সুজান সনটাগ: ভাবনার অন্তর্জালে

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

প্রাকপ্রারম্ভিক আলোচনায় বলা যায়, ‘ইমেজ’ শব্দটি ইংরেজি হলেও আমাদের চলমান সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার সাথে সংযোগ স্থাপনে সুদৃঢ়। ‘ইমেজ’ বললে চিত্রপট কিংবা আলোকচিত্রের কথা মাথায় আসে, কেউ হয়তো দেখার চোখ হিসেবেই দেখেন। ইমেজ মূলত প্রতিচ্ছবি, বিপরীত দর্পণে যা ফুটে ওঠে। তবে শিল্পীর ক্ষেত্রে অন্যতম সুবিধা হলো তিনি নিজেই তৈরি করতে পারেন দর্পণে কী ফুটে উঠবে। কতটা পেরেছেন তা বিলম্বিত আলোচনা।

নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী’ ভাবতেই লোকে হয়তো ভাবেন তার গড়ন, আচরণ, কর্মের তালিকা অথবা ইমেজে নারী হলেও সেএকই আলাপ, নারীর অবয়ব। তবে একজন আলোকচিত্রী হিসেবে এই ইমেজ কতটা শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় এবং কথা বলে তা যেন জানবার আগ্রহ বহুকালের। সদ্য আলোকচিত্রে নিজস্ব আগ্রহের ধারাবাহিকতায় প্রথম প্রয়াস, ‘সুজান সনটাগ; ভাবনার অন্তর্জালে’।

যেকোনো ইমেজে বহুমাত্রায় আলোছায়ার পরীক্ষা ইমেজকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তোলে। অন্যের বাস্তবতায় আমরা কেবলই ভ্রমণ করি, কখনো তা নিজের বলেও মনে হয়। আলোকচিত্র এমন এক মাত্রা যা আমাদের পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করায়, কখনো ইতিহাস থেকে কাছে বা দূরে। ইমেজের এই মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাকে দার্শনিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক রূপে উন্মোচনে আলো ফেলেছেন, সুজান সনটাগ।

আলোকচিত্রে, অতীতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, কখনো অতীতের সাথে সম্পর্কই অবশিষ্ট রাখার প্রবণতা প্রকট। এর বেশি সব কিছুকে জানা ও নিজের মতো করে বিশ্লেষণে মনোযোগী সুজান যতটা রাজনৈতিক, ততটা মানবিক। ফলে সাহস এবং নৈতিকতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নতুন ভাবনাকে প্রতি মুহূর্তে উস্কে দিয়েছেন। সাহসকে নৈতিক গুণ হিসেবে মেনে নেননি, সত্যকে বলেছেন প্রতিনিয়ত বলবার বিষয়। সুজানের দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান সর্বত্র অবাধ বিচরণ আমাদের ভাবনাকে দিশা দিয়েছে। আলোকচিত্র পুঁজিবাদীর সমাজের যেমন, সমাজতান্ত্রিক সমাজের তারচেয়ে বেশি। আলোকচিত্র বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যেতে চেয়ে সুজান বলছেন, আলোকচিত্র কখনই পুরোপুরি তার বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে যেতে পারে না, যেমনটা পারে চিত্রকলা। আপাতত দৃষ্টিতে বিতর্কের সৃষ্টি ও ভাবনার উদ্গ্রীবতা সুজানের হাতিয়ার।

ক্যামেরা বাস্তবতাকে ধারণ না করলেও নির্ধারণ করছে আমরা কি অভিজ্ঞতা লাভ করব, যা পরবর্তীতে আমাদের সাথে একটি মৌলিক সূত্র তৈরি করবে। সুজান আলোকচিত্রের দক্ষতার চেয়ে বেশি জরুরি ভেবেছেন সঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে উপস্থিতি এবং নতুন কিছু ভাবার বা করার দক্ষতাকে। সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখেছেন, আলোকচিত্রের চূড়ান্ত রূপ কখনো রাজনৈতিক কিংবা নৈতিক জ্ঞান হয় না।

ফিরে দেখা, ১৮৭১ সালের জুনে ইউজেন দিসদেরির তোলা প্যারিসের পুলিশ কর্তৃক কমিউনার্ডদের রক্তাক্ত ধরপাকড়ের ছবিতে সুজান বলছেন, আলোকচিত্র এমন এক মাধ্যম যা ঘটনার সাক্ষ্য ও যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করে। আলোকচিত্রী চাইলেও ভান করে, এই নিষ্পাপ যৌক্তিকতাকে ঠেকাতে পারেন না। আলোকচিত্র অনিরাপদ স্থানেও আমাদেরকে অধিকার এনে দেয়।

