শিশু সুরক্ষায় সচেতন হই শিশু সহায়তায় ফোন ১০৯৮

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের বাস্তবতা এই যে, এই সময়ে এসেও নারী ও শিশুর সুরক্ষা দিতে পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত নয় রাষ্ট্র। যদিও আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। তবুও কোথাও গিয়ে সমাজে সিংহভাগ নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা। আইন আছে, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ কিংবা ফাঁকফোকর গলে অপরাধীরা বেরিয়ে যায়। আর, সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা তা হলো সমাজে প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের অভাব। শিক্ষার হার বাড়ছে, একইভাবে অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তার উন্নয়ন হচ্ছে না। তার জন্য দায়ী কে! প্রশ্ন থাকতেই পারে! সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাসগুলো সবার আগে গ্রাস করে নারীকে। নারীর তথা মেয়ে শিশুর উন্নয়ন ব্যাহত হয় সমাজের চাপিয়ে দেয়া কিছু ভুল বিশ্বাসের কারণে।

যদিও আইন বলছে সমাজে ও রাষ্ট্রে মানুষ হিসেবে সকল ধর্মবর্ণলিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেরই সমান অধিকার আছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সমাজে, পরিবারে মেয়েশিশুদের জন্ম থেকে নানারকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। তার মধ্যে নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বেশি। পরিবারে কাছের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি শিক্ষক দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হয়। ঘটনার অধিকাংশই শিশুরা লুকিয়ে রাখে বড়দের ভয়ে। কারণ পরিবারের পিতামাতা তথা বড়রা এসব নিয়ে কথা বলতে চায় না। নানামুখী চাপের কারণে। সমাজ কীভাবে নেবে, অপরাধী যদি আত্মীয় বা শিক্ষক কিংবা কেউ সম্মানজনক অবস্থানে থাকেন তাহলে তার অপরাধের বিষয়ে কথা বলতে এক ধরনের দ্বিধা ও অস্বস্তি কাজ করে। ফলে যা প্রকাশ্য হয় তা নিতান্তই মুষ্টিমেয়। বাকি ঘটনাগুলো আড়ালে থাকে। শিশুরাও ভয়ে, দ্বিধায় নিজেদের কথাগুলো বড়দের বলে না। পাছে সে নিজেই বিপদে পড়ে যায়। যেহেতু অনেকাংশে তার দিকেই আঙুল উঠবে। তুমি ভুল, বা তোমার সাথেই কেন হলো এমনটানিশ্চয়ই তুমি কিছু করেছএরকম একটা পরিস্থিতির ভয়ে শিশুরা মুখ খোলে না। চেপে রাখতে গিয়ে মানসিক চাপ তৈরি হয়। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটা ট্রমা আজীবন বয়ে বেড়ায়। এটা কেবল মেয়ে শিশুদের বেলায় নয়। ছেলে শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হয়। তবে সেটা মেয়েদের বেলায় বেশি।

আমাদের সমাজে শিশুর পিতামাতা কিংবা অভিভাবকদের অধিকাংশই ভাবে না তাদের শিশুরা খুব ছোটবেলাতেই কাছের মানুষ (যে সমস্ত লোকজন সহজেই শিশুদের সান্নিধ্যে আসতে পারে) দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আদরের ছলে, শাসনের ছলে নানাভাবে তারা কাছে আসে এবং যৌন নিপীড়ন করে। শিশুরা যেহেতু বলে না, তাই অভিভাবকরাও জেগে ঘুমিয়ে থাকে, যতক্ষণ না বড় কোনো অঘটন ঘটে।

সমাজে যৌন নিপীড়ন ছাড়াও আরও অনেক ঘটনা আছে যা শিশুর বিকাশ, সুরক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ইভটিজিং, এসিড সন্ত্রাস, শিশুশ্রম, শিশুর ওপর নানাবিধ নির্যাতন, শিক্ষা থেকে ঝরেপড়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিশুদের সুরক্ষায় দেশব্যাপী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ইউনিসেফের সহায়তায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ চালু হয়েছে। দেশের যেকোনো প্রান্তের কোনো শিশু কোনো ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণের শিকার হলে শিশু নিজে অথবা অন্য যে কোনো ব্যক্তি বিনামূল্যে ১০৯৮ হেল্পলাইনে ফোন করে সহায়তা চাইতে পারবেন । এক্ষেত্রে আপনার প্রতিকার চাইবার পথটি সহজ হয়ে যাবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অধীন সমাজসেবা অধিদফতর শিশুআইন ২০১৩” অনুসারে শিশুঅধিকার ও শিশুর সামাজিক সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউনিসেফএর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সারাদেশব্যাপী ‘Child help line ১০৯৮’ এর কার্যক্রম গত ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সর মাধ্যমে ‘Child help line ১০৯৮’ এর দেশব্যাপী চালুর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। Toll free short code ‘১০৯৮’ এর মাধ্যমে বাল্য বিবাহ, শিশুশ্রম, শিশুনির্যাতন, শিশু পাচার ইত্যাদি শিশু অধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত তথ্যাদি ‘Child help line ১০৯৮’ এর মাধ্যমে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে শিশুঅধিকার ও শিশুর সামাজিক সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক (24X7) প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ঢাকার আগারগাঁওস্থ সমাজসেবা অধিদফতরের ৮ম তলায় Child help line এর Centralized Call Center (CCC) স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটিরদিনসহ ২৪ ঘণ্টা Call Center টির কার্যক্রম চালু থাকে।”

উল্লেখ্য, চাইল্ড হেল্পলাইন এমন একটি সেবা ব্যবস্থা যেখানে, কল করতে কোনো টাকা খরচ হবে না। যে কেউ, দেশের যে কোনো জায়গা থেকে শিশুর সুরক্ষায় এখানে কল করতে পারেন। এবং এখনে নিয়োজিত শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মীগণ ২৪ ঘণ্টা সুরক্ষা তৎপরতায় সতর্ক আছেন।

দেখা যায়, অনেক সময় শিশুরা তাদের সমস্যা আছে ও তা থেকে সুরক্ষা প্রয়োজনএকথাটি বন্ধু বা পরিবারের লোকজনদের কাছে বলতে পারে না। নির্যাতন, সাইবার বুলিং কিংবা ট্রোলের মতো কিছুর শিকার হলে কাউকে বলতে ভয় পায়। তারা ভাবে, তাদের সমস্যা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না, বা নিজেদের সমস্যার কথা বললে চারপাশের সবাই তাদের সঙ্গে অন্যরকম ব্যবহার করবে। কিছু ক্ষেত্রে খুব সংবেদনশীল বিষয়ও তারা কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায় না। কিংবা কীভাবে নিজের কথা বলা উচিত, সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা না থাকার ফলে কুঁকড়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে, হেল্পলাইনের সাহায্য নিয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে শিশুর জন্য কাউন্সেলিং সেবাও।

দেশে নারী ও শিশুর স্বার্থ রক্ষায় আইন তো আছেই। কিন্তু সেআইনের দ্বারস্থ হতে এগিয়ে আসতে হবে নিজেকে এবং সমাজের সচেতন মানুষকেও। তাই, যে কেউ শিশুর সুরক্ষায় ১০৯৮এ কল করুন। সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে এগিয়ে আসুন।

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী, সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধমামলায় অংশ নিতে ৭ দেশের আবেদন
পরবর্তী নিবন্ধসুজান সনটাগ: ভাবনার অন্তর্জালে