সমাজ জীবনানন্দের নষ্ট শসা

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

সমাজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানীগণ যত ভারী ভারী ব্যাখ্যা দেন তার সারমর্ম করলে যা দাঁড়ায় তা অনেকটা এরকম- গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষেরা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার জন্য যে সংগঠন গড়ে তোলা তা-ই সমাজ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিবেশ পরিচিতি বইতে এরকমই কিছু পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে। তাহলে সমাজ গঠিত হয় মানুষের দ্বারা, মানুষেরই জন্য। মানুষই সমাজের প্রাণ। আবার সমাজই মানুষের মাঝে ঐক্য স্থাপন করে। কালের পরিক্রমায় রাষ্ট্রের উত্থান পতন হতে পারে, দেশের চাবি হাতবদল হতে পারে, তবে সমাজ স্থির থাকে তার অবস্থানে। সমাজবিজ্ঞানে সংগঠন, সভ্যতা, ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা, শৃঙ্খলা- এই শব্দসমূহকে সমাজের প্রতিশব্দ হিসেবে গণ্য করা হয়। সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে সমাজ।
আমাদের সমাজের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের সমাজের মিল খুঁজতে গেলে কঠিন ধাঁধায় পড়ে যেতে হয়। এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা! ডিজিটাল বাংলাদেশের বন্দর শহরে নালায় পড়ে সলিলসমাধি হয় পথচারীর! মানুষের প্রাণ এতই মূল্যহীন! ভাবতে অবাক লাগে খবরটা শোনার অল্পক্ষণ পরই হেঁসেলে ঢুকে রোজকার রান্নার যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। চশমা হিলের খরস্রোতা নালায় হারিয়ে যাওয়া ছালেহ আহমদের জন্য আহাজারি করার সময় কোথায় আমার! ধিক্কার দেই নিজেকে। আমরা নিতে পারছি বলেই হয়তো আঘাত আসছে একের পর এক। অন্যের দুঃখে প্রাণ কাঁদেনা বলেই আমরা যে যার জাগতিক সুখ দুঃখের একান্ত বলয়ে আবদ্ধ থাকতে পারি।
রাজধানীর বুকে কারখানায় আগুন লেগে কয়লা হয়ে যাওয়া অর্ধশতাধিক কিশোর কিশোরীর মৃতদেহ চিহ্নিত করার প্রয়োজনে ডিএনএ’র মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হয় আমার দেশে! কত এগিয়ে গিয়েছি আমরা! কফিনের ভেতর কি আছে আমরা জানিনা। হতে পারে ছাই কিংবা পোড়া মাংসের পুটলি। পরম মমতায় মা তবু হাত বুলিয়ে যান কফিনের ওপর। তাঁর আর্তনাদে কেঁপে ওঠে খোদার আরশ। আমাদের প্রাণে কোন আঁচড় লাগেনা। ভাইরাল হয়না নাগরিক সমাজে। আমরা দেখেই চোখ ঘুরিয়ে নিতে পারি অবলীলায়।
সে রাতেই ঝড় ওঠে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রুপোলী পর্দার জনপ্রিয় নায়িকাকে গ্রেফতার করতে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শত শত সদস্য। গণমাধ্যমে সরাসরি সমপ্রচারিত হয় সেই অভাবনীয় দৃশ্য। কোটি কোটি মানুষ সেঁটে থাকে টেলিভিশনের পর্দায়। কেউ মজা লুটে, কেউবা বিচারক হয়ে নিজেরাই রায় দিয়ে যায় পক্ষে-বিপক্ষে। মুহূর্তেই নাই হয়ে দেশজুড়ে চলমান সকল সমস্যা। করোনা হয়ে যায় নিতান্তই পার্শ্বচরিত্র। আইনের ঘর হতে একের পর এক অব্যাহতি লাভ করে সসম্মানে বাড়ি ফিরে যান দুর্ধর্ষ ধনকুবেরগণ। জনতা নির্বিকার। সংবাদকর্মী থেকে সাধারণ নাগরিক, ধনবান থেকে হতদরিদ্র সকলের চোখ কান মন নিবদ্ধ একটি জায়গায়; কাশিমপুর কারাগারে- না জানি কখন নায়িকার দেখা পাওয়া যায়। যতই গালমন্দ করি একবার চোখের দেখা দেখতে পারলেই জীবন সার্থক।
পৃথিবীর আর কোন দেশের সংবাদে এত নাটকীয়তা থাকেনা। নাগরিকরাও কাজকর্ম ফেলে নেশাগ্রস্তের মতো বুঁদ হয়ে থাকেনা তোলপাড় করা খবর নিয়ে। অবশ্য কি কাজই বা করার আছে আমাদের? সমাজে প্রতিনিয়ত এই বার্তাই ঘোষিত হয় যে, কাজ ফেলে রাখাতেই কৃতিত্ব, অন্যায়কারীরাই কথা বলবে বড় গলায়, নিগৃহীত চুপ থাকবে, প্রতিবাদ করবেনা। ফলাফল- অপরাধীরা আস্ফালন করে যাবে যুগে যুগে। এ বার্তা কেবল উঁচু তলায় নয়, পৌঁছে গেছে সমাজের নিচু তলাতেও। তাইতো অপরাধ বা অন্যায় করে কেউ আজকাল লজ্জিত বা অনুতপ্ত হয়না। পাশের মানুষটি অন্যায় করছে শতভাগ নিশ্চিত হয়েও প্রতিবাদ করার সাহস হয়না, ইচ্ছেও জাগেনা কারও। সকল অপকর্ম মেনে নিতে নিতে এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে নাগরিক সমাজে। সমাজ মানসে যখন অপরাধপ্রবণতাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তখনই বিস্তার হয় অপসংস্কৃতির।
এতকাল অশিক্ষা ও দারিদ্রকেই সমাজের সকল দুরবস্থার জন্য দায়ী মনে করা হত। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রথম প্রহরে আমাদের শিক্ষার অগ্রগতি উন্নত বিশ্বের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। স্বাক্ষরতার হার সত্তর শতাংশের বেশী, স্নাতকোত্তর সনদপ্রাপ্ত নাগরিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে বানের পানির মতো শিক্ষার্থীদের ঢল নামে বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে হতদরিদ্র পরিবারের অন্ধযুবকেরাও ভেসে আসে এই স্রোতে। মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার যাত্রাপথে দারিদ্র্যের অস্তিত্বকে তাই স্বীকার করা হয়না আজকাল। অভিজাত এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা দিয়ে ঝলমলে নগরীর সৌন্দর্য নষ্টকারী ভিক্ষাজীবীদের অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে সমাজ হতে। দুঃসহ কোভিডকালেও আর্থিক সূচকের ঊর্ধ্বগতিতে চমৎকৃত হই আমরা সুবিধাভোগী নাগরিকগোষ্ঠী। খাওয়া পরার ভাবনা নেই, আরাম আয়েশের কমতি নেই, আনন্দ বিনোদনে ঘাটতি নেই। কেন একজন ছালেহ আমহদের নর্দমায় ভেসে যাওয়া নিয়ে আহাজারি করব? কেনইবা কারখানার আগুনে অঙ্গার হয়ে যাওয়া কিশোর কিশোরীদের স্বজনের বিলাপ দেখে চোখের জল ফেলব? আর তাই উন্নয়নের ডামাডোলে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া প্রান্তিক কৃষক, কিংবা ক্রমাগত হয়রানির শিকার হয়ে রাজধানীর বুকে ব্যস্ত সড়কে একমাত্র আয়ের উৎস মোটরবাইক পুড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা যুবকের কথা ভুলে যেতে দু’দণ্ডও লাগেনা আমাদের।
শিক্ষার বিস্তার ও আর্থিক অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু জীবনবোধ জাগাতে পারেনি আমাদের মাঝে। অনেক আগের পরিসংখ্যান ভুলে যাই, শুধু করোনাকালে আমাদের দেশে দেশ জাতির জন্য অমঙ্গলকর যত অপকর্ম সাধিত হয়েছে তার সবই হয়েছে ধনবান শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হাত দিয়ে। অশিক্ষিত কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিন্তু আমাদের সমাজের কোন ক্ষতি সাধন করছেনা। শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর নামে কত শত সহস্র প্রকল্প প্রণীত হয়েছে এ যাবতকালে! ঢাকঢোল পেটানোই সার, ফলাফল শূন্যই বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে একদিনও পায়ের ধুলো না দিয়ে কত শিক্ষার্থী এম এ পাশের সনদ নিয়ে বাড়ী ফিরে যাচ্ছে! কত শিক্ষক নিজের মর্যাদা ও দায়িত্বের প্রতি সুবিচার না করে শিক্ষাবহির্ভূত নানান সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে খ্যাতিমান হয়ে যান আমাদের সমাজে! আমরা দেখেও দেখিনা। বিশ্ববিদ্যালয় কেন রণক্ষেত্র হবে, প্রধান ফটকে কেন ঝাঁকে ঝাঁকে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী থাকবে, সে প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংবাদ শিরোনাম হয় কোন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সংবাদ নিয়ে নয়, রক্তপাত, শ্লীলতাহানি, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মের খবরাখবর দিয়ে। শিক্ষা নয় সনদই এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সনদ প্রাপ্তির এই দৌড়ে সততা ও নৈতিকতার চর্চা বাধ্যতামূলক নয়, বরং অপ্রয়োজনীয়ই বলা চলে। সত্য আর সততাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আমরা অসত্য আর শঠতার প্রাসাদ গড়ে তুলছি।
