উত্তর-আধুনিক চিয়াংরাই শহরে

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

সুকুমার রায়ের হযবরল নয়, থাইল্যান্ডের পৌরাণিক কাহিনী থেকে উঠে আসা আধা মানুষ আর আধা পাখির শরীর নিয়ে দুজন ‘কিন্নর’ দাঁড়িয়ে আছে ‘জন্মান্তরচক্রের সেতু’তে উঠার পথের দুই ধারে। হিন্দু এবং বৌদ্ধ পুরাণে ‘কিন্নর’ হল সকলের ভালবাসার সেই বাঁশিওয়ালা মানে যন্ত্রশিল্পী যিনি মানুষকে বিপদের সময় সামলে রাখেন। সেতুর নিচ থেকে নরক থেকে বাঁচানোর করুণ আর্তি নিয়ে উঁচিয়ে আছে শত শত শ্বেত শুভ্র হাত। এত শত হাতের মাঝে টকটকে লাল রঙয়ের নখ নিয়ে উঁচু হয়ে আছে শুধুমাত্র একটি হাতের মধ্যমা। নরক থেকে উদ্ধত লাল নকের মধ্যাঙ্গুলিটি ইহুদী পৌরাণিকে উল্লেখিত মানবজাতির আদি পিতা আদমের প্রথম স্ত্রী ‘লিলিথ’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়। যাকে পরিচয়-করিয়ে দেয়া হয়েছে ইতিহাসে ‘প্রথম নারী শয়তান’ মানে দুষ্ট নারী বলে। গল্প প্রচলিত আছে, রমন কালে মানে সহবাসের সময় তিনি রমণী হতে অস্বীকার করেছিলেন, তিনি নারী হতে চেয়েছিলেন। তিনি নারীপুরুষের সমান অংশগ্রহণের কথা বলেছিলেন। আদিপিতা আদম এটি মেনে নিতে রাজি হননি, তাই তিনি ইশ্বরের কাছে নালিশ করেন। ঈশ্বর তখন লিলিথের সামনে দুটি উপায় উপস্থাপন করেন- তিনি যদি আদমের কথা মেনে নিয়ে সহবাস করে, তবে আদি মাতা হিসেবে সকলের কাছে পূজনীয় হবেন, আর যদি তা মেনে না নেন তবে তাকে নরকে পাঠানো হবে যেখানে তাকে অগণিতবার ধর্ষণ করা হবে, তার গর্ভে জন্মানো সন্তানদের দারুণ অত্যাচারে মারা হবে। লিলিথ, প্রথম নারী, ঈশ্বরকে বলেছিলেন, ঈশ্বর একই সাথে আদম এবং লিলিথকে তৈরি করলেও, ঈশ্বর নিজে পুরুষ বলে আদমের পক্ষে কথা বলেছেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদে লিলিথ নরকের নারকীয় জীবন বেঁচে নেন। ‘জন্মান্তরচক্রের সেতু’র নিচ থেকে উঁচিয়ে থাকা লাল নখের মধ্যাঙ্গুলি দেখে মনে হয়, লিলিথ যেন কেবল কিন্নর নয়, পুরো মানবজাতির দিকে মধ্যাঙ্গুলি উঁচু করে আছে। সেতু পার হলে এবার সামনে শুভ্র স্বর্গের দ্বার। স্বর্গ দ্বার পাহারা দিচ্ছে একদিকে ‘মৃত্যু’ আরেকদিকে ‘রাহু’। ‘মৃত্যু’কে আমরা সবাই জানি। ‘রাহু’ হল সেই চরিত্র যে মানুষের জীবনে অশুভ বার্তা আনে, রাহু যখন সূর্য বা চন্দ্রকে গ্রাস করে, তখন পৃথিবীর মানুষ সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ দেখে। স্বর্গদ্বার পেরিয়ে এলে মূল কক্ষ- ‘বিচারালয়’ বা উবোসোট। উবোসোটের অন্দর সজ্জিত নানা রঙের ম্যুরালে- উজ্বল পৌরাণিক দানবের মুখ থেকে শুরু করে হাল আমলের মাইকেল জ্যাকসন, হ্যারি পটার, সুপারম্যান এতে জায়গা করে নিয়েছে। আর আছে এখানে সেখানে পৌরাণিক সাপ। প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের অমানবিক কর্মযজ্ঞ- যুদ্ধ, জঙ্গি হামলা এবং প্রকৃতি ধ্বংসও। সব মিলে এক পরাবাস্তব জগত তৈরি করা হয়েছে থাইল্যান্ডের উত্তরের শহর চিয়াং মাই এর বিখ্যাত সাদা মন্দির ওয়াট রং খুন বৌদ্ধ মন্দিরে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল, মন্দিরের ভাস্কর্য বা চিত্রকর্মে পৌরাণিক বা বাস্তবিক যে-কোন