সুফিসাধক লোককবি আস্কর আলী পণ্ডিত

রশীদ এনাম | শুক্রবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

‘না রাখি মাটিতে না রাখি পাটিতে, না রাখি পালঙ্কের উপরে, সিঁথির সিঁন্দুরে রাখিব বন্ধুরে ভিড়িয়ে রেশম ডোরে, কী জ্বালা দিয়ে গেলা মোরে নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে, না দেখিলে পরান পোড়ে, কী দুঃখ দিয়ে গেলা মোরে, নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে না দেখিলে পরান পোড়ে’। গানের কথাগুলো শোনলে যে কারো হৃদয় ছোঁয়ে যাবে।
ভাঙা হৃদয়ের জন্য গানটি হবে মনের দাওয়াইয়ের মতো। গানটি লিখেছেন প্রয়াত লোককবি আস্কর আলী পণ্ডিত। তিনি ১৮৫৫ সালে (মতান্তরে ১৮৪৬) সালে পটিয়া শোভনদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ বলে তাঁর গ্রাম সাতকানিয়ার পুরাণগড়। পিতার নাম মোসারফ আলী। পিতামহের নাম ডোমন ফকির। তাঁর পুরুষদের বাড়ি ছিল সাতকানিয়ার বাজালিয়া গ্রামে। নয় বছর বয়সে আস্কর আলী পণ্ডিতের বাবা মারা যান। আস্কর আলী ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, পদকার, পুঁথিকার ও কণ্ঠশিল্পী। তিনি বেশ কিছু বইও রচনা করেছেন, বর্গাশাস্ত্র, নন্দবিহার, নন্দবিলাস, গীত বারমাস, সতী সঙ্গিনী, হাদিস বাণী ও নাটক কাজীর পাট। সুফিসাধক আস্কর আলীর পুঁথিগত বিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও যে তাঁর আধ্যত্মিক ও গায়েবি এলম ছিল সেটা বুঝা যায়। জ্ঞান চৌতিসায় তিনি লিখেছেন- ‘ধনজন হীন বিদ্যা শিখিতে না পারি, কিঞ্চিত দিলেক প্রভু সমাদর করি’।
আস্কর আলী পণ্ডিতের ‘জ্ঞান চৌতিসা’ পুঁথি নামে একটা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার জীবদ্দশায় পুঁথিটি প্রকাশিত হয়নি তার মৃত্যুর পর পুঁথিটি সর্ব প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। কবি বলেন- ‘পুন সেই পুস্তক রচিতে হৈল মতি, শ্রীযুক্ত আবদুল হাদি করিল আরতি’। জ্ঞান চৌতিসা মূলত প্রণয় কাহিনীকাব্য। আস্কর আলী পণ্ডিত শেষ বয়সের রচনা করেন ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ কবি লিখেছেন- ‘দন্ত ছিল জুবা কালে ইক্ষু খাই শুতি, তখনে কহিছি রাস চৌতিসার পুঁথি। দন্ত গেল ঝরিয়া বয়স হইল শেষ, অম্ল রস পানে এবে পিত্ত হৈল বেশ’।
সুফিসাধাক আস্কর আলীর পণ্ডিতের পূর্বপুরষদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুফিসাধক দরবেশ ছিলেন। তিনি পারিবারিক ও সামাজিক গৃহস্থালী কাজ করতেন। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ন মুসলামান সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গীতিকার আবদুল গফুর হালী আস্কর আলী পণ্ডিতের সাহচর্য পেয়েছিলেন। গফুর হালী আস্কর আলী পণ্ডিতের প্রতি খুব সম্মান দেখাতেন।
কথিত আছে আস্কর আলী যেভাবে সুফিসাধক হয়ে উঠেন। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আস্কর আলী পণ্ডিতের ঘরে বসতো ইসলামিক গানের আসর (ধারা)। রমজান মাসের এক বৃহস্পতিবারে রাতে চায়ের দোকানে বসে তার ভক্ত ও সাথীদের বললেন, তোমরা আগামী বৃহস্পতিবার আসবা না। ধারা বন্ধ থাকবে। তবে তোমরা শুক্রবারে সবাই এসো। সবাই কিছুটা বিস্মিত ও অবাক হলেন। হঠাৎ সুফি সাধক একথা কেন বললেন? সবার মনে কৌতূহল। সেদিন রাতে সবাই চলে গেলেন। একজনকে বললেন আপনি যাবেন না। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আপনি কাউকে বলবেন না। আপনি আজ রাতে কবর স্থানে গিয়ে আমার জন্য একটা কবর খনন করবেন। ১৯২৭ ইং ১২৮৮ মঘি ২৭ ফাল্গুন বৃহস্পতিবার আস্কর পণ্ডিত তারাবী নামায আদায়ের পর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিলেন। আড্ডার মাঝে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গানও গাইলেন। সবার কাছ থেকে হাসি মুখে বিদায় নিলেন। বাসায় গিয়ে পুত্র বধূকে বললেন, আমার জন্য পাটি আর চাদর ধুয়ে রাখতে বলেছিলাম রেখেছো কি ? ধুয়ে রাখলে সে গুলো নিয়ে এসো। পুত্রবধূ পরিচ্ছন্ন পাটি আর চাদর নিয়ে এলো।
অতঃপর সুফি ও লোককবি আস্কর আলী পণ্ডিত বললেন, ‘এগুলো বিছিয়ে দাও পূর্ব পশ্চিম নয় উত্তর দক্ষিণ করে বিছিয়ে দাও। বিছানা করার পর বললেন আমার মেয়েকে ডেকে এনো। মেয়েকে পাশের বাড়ি থেকে খবর দিয়ে ডেকে আনা হলো। মেয়েকে বাবার পাশে বসতে বললো। মেয়ে বসল আস্কর আলী তার মেয়েকে বললেন, আমার ডান পাশে খনন করে দেখ মাটির নিচে একটা ঘডি বা কলসি আছে। কলসি ভর্তি রৌপ্য মুদ্রা আছে। এ মুদ্রা মা তোমার জন্য তুমি তোমার নিজের জন্য এ মুদ্রা ব্যয় করো।
বাম পাশে খনন করে দেখ আরেকটি ঘডি ভর্তি রৌপ্য মুদ্রা আছে। এ মুদ্রা দিয়ে আমার জন্য একটা জেয়াফতের আয়োজন করো। এই কথা বলে তিনি চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। দু-চার মিনিট পড় সবাই দেখল কোন সাড়া শব্দ নেই। মেয়ে জামাই চাদর তুলে দেখলেন। তার শ্বশুর বাপজান আর এ জগতে নেই। রাত্রিকালে গ্রামবাসীর ঢল নামল আস্কর আলী পণ্ডিত কে দেখতে। প্রয়াত পুঁথি গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী আসকর আলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, ‘যে মৃত্যুকে চিনতে পারেনি সে কি ফকির হলো। আস্কর আলী মৃত্যুকে চিনতে পেরেছিল বলে তিনি ফকির সুফি হয়েছেন’। ১৯২৬ সালের পবিত্র রমজান মাসের কোন এক রজনীতে ৪ পুত্র ও ১ কন্য সন্তান রেখে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান। তথ্য ঋণ- প্রয়াত পুঁথিগবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী, এবং আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরিন সম্পদিত চট্টল মনীষা।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেসবুকে উস্কানিমূলক পোস্ট : যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌,আর খুতবা