সুধাকণ্ঠ প্রেম

মহুয়া ভট্টাচার্য | শনিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

(শেষ পর্ব)
কল্পনার সাথে পরিচয় হওয়ার আগেই ভূপেন হাজারিকা একটি দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে এসেছেন। আসামের ছোট্ট একটি গ্রামের দশ ভাই-বোনের অভাবক্লিষ্ট সংসারের পথ সারিয়ে।

পড়তে যাওয়ার একটি দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা এবং দেশে ফিরে এসে নিজের সংসার ও দশ ভাই বোনকে জীবনের পরিসীমায় টিকিয়ে রাখতে কম কষ্ট করতে হয়নি তাঁকে। তারপরও গায়ক ভূপেন হাজারিকার জীবনের অসাধারণ পরিবর্তনটি আসে কল্পনার হাত ধরেই। কিশোর ভূপেন হাজারিকার হাত দেখে কোনো এক জ্যোতিষী নাকি বলেছিলেন- তার জীবনের গতিপথে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসবে কেবলমাত্র একটি নারী- যিনি তার মা, বোন, কন্যা কিংবা স্ত্রী এদের কেউই নন। এখন আমরা জানি। সেই নারী নিঃসন্দেহে কল্পনা লাজমী। যদিও তিনি ভূপেনের জীবনে মাতৃকন্যা স্ত্রী, বোন সবার দায়িত্বই পালন করেছেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত- তবুও তাঁদের সম্পর্কের কোনো নাম ছিলো না। ভূপেন হাজারিকা আমৃত্যু কল্পনা লাজমীকে তার সহকারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন-কিন্তু সমস্ত পৃথিবী আজ জানে তিনি তারচেয়ে বেশি কিছু ছিলেন অন্তত যতদিন গুয়াহাটি মিউজিয়ামে কিংবা পৃথিবীর বুকে ‘আসাম’ রাজ্যটি থাকবে।
কল্পনা লাজমির ভূপেন হাজারিকার জীবনে আসার পর অসাধারণ ও অমর কিছু সৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে আরো দীর্ঘকাল তার মধ্যে ‘আমি এক যাযাবর’ গানটি অন্যতম। ‘আমি এক যাযাবর’ গানটির দর্শকপ্রিয়তার সাফল্য ছিলো এইসব গানকে ছাড়িয়ে- আকাশচুম্বী কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সময়কার কিংবদন্তি বাংলা গানের শিল্পীদের কাতারে ভূপেন হাজারিকাকে গণ্য করা হয়নি। এমনকী শ্যামল মিত্র, সুবীর সেন, হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়- এঁদের প্রত্যেকের চেয়ে কম সম্মানী পেতেন ড. ভূপেন হাজারিকা! কারণ তিনি তাঁর মেধাকে ব্যবসায়িক পণ্য করতে জানতেন না। ৪৮-এর যে-যুবক আমেরিকায় গিয়েছিলো অন্তরে সামন্তবাদের বিরোধী চেতনা নিয়ে, ফিরে এসেও তিনি তাঁর গান ও সুরে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন নিরলসভাবে। তাঁর গানে যেমন রয়েছে আর্তমানবতার কথা, তেমনি গানের সুরে ফুটে উঠেছে আসামের পাহাড়ি সুর। বৈষয়িক বিষয়ে উদাসীন এই ভূপেন হাজারিকাকে কিছুটা যুগের চলতি ধারায় আনতে কল্পনার চেষ্টার অন্ত ছিলো না। তিনি ‘আমি এক যাযাবর’ গানটির সাফল্যকে পুঁজি করে এইচএমভিতে যান ভূপেনের রেকর্ডিং বের করতে এবং এইচএমভি কর্তৃপক্ষও আনন্দে রাজি হয়। কিন্তু তাদের একটি শর্ত ছিলো, একটি ক্যাসেটের বারোটি গানই তারা একা কোন পুরুষ কণ্ঠতে গাওয়াতে চায় না। এতে তারা ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে সন্দিহান। অতএব ভূপেন হাজারিকার ক্যাসেটে একজন নারীকণ্ঠও থাকবেন। তিনি-বাংলাদেশের গায়িকা রুনা লায়লা। এইচএমভি প্রতিষ্ঠানের