সাংস্কৃতিক শিক্ষা সব শিক্ষার্থীর জন্য, সবার জন্য, সর্বত্রই

শিশির দত্ত | বৃহস্পতিবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সামাজিক ক্ষেত্রসমূহ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। দুটো জায়গায় এর প্রভাব অনেক দৃঢ়, তা হচ্ছে বাস্তব এবং কাল্পনিক। আমরা মনে করি বাস্তবকে তখনই আমরা গুরুত্বে নিতে পারবো যখন আমরা আলোচনা করবো, যত আমরা আলোচনা করবো তত আমরা জানবো এবং বুঝতে পারবো। কাল্পনিক ক্ষেত্রে আমরা তেমন কোন নতুন কিছু তৈরি করতে পারছি না। এই সংকুচিত হয়ে যাওয়া অনেক বেশি আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রবীণ, যুবা ও নারী।

সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে একধরণের ঐক্য তৈরি করতে পারে। মানুষের ভিতরের উদ্যোগ, উদ্যম এবং একত্রিত করার অনুভূতিতে, সংস্কৃতি একটা ভূমিকা রাখে। সৃজনশীল কর্মী বা উদ্যোগী কিংবা স্থানীয়ভাবে নিজেদের ভিতর অনেক ব্যাপক আলোচনা এ পরিস্থিতি অতিক্রমে সাহায্য করে। বিভিন্ন ঐতিহ্যিক ফর্ম কোন না কোনভাবে একটা ভূমি (স্পেস) তৈরি করে।

সাংস্কৃতিক শিক্ষা (আর্ট এডুকেশন) সুশীল সমাজের মধ্যে খুব দ্রুত অবস্থান তৈরি করে, কেননা বিকল্প উন্নয়ন ধারা হিসেবে একদিকে এটি যেমন ইতিহাসকে ধারণ করতে পারে এবং অপরদিকে নতুনত্বকে গ্রহণ করতে পারে। আমরা যখন সৃজনশীল ব্যক্তিকে কোন উদ্যোগের সাথে যুক্ত করি, তখন তিনি আলোচনার ধরণ ও বিশ্লেষণ এমনভাবে উপস্থাপন করেন যা একটা ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন মাত্রা তৈরি করে। এখানে নান্দনিক সৃজনশীল শিক্ষাকে শুধুমাত্র শিক্ষা বলে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। অপরাপর প্রথাগত শিক্ষার চাইতেও এর ব্যাপকতাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের সৃজনশীল শিক্ষার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা কোন না কোনভাবে একই মত, আদর্শ, সমসাময়িক জ্ঞান ও সৃজনশীলতার চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে মানুষ ও সমাজে প্রভাব তৈরি করেন। শিক্ষার জায়গা থেকে ‘থিয়েটার ইন এডুকেশন’ (নাটকের মাধ্যমে শিক্ষা) কোন না কোনভাবে একধরণের সক্রিয়তা তৈরি করে। আমরা একে উভয়মুখী শিক্ষা প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করতে পেরেছি। এখানে মনে করা হয়, পছন্দমত উপস্থাপনই হচ্ছে প্রথম প্রবেশ সূচক (এন্ট্রি পয়েন্ট)। এখানে তাদের যৌক্তিক বিষয়গুলো অনেক বেশি ফেসিলিটেট করতে হবে যার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা সহজেই সক্রিয় হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।

শিল্প ও সৃজনশীলতা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকেও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। হাতে-কলমে ভাবনার প্রতিফলন, দাতা-গ্রহীতার ভাবনার চেয়েও সমৃদ্ধ এবং শিক্ষণ ও সম্পৃক্তকরণ, প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনার চাইতেও শক্তিশালী। এক্ষেত্রে নিজের ভিতর থেকে যা প্রতিফলিত হয় তাই রূপান্তর । এটাকে আমরা সক্রিয়তা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সাংস্কৃতিক শিক্ষা এখানেই সংকুচিত হওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে সহযোগিতা করে যা সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য। সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য যা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে যেখানে সামাজিক পরিবর্তনের ধারাকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তা ও স্থায়িত্বশীলতার সাথে যুক্ত করে।

লক্ষ্য (সিউল সনদ এর আলোকে)
আজকের বিশ্ব যেসব সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জসমূহের মুখোমুখি সেসবের সমাধানে অবদান রাখতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার নীতিমালা এবং চর্চাসমূহ প্রয়োগ করা প্রয়োজন । এক্ষেত্রে কৌশলগুলো হচ্ছে-

১. সমাজের সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রয়োগ
এক্ষেত্রে কার্যক্রমগুলো হতে পারে-