নারী চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পুরো মন্দিরের মূল অংশ করা হয়েছে সাদা প্লাাস্টার আর কাঁচ দিয়ে। আকাশের নানান রঙে বদলে যায় মন্দিরের আভা। পৃথিবীর নানা দেশের লাখ লাখ মানুষ এটি দেখতে আসত মহামারীর আগের সময়ে। আমি গিয়েছিলাম ২০১৭ এর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে। বিংশশতকের শেষ দিকে এক ভগ্ন মন্দিরের উপর গড়ে তোলা হয়েছে এই সাদা মন্দিরটি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্থায়ীয় শিল্পী চালেরমাচাই কোসিসপিপাট নিজস্ব অর্থায়নে এবং নকশায় বানানো শুরু করেন এ মন্দিরটি। ১৯৯৭ সালে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং এর কাজ চলবে ২০৭০ সাল পর্যন্ত। শিল্পী এখানে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন প্রতীকী বিষয়। সাদা রঙের মূল ভবনের পাশে করা হয়েছে সোনালি রঙের আরেকটি ভবন। যেটি ব্যবহার করা হয় শৌচাগার হিসেবে। এখানে শিল্পী হয়ত বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের ধন-রত্ন, অর্থ সব একসময় বিসর্জন দিতেই হয়।

থাইল্যান্ডের এই শহর হল উত্তর আধুনিক চিত্র এবং ভাস্কর্যশিল্পীদের আবাসভূমি। চিলেরমেচাই ছাড়া এমন ঐতিহ্য, আধুনিকতা, পরাবাস্তবতাকে এক করে তার ছাত্র পুথা কাবকাইউ নির্মাণ করেছেন ‘নীল মন্দির’ বা ওয়াট রং সুইয়ে তেন। বলা হয় এই ধারার শুরু হয়েছিল চিলেরমেচাই এর গুরু থাওয়ান দুচানে। তিনি নির্মাণ করেছেন ‘কালো বাড়ি’ যেটি পরিচিত ‘নাম দাম’ হিসেবে। সময়ের অভাবে কালো বাড়ি আর নীল মন্দির দেখার সুযোগ হয়নি। সন্ধ্যায় মন্দির দেখা শেষ করে সারা দিনের ক্লান্তি কাটাবার জন্য পা ভেজাতে গেলাম প্রাকৃতিক উষ্ণপ্রস্রবনে মানে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি গরমজলের ঝিরিতে। প্রচলিত বিশ্বাস এতে স্নান করলে শরীরের ব্যথা-বেদনা কমে যায়। গরমজলের ঝিরিতে পা ডুবিয়ে দুহাতের উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে মাথার উপর পরিষ্কার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কালপুরুষকে দেখতে পেলাম। মনে হলো কালপুরুষ যেন এই মহাবিশ্বকে নয়, আমাকেই পাহারা দিচ্ছে। বলছে, ‘রূপা, যাও যেখানে ইচ্ছে, ভয় নেই, আমি আছি মাথার উপরে।’
পরের দিন বিকেলে বেড়াতে গেলাম চিয়াংরাই এর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। বছরের এই সময়টায় খুব একটা ফুল থাকে না। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এখানে হয় বিশাল ফুলের প্রদর্শনী। শত শত বা হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ ফুল নিয়ে আসা বিভিন্ন দেশ থেকে। বাগানের এক কর্মী ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলছিল। একা এসব জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার একটাই সমস্যা, সেটি হল ভাষা। খুব কম মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। এ নিয়ে অবশ্য ওদের কোন মাথা ব্যথা নেই। একবার আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম একটা কাজে। একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল্‌ না যে আমার সাথে কথা বলবে। শেষপর্যন্ত এক গ্রাহক এসে দোভাষীর কাজ করেছিল। বাগানের কর্মীটি বলল, চিয়াংরাই-এ এসে লম্বাগলার মানুষ দেখে না গেলে পুরো সফরই ব্যর্থ। শরণার্থী নিয়ে কাজ করার সুবাদে এই জনগোষ্ঠীর কথা কিছুটা জানা ছিল। লম্বাগলার বলতে কায়ান আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষদের বোঝানো হয় এখানে। কায়ান আদিবাসীরা বৃহত্তর কায়ান আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এদের নিবাস মূলত মিয়ানমার নামে বার্মায় ছিল। আশির দশকে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ এবং জাতিগত বিদ্বেষের কারণে কায়ান আদিবাসীরা প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডের উত্তরের এলাকাগুলোতে এসে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের জন্য শরণার্থী শিবির তৈরি করা হয়। কায়ান জাতির নারীরা ৫-৯ বছরের পর থেকে গলায় তামার তৈরি রিং পড়তে শুরু করে, লম্বা গলা তাদের কাছে সৌন্দর্যের অংশ। এক এক বছর করে গলায় বাড়তে থাকে রিঙের সংখ্যা, বাড়তে থাকে রিঙয়ের ওজন, ইঞ্চি ইঞ্চি করে লম্বা হতে থাকে গলা। পূর্ণবয়স্ক নারী প্রায় ৮-১০ কেজি ওজনের ৩০-৩৫টি রিং পরে থাকে। গবেষকেরা বলছেন, গলা আসলে লম্বা হয় না। রিং এর ভারে বুকের খাঁচা মানে পাঁজরের উপর চাপ পড়ে এবং তা বসে যেতে থাকে, ফলে গলা লম্বা দেখায়। থাইল্যন্ডের সরকার একসময় কায়েন শরণার্থী শিবিরগুলো দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়। এতে শরণার্থী শিবিরের মানুষের এবং সরকারের উভয়ের কিছু আয়-রোজগার হয়। একসময় গলায় রিং পড়ে গলা লম্বা করা ঐতিহ্য থাকলেও, এখন এর আরেকটি কারণ হল পর্যটকদের আকর্ষণ করে অর্থ উপার্জন করা। মানুষকে যখন পণ্যে পরিণত করা হয়, সে বড় লজ্জার। তাই কায়ান নারীদের দেখতে যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকের ভেতর চাপ অনুভব হয়। চিড়িয়াখানার জন্তুর সাথে এভাবে মানুষ দেখার খুব কি পার্থক্য আছে? আধ্যাত্মিক সাধনার মন্দিরে নারী উপেক্ষিত হলেও, ঐতিহ্যের ভার বহনের দায় ঠিকই চেপে বসে নারীর উপর।
হোটেলে ফেরার পথে দেখলাম শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা চিয়াংরাই শহরের আরেকটি বিখ্যাত স্থাপনা ‘ঘড়ির স্তম্ভ’ বা ‘ক্লক টাওয়ার’, এটিও নকশাও করেছেন শিল্পী চালেরমাচাই। শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে সোনালি রঙয়ের ঘড়ি মানুষকে যেন বলার চেষ্টা করছে- ‘সব প্রাচুর্য ভেসে যাবে সময়ের সাথে সাথে’ নাকি বলছে ‘মানুষ তোমার সময় শেষ হয়ে আসছে এই যে একটা মিনিট গেল, এই গেল একটা ঘন্টা।’ ফিরতে ফিরতেই ঠিক করে ফেললাম মিয়ানমার যাবো এপ্রিলে নববর্ষ উদযাপনের জন্য। এই দেশটিকে বাংলাদেশের সীমানা থেকে দেখেছি, থাইল্যান্ডের সীমানা থেকে দেখেছি। এবার দেশটিতে গিয়ে দেখবার পালা।
rupsbd@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিল্পজগতে লিঙ্গ ও বর্ণ বৈষম্যে গেরিলা বালিকারা
পরবর্তী নিবন্ধআগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চক্রান্ত চালাচ্ছে বিএনপি