুরে একের পর এক গান গেয়ে উভয় বাংলার সঙ্গীত প্রেমীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সরকারের আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসাবে ঢাকা পল্টন ময়দানে ভাষা শহীদদের স্মরণে গান গেয়েছিলেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালে। এই বিখ্যাত শিল্পী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মহাপ্রয়াণে বাংলা গানের জগতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হলো। তাঁর প্রতি রইল অকৃত্রিক ও অফুরন্ত শ্রদ্ধা। বাংলার ঘরে ঘরে তাঁর কণ্ঠ ও সুর চির জাগরুক থাকবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক : প্রাক্তন চীফ এ্যানাসথেসিওলজিক, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে