সনির্বন্ধ আরজ

জাহেদুল আলম | শুক্রবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

মা মৃত্যুবরণ করেছেন। সৎকারের কাজ চলছে। পুত্রের ইচ্ছে জাগলো, দাফন শেষে তো মাকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো না, একটা ছবি তুলে রাখি। সদর থেকে একজন আলোকচিত্রশিল্পী এনে মৃত মায়ের ছবি তোলা হলো । মৃত নারীর ছবি তোলার অপরাধে জানাজা না পড়ে সবাই চলে গেল। এই ঘটনা পুত্রটিকে খুবই ব্যথিত ও আলোড়িত করলো। বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ঘটনা এটি। নিজের অপরাধটা কোথায় সেটা অনুসন্ধান আরম্ভ করলো অধ্যয়নের মাধ্যমে। কিন্তু অধ্যয়ন করার মতো বিদ্যা যে নেই। মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়েছে, সাংসারিক কারণে আর যে লেখাপড়া করতে পারেনি। নবউদ্যমে পুনরায় লেখাপড়া আরম্ভ করলেন। দীর্ঘ অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, অনুশীলনের পর লাভ করলেন ‘সত্যের সন্ধান’।
তাঁর লেখাপড়ার ধরণ ছিল অভিনব ও আধুনিক এবং স্বউদ্যোগে ও স্বশিক্ষায়। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সালে আত্মপরীক্ষার একটা উপায় বের করেছিলেন। যেটা এখনকার সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির মতো। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নপদ্ধতি ছিল এমন, শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে বা পরীক্ষাকক্ষে বই পুস্তক ঘেঁটে উত্তর দিতে পারবে। পুত্রটি স্বআবিষ্কৃত একটি পরীক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করলো, যা কাকতালীয়ভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে মিলে গেল, নিজের অজান্তেই। সেই ব্যক্তি পরিণত বয়সে এসে বলেছেন (শান্তনু কায়সারের গ্রন্থ থেকে), ‘নিয়মিতভাবে পড়তে লাগলাম এবং ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক ও (১৩৩৬ সালের অগ্রাহায়ণ মাসে) বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে (৫ম শ্রেণির) পাঠ্যবইগুলো পড়া শেষ করলাম। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি কিনা তা জানিনে। কারণ আমার পরীক্ষক আমি। অন্য কেউ নয়।’ তাঁর পরীক্ষা পদ্ধতি তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন, ‘আমার পরীক্ষার স্বরূপটি এই- বইগুলো ভালোভাবে পরীক্ষার জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছি। এবং প্রত্যেক বিষয়ের পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখের একমাস (ত্রৈমাসিক ও ষান্মাসিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে ১৫ দিন) পূর্বে বিশেষ-বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের উপর দশটি করে প্রশ্ন লিপিবদ্ধ করে বইয়ের পড়া বন্ধ করেছি, এমনকি হাতে লওয়াও। অতঃপর নির্ধারিত তারিখে শুধু স্মৃতির সাহায্যে প্রশ্নের উত্তর লিখেছি। পরীক্ষার পরে প্রশ্নোত্তরের সহিত বই মিলিয়ে দেখেছি যে, আমার উত্তরসমূহ কতটুকু ভুল বা নির্ভুল হয়েছে এবং তদনুসারে নম্বর দিয়েছি। এতে কোনো কোনো বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি। সব বিষয়ে পারিনি। তবে ওর জন্য আর স্বতন্ত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা করিনি। স্থির করেছি যে, সব বিষয়ে পড়ে শুধরে নেব।’
পড়ে, জেনে, শুধরে পরিশীলিত হয়ে এক সময় জাতীয় জীবনে আত্মপ্রকাশ করলেন জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনসত্য উপস্থাপনে বিজ্ঞানভিত্তিক সৃজন-মননে আধুনিক যুক্তিবাদী দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০-১৯৮৫)। বরিশাল জেলার সদর উপজেলায় চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচরি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩)। তাঁর জীবদ্দশাতে প্রকাশিত অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- সৃষ্টিরহস্য(১৯৭৭), অনুমান (১৯৮৩) ও স্মরণিকা। ‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থটির পা-ুলিপি নিয়ে স্বাধীনতার পূর্বে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা ও তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তিনি এভাবে- ‘সত্যের সন্ধান’-এর পা-ুলিপির বদৌলতে সে মামলায় আমি দৈহিক নিষ্কৃতি পেলাম বটে কিন্তু মানসিক শাস্তি ভোগ করতে হলো বহু বছর! কেননা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা আমি প্রকাশ করতে পারবো না এবং পারবোনা কোনো সভা-সমিতি-বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বমত প্রচার করতে। যদি এর একটি কাজও করি, তবে যে কোনো অজুহাতে আমাকে পুন:ফৌজদারতিে সোপর্দ করা হবে। অগত্যা কলম-কাগজ বন্ধ করে আমাকে বসে থাকতে হলো ঘরে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এভাবে নষ্ট হয়ে গেল আমার কর্মজীবনের অমূল্য ২০টি বছর।”
জীবদ্দশাতে আরজ আলী মাতুব্বর উপরোক্ত আক্ষেপ করে গিয়েছেন। তিনি নেই পঁচাত্তর বছর (মৃত্যু ১৯৮৫) যাবত। এখন আরজ আলী মাতুব্বরের বিষয়-আশায় নিয়ে আমাদের আক্ষেপ প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জীবদ্দশাতে তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় একটি পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে লাইব্রেরি ও আশপাশের কিছু জায়গা সরকারকে দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই লাইব্রেরিতে নেই তেমন কোনো বইপুস্তক, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। নেই কোনো লাইব্রেরিয়ানও। অথচ ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনে দেখা যায় বরিশালের জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা কালচারাল অফিসারকে সদস্য সচিব করে এবং সরকারি ও বেসরকারি আরও গুরুত্বপূর্ণ পনেরজন ব্যক্তিকে সদস্য করে ‘আরজ আলী মাতুব্বর ট্রাস্ট কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। তারপরও ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’ তিমিরেই রয়ে গেছে। আরজ আলী মাতুব্বরের সন্তানদের মধ্যে জীবত আছেন শুধু কন্যা মুকুল মাতুব্বর। তাঁর আর কোনো সন্তান জীবিত নেই। আছেন অসংখ্য নাতি-নাতনি। এদের মধ্যে নাতি শামীম মাতুব্বর (পিতা মৃত কাঞ্চন আলী মাতুব্বর) কেনোরকমে টিকিয়ে রেখেছেন আরজ আলী মাতুব্বরের ঘরদোর ও লাইব্রেরিটি। শামীম মাতুব্বর (জন্ম ১৯৬৯) পড়াশোনায় মাধ্যমিকের গ-ি অতিক্রম করতে পারেননি। বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সেই দোকানের ক্রেতাও তাঁর পরিবার-পরিজন। এই তাদের আর্থিক অবস্থা বা দুরবস্থা। লাইব্রেরিটি টিকিয়ে রাখতে তিনি লাইব্রেরিয়ান বিষয়ে ডিপ্লোমাও করেছেন। কিন্তু লাইব্রেরিতে মাত্র হাতে গোনা কিছু বই। বিক্রি করার মতো বইও নেই, পুঁজিও নেই। এমনকী আরজ আলী মাতুব্বরের বইগুলোও নেই। শামীম মাতুব্বর গত নভেম্বরে জানালেন, প্রকাশকগণ চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে আরজ আলী মাতুব্বরের প্রকাশনা ও অর্থ প্রদান করেননি।
আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা বিষয়ে ড. আহমদ শরীফ ( ১৯২১-১৯৯৯) বলেছেন, ‘আরজ আলী মাতুব্বরের গ্রন্থ পড়ে আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি নতুন কথা বলে নয়, তাঁর মুক্তবুদ্ধি, সৎসাহস ও উদার চিন্তা প্রত্যক্ষ করে।’ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জন্ম ১৯৩৬) বলেছেন, ‘আরজ আলী মাতুব্বর প্রথম ও নির্মম যে অন্ধকার সুচিরকাল ধরে স্থায়ী হয়ে আছে এই বাংলাদেশে, তার কথাই বলেছেন তাঁর বইতে। বর্ণনা করে নয়, প্রশ্ন করে।’