দুর্নীতি এখন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। প্রতারনার খবর শুনে আমরা আর চোখ কপালে তুলিনা। ১০-২০ কোটি টাকার দুর্নীতি বা প্রতারণার খবরও খুব একটা কল্কে পায়না গণমাধ্যমে। ‘শতকোটি টাকার দুর্নীতির খবরও জলভাত হয়ে গেছে। পাবলিক থেকে প্রতারক-সবাই বোঝেন, চোর ধরার জন্য যে চৌকিদার আছেন, তাঁরাই এখন আর দুর্নীতি নিয়ে ভাবিত নন (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর)। … তবে তাঁদের ‘সততার প্রতীক’ভাবমূর্তিটি ঠিকই বহাল থাকে।
একটা ভাল কাজ করতে যান, কারও সমর্থন পাবেননা, কিন্তু মন্দ কাজে আপনাকে বাহবা দেবে অনেকে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে, যদিও তা প্রকৃত বন্ধুত্ব নয়। আপনি অপরাধ করলে আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে আপনাকে ঠিকই নির্দোষ প্রমাণ করিয়ে ছাড়িয়ে আনা হবে। কিন্তু আক্রমণকারী না হয়ে যদি হন আক্রান্ত, তাহলে আপনার পাশে পাবেননা কাউকে। একাই লড়ে যেতে হবে আপনাকে। চোখের সামনে দেখতে যাবেন কেমন করে রাতকে দিন বানিয়ে আপনাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।
আমাদের ছেলেবেলায় পাড়ার মামা চাচা মুরব্বীগণ ছেলেমেয়েদের ভুল করতে দেখলেই শুধরে দিতেন, প্রয়োজনে গালমন্দও করতেন। এখন আমরা নিজের সন্তানকে ভুল ধরিয়ে দিতে বারবার চিন্তা করি, ভয়ও পাই। না জানি ওরা কিভাবে নেয়! কি প্রতিক্রিয়াই বা দেখায়! তাছাড়া আমার সন্তানকে অন্য বাড়ির কেউ এসে অযাচিত উপদেশ দিয়ে যাব, আমিইবা তা মানব কেন! আমরা সন্তানদের আরাম আয়েশের জন্য বিলাসবহুল বাসস্থান নির্মাণ করি, কিন্তু তাদের মানবিক করার কোন আয়োজন থাকেনা আমাদের পরিবারগুলোতে। কাকে দোষারোপ করব? আমাদের, না কি আমাদের সন্তানদের? নাকি আমাদের বাবা মায়েদের? সমাজের এই পচন তো একদিনে ধরেনি। একদিনে সারানোও যাবেনা এই পচন। তবে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকব? নগরের অলিগলিতে হা করে থাকা মৃত্যুফাঁদে পিছলে পড়ার অপেক্ষায় দিন গুনব ? অপঘাতে মৃত্যুবরণ করে সংবাদ শিরোনাম হওয়াকেই পরম সার্থকতা মনে করে করব?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সমান বয়সী ছালেহ আহমদ একাই নন, যিনি নর্দমায় ডুবে মরেছেন। এই শহর এমন মৃত্যু অনেক দেখেছে। নর্দমায় ভেসে যাওয়া লাশের মিছিলে সর্বশেষ সংযোজন সাদিয়া নামের এক শিক্ষার্থী যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাদিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণেই হয়তো নড়েচড়ে বসছেন কর্তাব্যক্তিগণ, দুঃখ প্রকাশ করেছেন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য, যদিও দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছেন একে অন্যের ওপর। তবে একথাও সত্যি যে আর সকলের মতো সাদিয়ার কথাও আমরা ভুলে যাব শীঘ্রই, ঠিক যেমন করে গলিত, দগ্ধ, ঝুলন্ত, খণ্ড-বিখণ্ড নারী, পুরুষ, শিশুর মৃতদেহের খবর প্রতিদিনের কাগজে দেখে দেখেও ভুলে যাই আমরা।
আলোচ্য নিবন্ধের শিরোনামটা ধার করেছি কথাসাহিত্যিক ফেরদৌস আরা আলীমের ‘চর্যার হরিণী তুই’ গ্রন্থ হতে। সমাজের পচনকে ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি দূষিত ও কলুষিত রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন। তবে আশার বাণীও শুনিয়েছেন তিনি। নষ্ট সমাজটাকে বদলে দেয়ার জন্য অসত্য, শঠতা আর অনৈতিকতায় আকণ্ঠ ডুবে থাকা সমাজপতিদের নয়, আহবান জানিয়েছেন তিনি মাতৃজাতিকে। আমাদের মায়েরা তাঁদের শক্তি ও যোগ্যতার ওপর আস্থা রেখে দিন বদলের ডাক দেবে, এই আশাটুকুই বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। নারীশক্তির উত্থান প্রণোদনা যোগাবে ভাঙায় নয়, গড়ায়; ধ্বংস নয়, সৃষ্টিতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের দাদু ফাতেমা খাতুন স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধগণফোরাম নেতৃবৃন্দের চট্টগ্রাম সফর