শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ভাষা শহীদদের স্মরণ

ফুলে ফুলে ভরে উঠল শহীদ মিনার

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আজ বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব। এই ভূখণ্ডের ফলা থেকে উঠে আসা এক একটি বর্ণ আমাদের অহংকার। দেড় হাজার বছর ধরে এই ভূখণ্ডের মানুষের বাক সংকেত এখন বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার রক্তস্নাত ক্ষণ একুশ তাই বাঙালি জাতির জাগরণের নাম, আমাদের গর্ব ও অহংকারের প্রতীক। বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম সংগ্রাম। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি খুঁজে পায় স্বাধীনতার স্বাদ। মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দেওয়া বীরদের স্মরণ করতে শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের আপামর মানুষ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার দৃপ্ত শপথ এদিন আবারও নিয়েছে সবাই। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির সংস্কৃতিসহ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সাম্প্রদায়িকধর্মান্ধ অপশক্তির কাছে পরাস্ত হতে না দেওয়ার শপথে দৃঢ় হয়েছে মানুষ শহীদ বেদি ছুঁয়ে।

সাংস্কৃতিক বলয়’ প্রকল্পের কাজের জন্য নগরীর কেসি দে রোডে ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’ ভেঙে ফেলায় এবারও মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে সিটি কর্পোরেশন। ২০ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাত ১১টার পর থেকেই নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে লোকজন আসতে শুরু করে। বিভিন্ন সংগঠন, নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ফুল হাতে আসেন। পুলিশের সশস্ত্র অভিবাদনের মধ্য দিয়ে রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী শহীদ মিনারে প্রথম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় চসিকের কাউন্সিলর ও কর্মকর্তারা মেয়রের সঙ্গে ছিলেন। শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আমিনুর রহমান, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুদ্দিন, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ এবং মহানগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, উত্তরের সভাপতি এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ফুল দেন।

বিএনপি চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর এবং দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছেন।

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকেই শুরু হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে মানুষের আনাগোনা। শুরু হয় প্রভাতফেরি। বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী, শ্রেণিপেশার মানুষ প্রভাতফেরিতে যোগ দেন। কারও কণ্ঠে একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, আবার কারও কণ্ঠে স্লোগান। কারও হাতে ব্যানার, কারও হাতে বর্ণমালা, কেউ বা নিয়েছিলেন লালসবুজের পতাকা, ভাষার জন্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে পতাকা পেয়েছে বাঙালি।

সকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন নেতাকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দেন। সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের নেতৃত্বে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে নগর মহিলা লীগ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাই কমিশনার রাজীব রঞ্জন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি অশোক সাহা, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। জেলা যুব ইউনিয়নের সভাপতি মো. শাহআলম এবং সাধারণ সম্পাদক জাবেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যানি সেন, জেলার সভাপতি ইমরান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক টিকলু কুমার দেসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। বাসদ (মার্ঙবাদী), গণমুক্তি ইউনিয়ন, জাসদ, ন্যাপ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের নেতৃত্বে, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কাজী নাঈমের নেতৃত্বে এবং কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মায়মুন উদ্দিন মামুনের নেতৃত্বে, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে ফুল দেন।

নগরীর চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. নূরুন নবী সাহেদ ও সাধারণ সম্পাদক মো শহীদুল আলম শহীদদের নেতৃত্বে এবং কোতোয়ালী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ জুনাইদ ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সাংস্কৃতিক গণসংগঠন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এসময় উদীচী চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, সহ সভাপতি প্রবাল দে, বিধান বিশ্বাস ও তপন শীল, সহ সম্পাদক জয় সেন, ভাস্কর রায় ও মনীষ মিত্র চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ বাবলা চৌধুরীসহ শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বীরদের শ্রদ্ধা জানিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এছাড়াও বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, দক্ষিণ জেলা যুবলীগ, জেলা আইনজীবী সমিতি, হকার্স সমিতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়নন্যাপকমিউনিস্ট পার্টি গেরিলা বাহিনীসহ আরও বিভিন্ন সংগঠন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। বেসরকারি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন নগরীর জিইসি মোড়ের ক্যাম্পাসে শহীদ মিনারে মঙ্গলবার সকালে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষকশিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেন।

এদিকে মঙ্গলবার সকালে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আক্রান্তরা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও সংগঠনটির অন্তত ১২ জন শরীরে আঘাত পেয়েছেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে শহীদ মিনারে প্রবেশের প্রতিবাদ করায় এবং স্বৈরাচার ও সন্ত্রাসবিরোধী স্লোগান দেওয়ায় যুবলীগছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে বলে দাবি ছাত্র ইউনিয়নের। কোতোয়ালী থানা ছাত্রলীগের দাবি, ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা একজন জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতাকে অপমান করায় তারা প্রতিবাদ করেছে এবং এসময় সামান্য হাতাহাতি হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুরনো ভবন ভাঙার সময় ধস, প্রাণ গেল দুজনের
পরবর্তী নিবন্ধহাইড্রেন্ট আছে, পানি নেই