শিল্পজগতে লিঙ্গ ও বর্ণ বৈষম্যে গেরিলা বালিকারা

রিতু পারভী | শনিবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

যুগ যুগ ধরে চলে আসা লিঙ্গ বৈষম্যের যুদ্ধটা চলেছে বিভিন্ন ফর্মে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে। কখনো গৃহে, কখনো কারখানায়, কখনো কর্মস্থলে আবার কখনো বা শিল্পসাহিত্য জগতে। এ যেন কখনো শেষ না হওয়া এক যুদ্ধ।
শিল্প জগতে লিঙ্গ বৈষম্য এবং বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে নাম না জানা একদল নারী প্রতিবাদী এক আন্দোলনের সূত্রপাত করে। ১৯৮৫ সালে নিউইয়র্কে এই গ্রুপটি তাদের কাজ শুরু করে। লিঙ্গ এবং বর্ণের অসমতাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য এবং শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যমান এই বৈষম্যগুলো শিল্পের বৃহত্তর ক্ষেত্রে উম্মোচিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে পোস্টার, বই, বিলবোর্ড এবং জনসম্মুখে উপস্থিতির মাধ্যমে কালচার জ্যামিং করে। কালচার জ্যামিং হলো নিজেকে আড়ালে রেখে কনজ্যুমারিজমের আধিপত্যের বিপরীতে এর মুখোশ খুলে দেয়ার একটা পদ্ধতি। মূলধারার মিডিয়ার আধিপত্য আর প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করতে, বিশাল জনগোষ্ঠীকে এর অন্ধ আকর্ষণ থেকে মুক্ত করতে বিভিন্ন কোম্পানির লোগো, তাদের থিমকে তীব্র কটাক্ষের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই কালচার জ্যামিং। গেরিলা গার্লস গেরিলা বালিকারা কালচার জ্যামিং এর মাধ্যমে শিল্পকলায় লিঙ্গ বৈষম্য আর বর্ণ বৈষম্যকে সবার সামনে তুলে ধরার আন্দোলন শুরু করে।
লেখার মধ্যে রসাত্মক উপাদান যোগ করে তারা সিরিয়াস ম্যাসেজ উপস্থাপন করতে থাকে। গেরিলাদের দক্ষতা, কৌশল ব্যবহার করার জন্য তারা দ্রুত মানুষের নজরে আসে। ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টার ঝুলানো, আকস্মিক কোন প্রদর্শনীর আয়োজন করার মাধ্যমে তারা ‘গেরিলা গার্লস’ নামে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। নিজেদের পরিচয় লুকানার জন্য তারা গেরিলার মুখোশ মুখে এঁটে ছদ্মনাম ব্যবহার করতো। ফ্রিদা কাহালো, ক্যাথে কলউইজ, এলিস নীল ইত্যাদি নারী শিল্পীদের নামের আড়ালে নিজেদের পরিচয় গোপন করে গেরিলা গার্লস বিভিন্ন প্রতিবাদী সমাবেশ আয়োজন করতো। মূল বিষয়টাকে ফোকাস করার উদ্দেশ্যেই আন্দোলনকারীরা নিজেদের পরিচয় আড়াল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিংশ শতাব্দীর কনটেম্পোরারি আন্দোলন যখন তুঙ্গে বিখ্যাত সব চিত্র গ্যালারিগুলোতে নারী চিত্রশিল্পী এবং কিউরেটরদের কোন ভূমিকা ছিল না। এইসব গ্যালারি মূলত সমাজের উচ্চবিত্ত এবং সাদা চামড়ার মানুষদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকত। আন্দোলনকারীদের মতে গ্যালারিগুলো যত না শিল্পকে উপস্থাপন করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব প্রতিপত্তিকে উপস্থাপনে আগ্রহী। ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ামের বোর্ডের পরিচালকদের সবাই ছিল পুরুষ, সেখানে নারীদের কোন স্থান ছিল না। নারী চিত্রশিল্পীদের উপস্থাপনে অসমতা দেখা দেয় যার ফলে নারীদের ভাবনায় যে শিল্প তা’ হয়ে পড়ে অন্তরীণ। এরই পথ ধরে ১৯৮৫- এ একদল প্রতিবাদী নারী শিল্পক্ষেত্রে এই বৈষম্যকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এর সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ তিরিশ থেকে মুষ্টিমেয় কিছুতে উঠানামা করেছে সবসময়।
১৯৮৫ সালে মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামের বসন্তকালীন প্রদর্শনীর সময় ‘গেরিলা গার্লস’ এর সাতজন সদস্য তাদের প্রথম প্রতিবাদ উপস্থাপন করে। সে সময়ে ‘ সমসাময়িক ভাস্কর্য এবং পেইন্টিং এ আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান’ এর এই প্রদর্শনীতে ১৬৫ জন শিল্পীর মধ্যে মাত্র ১৩ জন নারী শিল্পীকে রাখা হয়। মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের প্রদর্শনীতে ১৭টি দেশের যুগসেরা চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর- এর যে পরিসংখ্যান দেয়া হয় তাতে বর্ণবিচারে শিল্পীর উপস্থিতি ছিল খুবই কম যার মধ্যেও ছিল না কোন নারী।
এই প্রদর্শনীর কিউরেটর ক্যানেসটন ম্যাকসাইনের মতামত এটাকে আরও পরিষ্কার করে যে চিত্রশিল্প জগত উল্লেখযোগ্যভাবে বৈষম্যের শিকার। তিনি বলেন, যারা এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তারা তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে আবার চিন্তা করতে পারে। এই বক্তব্যের প্রতিবাদে মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামের সামনে এই নারী শিল্পীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে আর এভাবেই জন্ম নেয় ‘গেরিলা গার্লস’ আন্দোলন।
আস্তে আস্তে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জায়গায়। শিল্পজগতে বৈষম্যকে ফোকাস করে এই আন্দোলনে যুক্ত করা হয় বর্ণ বৈষম্যের শিকার নারীদেরও।
সেঙিজম এবং রেসিজমকে টার্গেট করে এই আন্দোলন নিউয়র্কের বাইরে, এমন কি আন্তর্জাতিকভাবেও একে ছড়িয়ে দেয়া হয়। চিত্রশিল্পকে মূল ফোকাস করা হলেও সিনেমা, জনপ্রিয় অন্যান্য সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্যকে পরে যুক্ত করা হয়।
শুরুতেই দলের সদস্যরা আর্ট গ্যালারি প্রদর্শন করে বিভিন্ন চিত্রশিল্পের একটা পরিসংখ্যান নিতো। দেখা যেত মোট শিল্পীর মাত্র ৫% শিল্পী ছিল নারী কিন্তু ৮৫% ন্যুড ওয়ার্ক ছিল নারীদের উপর। এভাবে বিভিন্ন পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে প্রাথমিকভাবে সদস্যরা সভার সেমিনারের আয়োজন করে। তারা বিভিন্ন শিল্পীর সাথে যোগাযোগ করে এই বৈষম্য দূর করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করে, এ বিষয়ে কথা বলতে আহ্বান করে।
গরিলার মুখোশ পরিহিত এই গেরিলা-বালিকারা শিল্পজগতে লিঙ্গ বৈষম্য আর বর্ণ বৈষম্য দূর করতে এক মাইলফলক তৈরি করে। তাদের দেখানো পথ ধরেই নারীরা সর্বদা বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে, পার করেছে বৈষম্যের বৈতরণী।
ritu.parveel123@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধপায়ে হেঁটে মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা জানলেন ব্রিটিশ হাই কমিশনার
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর-আধুনিক চিয়াংরাই শহরে