ক. ব্যক্তির সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়ানো এবং সৃজনশীল নাগরিকদের একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য সকল স্কুল এবং কমিউনিটিতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রয়োগ । খ. সমাজের সামগ্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী চর্চাসমূহ বৃদ্ধি করতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রয়োগ।
গ.সৃজনশীল এবং বিশ্লেষণাত্মক চিন্তার উৎস হিসেবে যোগাযোগ প্রযুক্তির উদীয়মান উদ্ভাবনসমূহ ব্যবহার করা।
২. সাংস্কৃতিক শিক্ষার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কল্যাণের মাত্রাসমূহ সনাক্ত করা এবং বিকাশ সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ। এক্ষেত্রে কার্যক্রমগুলো হতে পারে-
ক. ঐতিহ্যিক এবং সমকালীন সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাসমূহের পূর্ণ ব্যাপ্তিতে গুরুত্ব প্রদান করা। খ. সাংস্কৃতিক শিক্ষার রোগ উপশমকারী এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক মাত্রাকে যুক্ত করা।
গ. স্বকীয়তা এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং সংলাপ বাড়াতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার সম্ভাবনাময় শক্তিকে ব্যবহার করা।
ঘ. সংঘাত-পরবর্তী এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার পুনরুদ্ধারের মাত্রা সুনির্দিষ্ট করা।

৩. সাংস্কৃতিক শিক্ষা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কল্যাণের জ্ঞান প্রবর্তন / চালু করা।
৪. শিক্ষা অর্জনে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং ঝরে পড়া কমাতে সাংস্কৃতিক শিক্ষাকে উদ্বুদ্ধকারী প্রক্রিয়ারূপে ব্যবহার করা।

৫. সামাজিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক সংহতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ বৃদ্ধি করতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার ভূমিকা সমর্থন এবং বাড়ানো। এক্ষেত্রে কার্যক্রমগুলো হতে পারে-

ক. শিক্ষার্থী-সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিতের স্বীকৃতির উপর অগ্রাধিকার প্রদান; সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃেেগাষ্ঠীসহ সকল শিক্ষার্থীর স্থানীয় প্রাসঙ্গিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার শিক্ষামূলক অনুশীলনকে উৎসাহিতকরণ।
খ. বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং শৈল্পিক প্রকাশ ভঙ্গি/ অভিব্যক্তি সম্পর্কে জ্ঞান এবং উপলব্ধির লালন এবং উন্নতি সাধন ।
গ. সাংস্কৃতিক শিক্ষায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ দক্ষতা, শিক্ষা পদ্ধতি, সরঞ্জাম এবং শিক্ষা উপকরণ প্রবর্তন/ চালু করা।

৬. সাংস্কৃতিক শিক্ষার মাধ্যমে শান্তি হতে শুরু করে স্থায়িত্বশীলতাসহ বৃহৎ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোতে সাড়া প্রদানের সক্ষমতা বাড়ানো। এক্ষেত্রে কার্যক্রমগুলো হতে পারে-
ক. পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক অভিবাসন, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নসহ সমকালীন সমাজ এবং সংস্কৃতির বিস্তৃত ক্ষেত্র সাংস্কৃতিক শিক্ষা কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। খ. সাংস্কৃতিক শিক্ষার চর্চায় বহুঃসাংস্কৃতিক মাত্রা প্রসারণ এবং বৈশ্বিক নাগরিকত্ববোধ বিকাশে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যকার আন্তঃসাংস্কৃতিক চলাচল বৃদ্ধি করা ।
গ. সম্প্রদায়সমূহে গণতন্ত্র এবং শান্তি লালন এবং সংঘাত-পরবর্তী পরিস্থিতি হতে সমাজের পুনর্গঠনে সহায়তায় সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রয়োগ করা।

সিউল কনভেনশনে সাংস্কৃতিক শিক্ষায় যে বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে
সিউল সনদের প্রেক্ষাপটগুলো আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে জাতীয়ভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করে প্রায়োগিক চর্চার বিষয়টিকে চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক শিক্ষার গুরুত্বকে আজকের পৃথিবীতে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার সময় এসেছে কেননা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদক্ষেপকে উপর্যুপরি চর্চা হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের আন্তঃমন্ত্রনালয়ের যৌথ উদ্যোগের প্রয়াসে সাংস্কৃতিক শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার জন্য উক্ত দুটি মন্ত্রণালয়ের যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রক্রিয়াটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেকটাই সময়ের দাবী।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, নাট্যজন

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাস্টারদার সূর্য স্বামী বিবেকানন্দ: দেশপ্রেমের আলো পেয়েছিলেন যাঁর কাছে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল