মাস্টারদার সূর্য স্বামী বিবেকানন্দ: দেশপ্রেমের আলো পেয়েছিলেন যাঁর কাছে

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | বৃহস্পতিবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আজ ১২ জানুয়ারি অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের ৯০ তম আত্ম বলিদান দিবস ও স্বামী বিবেকানন্দের ১৬১ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৩ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী মাস্টার দা সূর্যসেন ও তাঁর সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, লোকনাথ বল সহ বিপ্লবীরা ব্রিটিশ শাসনের অবসানকল্পে চট্টগ্রাম অস্‌ত্রাগার লুণ্ঠন করেছিলেন। ভারতবর্ষের মানুষের উপর অত্যাচারকারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথে দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীরা। এসব বিপ্লবীদের মূল নেতা ছিলেন দেশ প্রেমিক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। মাস্টারদার সহপাঠী চট্টগ্রামেরই আরেক বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কাছে শুনেছি, নেতাজিসহ সকল বিপ্লবীরা যার আদর্শে উজ্জীবিত তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

দেশপ্রেম নিয়ে লেখা স্বামী বিবেকানন্দের বিভিন্ন বই থাকতো বিপ্লবীদের ব্যাগে। এ প্রসঙ্গে শংকরী প্রসাদ বসু’র ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-এর ষষ্ঠ খণ্ডে ‘বিবেকানন্দ ও বিপ্লব আন্দোলন’ অধ্যায়ে বিপ্লবী অনন্ত সিংহের লেখা ‘সূর্য সেনের স্বপ্ন ও সাধনা’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখছেন-সূর্য সেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে কতখানি প্রভাবিত ছিলেন, সে সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিয়েছেন তাঁর আর এক সহকর্মী অনন্ত সিংহ। ‘মাস্টারদা বিনয়ের সঙ্গে অথচ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে চারজন বিপ্লবী বন্ধুকে বললেন, আমরা চট্টলার বুকে বসে মাত্র এই পাঁচজনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের পরিকল্পনা করছি। আমার মনে হয় বর্তমানে মূলত আনন্দমঠের আদর্শে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের চলা উচিত এবং স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগের বাণী পাঠ আমাদের কর্তব্য হওয়া প্রয়োজন। সবাই আলোচনার পরে মাস্টারদার এই সমস্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নিলেন। পরে বিপ্লবীরা সবাই স্বামীজীর বিভিন্ন বই ও ছবি ঘরে রাখত।’

স্বামী বিবেকানন্দ, যাঁকে যুব নায়ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যাঁর বাণী যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করে, তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে। তিনি যুব সমাজকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁর নিজের ভিতর যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব সেটাকে জাগিয়ে মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য। তিনি শিখিয়েছেন যখনই তুমি পরের জন্য ভাববে, তুমি বেঁচে থাকবে। আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যখনই নিজের জন্য ভাববে, তখন তুমি মৃত। পরের জন্য ভাবলে জগৎ তোমার। এই জগতে নেতৃত্ব দিতে হলে তোমাকে ঝুঁকি নিতে হবে। আর নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তুমি যদি হেরে যাও তাহলে অপরকে পথ দেখাবে। তোমার দেখানো পথে আরেকজন নেতৃত্ব দিয়ে জগতকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। একজন যুবকের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগানোটা বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ।

আজকাল যুবকরা বিশ্বাসই করতে চায় না, তাদেরকে দিয়ে বড় বড় কাজ সম্ভব। এক ধরনের ভয় তাদের মধ্যে কাজ করে। স্বামীজি বলেন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলেই সব বাঁধা দূর হবে, বড় বড় কাজ সাধন হবে। যে নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস করে না, তার কখনো ঈশ্বরের শক্তির প্রতি বিশ্বাস আসবেনা। ঈশ্বরকে জানতে হলে, আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজেকে জানলেই, নিজের প্রতি বিশ্বাস আসলেই, আমরা প্রত্যেকেই বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবো- এটাই মূলত স্বামী বিবেকানন্দের যুবসমাজের প্রতি মূল আহ্বান। এ জগতের ভাবধারা পাল্টে দেওয়ার জন্য স্বামীজি কি চেয়েছিলেন? চেয়েছিলেন মাত্র একশত যুবক। যারা হবে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, তেজী, অসীম সাহসী ও যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় তাঁরা জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবে।

তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন উচ্চ কণ্ঠ। স্বাধীনতার ৪৮ বছর আগে মিস মেরি হেলকে এক পত্রে স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন- ‘ভারতবর্ষে কয়েক বছর ধরে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। ব্রিটিশ সৈন্য আমাদের পুরুষদের খুন করেছে, মেয়েদের মর্যাদা নষ্ট করেছে, বিনিময়ে আমাদেরই পয়সায় জাহাজে চড়ে দেশে ফিরেছে পেনশন ভোগ করতে। খোদ ইউরোপের মাটিতে দাঁড়িয়ে (১৮৯৫) তাদের দিকেই আঙুল তুলে তীব্রভাষায় তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, হিন্দুরা রেখে গেছে অপূর্ব সব মন্দির, মুসলমানরা সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। আর ইংরেজরা? স্তুপীকৃত ভাঙা ব্রান্ডির বোতল, আর কিছু নয়। আমাদের গাঁয়ে গাঁয়ে দেশে দেশে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষে মরেছে, তখন ইংরেজরা আমাদের গলায় পা দিয়ে পিষেছে, নিজেদের তৃপ্তির জন্য আমাদের শেষ রক্তবিন্দুটি শুষে নিয়েছে, আর এদেশের কোটি কোটি টাকা নিজের দেশে চালান করেছে।’

স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্‌ পর্বে ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে অত্যাচারী শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘কোন এক সময় ভারতবর্ষের মানুষ জেগে উঠবে এবং এর প্রতিশোধ নেবে। ইংরেজদের ভারত বর্ষ থেকে বিতাড়িত করবে’। তখনকার দিনে স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া আর কেউ ইংল্যান্ডের মাটিতে এইরূপ প্রতিবাদী কণ্ঠে স্বদেশের হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস দেখাননি। এর ফলে তৎকালীন ভারতবাসীর মনে বিশ্বাস এসেছিল যে তাদের মধ্যেও অদম্য শক্তি রয়েছে।

পাশ্চাত্যের মানুষও জানতে পারল যে ভারতবর্ষ এক অতি পুরাতন উন্নত কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পন্ন সভ্য দেশ। ভারতবর্ষের বাইরে বিবেকানন্দই প্রথম স্বদেশের নিজস্ব মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যা অন্য কোনো বুদ্ধিজীবী বা নেতা একক বা সমষ্টিগতভাবে পারেননি। সুতরাং পরাধীন ভারতে স্বামী বিবেকানন্দই ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম সেনাপতি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বলেছিলেন, স্বামীজীর বাণী গুলো, বিভিন্ন চিঠিগুলো তৎকালীন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্‌ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ৮ জানুয়ারি, ১৯১৩ শঙ্করি প্রসাদ বসুকে এক পত্রে নেতাজি লিখেছিলেন – ‘আমার মনে হয় তিনি আমার দূত। আমাদের মধ্যে আসিয়াছেন আমার প্রাণের সকল তমঃ নাশ করিয়া হৃদয়ে অনির্বাণ শিখা জ্বালাইতে। তিনি হলেন ঋষি বিবেকানন্দ’। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক লোকনাথ বল এর মতে, ‘মাস্টারদা সূর্য সেন আমাদেরকে স্বামী বিবেকানন্দের বীরবাণী, বর্তমান ভারত, কর্মযোগ ও স্বামীজীর উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতাবলী পড়তে উৎসাহ যোগাতেন’। আরেক স্বাধীনতা সংগ্রামী সঞ্জীবপ্রসাদ সেন জানিয়েছেন ‘স্বামী বিবেকানন্দের দেশপ্রেমের আদর্শেই মাস্টারদা সূর্যসেন তখনকার দিনের চট্টগ্রামের ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন।’

আমরা জানি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধের পর মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। তৎকালীন ইংরেজ সরকার মাস্টারদা সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য প্রথমে পাঁচ হাজার ও পরে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন। জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে অভিযান চলছিলো। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে মাস্টারদা সূর্যসেনকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি রাতে গৈরালা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে এক গোপন বৈঠক চলছিল। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও রাত দু’টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে নির্মমভাবে অত্যাচারের পর সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর করা হয়।

মাস্টারদা সূর্য সেনসহ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সকল বিপ্লবীদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তখনকার দিনে যেরকম ভাবে দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বিপ্লবীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল, আজকের দিনের দেশ প্রেমিক যুবসমাজের উচিত দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করা। তবেই উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মাস্টারদা সূর্যসেন সহ সক বিপ্লবীরা আমাদের যুবসমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হোক।
লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাতের মুঠোয় পৃথিবী
পরবর্তী নিবন্ধসাংস্কৃতিক শিক্ষা সব শিক্ষার্থীর জন্য, সবার জন্য, সর্বত্রই