বেঁচে থাকলে আজ আরজ আলী মাতুব্বরের ১২১ তম জন্মবার্ষিকী হতো। ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা ও ডিগ্রি অর্জন করতে না পারলেও তিনি আত্মশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষই স্বশিক্ষিত। আরজ আলী মাতুব্বরের সব রচনা যেন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আরজ মঞ্জিল পাবিলক লাইব্রেরি’টি যেন বেঁচে থাকে- এটাই আমাদের একমাত্র সনির্বন্ধ আরজ।
লেখক: নাট্যকর্মী ও শিক্ষক

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র:
১। আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র (পাঠক সমাবেশ)।
২। আরজ আলী মাতুব্বর (শান্তনু কায়সার / কথাপ্রকাশ)।
৩। শামীম আলী মাতুব্বর (আরজ আলী মাতুব্বরের পৌত্র)।

লাইব্রেরিটি টিকিয়ে রাখতে তিনি লাইব্রেরিয়ান বিষয়ে ডিপ্লোমাও করেছেন। কিন্তু লাইব্রেরিতে মাত্র হাতে গোনা কিছু বই। বিক্রি করার মতো বইও নেই, পুঁজিও নেই। এমনকী আরজ আলী মাতুব্বরের বইগুলোও নেই। শামীম মাতুব্বর গত নভেম্বরে জানালেন, প্রকাশকগণ চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে আরজ আলী মাতুব্বরের প্রকাশনা ও অর্থ প্রদান করেননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশব্দহীন চলে যায়
পরবর্তী নিবন্ধগুণী ব্যক্তিত্বরা দেশের আলোকবর্তিকা