সুজান মূলত প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসতেন, পরের সময়তে সে ছোট ছোট প্রবন্ধগুলোই বই রূপে ধরা দেয়। ‘অন ফটোগ্রাফি’, ‘এগেইন্সট ইন্টারপ্রিটেশন’, ‘ইলনেস এস ম্যাটাফোর’, ‘রিগার্ডিং দ্য পেইন অব আদার্স’ নামক উল্লেখযোগ্য বইয়ের লেখক তিনি। ‘অন ফটোগ্রাফি’র বইতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ছবি জায়গা পেয়েছে। আমরা জানি, সুজান একজন মানবাধিকার কর্মীও। অন্যায়, শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর কলম এবং ক্যামেরা সর্বদা তীর হিসেবে ছুটেছে।

তবে সুজান মানতেন, আলোকচিত্র কখনো নৈতিকতা জোরদার করতে পারে না কেবল জাগিয়ে তোলে। সুজান ছবিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন দারুণ। যুদ্ধ, গণহত্যা, পরিবেশ হত্যার বিরুদ্ধে যারা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে সকল আলোকচিত্রকে এক কাতারে তুলে এনেছেন। আলোকচিত্রকে মূল্যবান হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যেহেতু এটি তথ্য প্রদান করে। আর আলোকচিত্রের ইমেজ এতটাই শক্ত যে, তা পৃথিবীর বাদবাকি সব কিছুকে একটি সীমানায় ফেলেছে। তবে সুজান বলছেন তাদেরও কথা যারা, শিল্পায়িত সমাজে নন্দনতত্ত্বের ভোগবাদিতায় মোহিত আছেন।

আলোকচিত্র কেবল ইমেজ নয়, কেননা এটি বাস্তবতার ব্যাখ্যাও। একটি পুঁজিবাদী সমাজের ইমেজ নির্ভর সংস্কৃতির প্রয়োজন হয়। কেননা লিঙ্গ বৈষম্য, অন্যায়, শ্রেণি শোষণ, ইত্যাদি আঘাতের বিরুদ্ধে ঔষধ হিসেবে কাজ করে বিনোদন। প্রাকৃতিক, কৃত্রিম তথ্যের জন্যে আলোকচিত্রকে পুঁজিবাদী হাত হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। যাতে করে তারা তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে চলতে পারে। কেন যুদ্ধের ছবি খুব প্রচার হচ্ছে, যুদ্ধ কিংবা নারীর সরাসরি অবয়বকে আশ্রয় করে আলোকচিত্রকে দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে সব যেন সুজানের চোখ এড়ায়নি। পুঁজিবাদী সমাজে আলোকচিত্র এমনভাবে ব্যবহৃত হয়, যা মানসিক ও শারীরিক প্রতিবেশ বিনষ্ট করে।

শত বছরের রাজনৈতিক,দার্শনিক জ্ঞানকে মোকাবিলা করে লিখে যাওয়া সুজান, ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে আমেরিকায় জন্ম নেন। পাঁচ বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবাকে। দর্শন, সাহিত্য, প্রাচীন ইতিহাস, ধর্মতত্ত্বের উচ্চতর পড়াশোনা পরবর্তী সময়তে আলোকচিত্রের দার্শনিক জ্ঞান, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাহায্য করেছে। এছাড়া মেটাফিজিক্স, নৈতিকতা সর্বত্র বিপুল আগ্রহ ও পড়াশোনা সুজানকে লেখার দিকের একধাপ হেলিয়ে দেয়। মূলত হতে চেয়েছিলেন ফিকশন লেখক। নিজস্ব জড়তা কাটিয়ে লিখেছেন ননফিকশন, তৈরি করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, নির্দেশনা দিয়েছেন ‘ওয়েটিং ফর গোডো’র মত নাটক। কাজ করেছেন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। আলোকচিত্রের জন্যে পেয়েছেন ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কেলসহ বহু পুরস্কার।

সুজান সনটাগ জীবনের শেষ সময় যুদ্ধ করেছেন লিউকেমিয়া রোগের সাথে, শেষ নিঃশ্বাস রেখে যান ২৮ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে। সুজান সমাজ ও শিল্পকে দেখেন নিজস্ব পর্যবেক্ষণে, উচ্চ ও নিম্নবর্গের শিল্প প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তাগুলো বৈধতা অর্জন করেছে। তবে তিনি কোনো মৌলিক ঘোষণাপত্র দিয়ে যাননি কেবল দেখার পথকে পরখ করে গেছেন।

তথ্যসূত্র: ‘অন ফটোগ্রাফি’, অনুবাদ মাহমুদুল হোসেন

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশু সুরক্ষায় সচেতন হই শিশু সহায়তায় ফোন ১০৯৮
পরবর্তী নিবন্ধরূপবান শিম চাষে সফল তিন শতাধিক কৃষক