এই বাস্তব ব্যবসায়িক কৌশলকে ভূপেন হাজারিকার আত্মসম্মানের হানিকর মনে হয়েছিলো। সেই সময়ের জন্য এমন স্বর্ণসুযোগ তিনি এক বাক্যে নাকচ করে দেন। তিনি পুরো ক্যাসেটের বারোটি গানই একা গাইবেন এই শর্তেই এইচএমভিকে রাজী হতে হয় এবং কল্পনার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টাতে ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসা সফল রেকর্ড ‘আমি এক যাযাবর’ আলোর মুখ দেখে। আসামের গুয়াহাটি মিউজিয়ামে এই রেকর্ডটি এখনো সংরক্ষিত আছে। ভূপেন হাজারিকা যেমন ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী তেমনি ছিলেন লাজুক। নিজেকে বাইরের পৃথিবীর কাছে মেলে ধরতে চাইতেন না। কল্পনাই তাঁকে বাইরের পৃথিবীর সাথে সেতুবন্ধন রচনা করিয়ে দেন। ভূপেন হাজারিকা বাংলা ও তাঁর বাংলার মাটি, সংস্কৃতি ও ভাষার পূজা করতেন। তাঁর গানের পরতে-পরতে ছিলো মাটির ঘ্রাণ, ব্রহ্মপুত্রের সরলমাখা উষ্ণ আন্তরিক আহ্বান। জীবনের না পাওয়ার কষ্ট কথা যেমন ছিলো, ছিলো ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে! ঘুমঘুম নিঝুম রাতের মায়ায়!’ কল্পনার নিজের অসাধারণ সাফল্যমন্ডিত চলচ্চিত্রতে তার ‘দিল হুম হুম করে’ এই উপমহাদেশের সংগীতের ইতিহাসের এক অনবদ্য সংযোজন।
কল্পনার বাবা গোপী লাজমীর চেয়েও বয়সে কিছু বছরের বড় ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। কল্পনা তার বার্ধ্যকরে দিনগুলোতে সমান পরিচর্যা করেছেন যেমনটা তিনি তার পিতা-মাতার জন্য করতেন। নিজে একজন মেধাবী পরিচালক ছিলেন তা সত্ত্বেও ভূপেন হাজারিকার মেধা ও কর্মের প্রতি সমর্পিত ছিলেন কোন স্বার্থ ছাড়াই। ভূপেন হাজারিকার মতো একটি চরিত্র যিনি জীবনের শুরুতে বামপন্থী আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। পরবর্তীতে জীবনে শেষ প্রান্তে সেই রাজনৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত দর্শনে নিজেকে ভাসিয়ে দেন, মানবতার জয়গান গেয়েছেন। মানুষ যাঁর কাছে প্রথম বিবেচ্য বিষয় ছিলো, কিন্তু অন্তরের কোথাও ‘ব্রাক্ষ্মণ’ বংশোদ্ভূত না হওয়ার হীনম্মন্যতা ছিলো। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় রাস্তায় আক্রমণ করা দুষ্কৃতকারীদেও ওপর চড়াও হয়ে তিনি বলেছিলেন কল্পনা তার মেয়ে। কেউ যেন তার গায়ে হাত না লাগায়। চরিত্রের মধ্যেই এত প্রবল বৈসাদৃশ্য। স্ববিরোধিতা ছিলো। ছিলো আত্মঅহংকার ও শিশু সুলভ অভিমান -‘নঅ জাঁয়ুু, নঅ গাঁয়ুু, নঅ করু!’ (খাবনা! গাইবোনা! কিছু করবো না!) এমন শতবার গোঁ ধরে থাকা মানুষটিকে সম্মান, পদবীর দিকে এগিয়ে নেওয়া কিংবা রাজনৈতিক আদর্শে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে আগলে রেখে আসামের ‘সুধাকণ্ঠ’ হওয়ার এই কঠিন কাব্যের পথ চলার কল্পনা লাজমী ছিলেন একা নিঃসঙ্গ। একসময় ভূপেন হাজারিকা তাঁর মাদকাসক্তি কাটিয়ে নানা দেশে-বিদেশে নিজের গান পৌঁছে দিয়েছেন ভক্তদের কাছে। কিন্তু তখনও কল্পনা তার সহকারী পরিচয়েই ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনায় চার জেলায় সাংবাদিকসহ ৫ জন নিহত
পরবর্তী নিবন্ধগোল্ড ডিগার: কেবলই নারীর অপবাদ!