প্রযুক্তি জগতের নতুন বিস্ময়-চ্যাট জিপিটি

একাডেমিক ও কর্মক্ষেত্রে যে প্রভাব আসন্ন

| বৃহস্পতিবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

চ্যাট জিপিটি (ChatGPT), অতি সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তি জগতের নতুন এক বিস্ময়ের নাম। এটি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স) সম্পন্ন ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং টুল বা চ্যাটবোট। যেটি ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর বাজারে ছেড়েছে ওপেনএআই (OpenAI)। বাজারে উন্মুক্ত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটির সাবস্ক্রাইবার এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে এই মুহূর্তে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছে।

প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের কাছে আজকাল ‘চ্যাটবোট’ শব্দটি অধিক পরিচিত। চ্যাটবোট হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) এবং মেশিন লার্নিং- এর মাধ্যমে পরিচালিত একটি ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজ বেইজড ‘হিউম্যান-লাইক’ কনভারসেশনাল প্ল্যাটফর্ম। বিশ্বের আধুনিক সব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই এই ইনোভেশনটি অ্যাডপ্ট করেছে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা চ্যাট এর মাধ্যমে ছোটখাটো যেকোন প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষনিকভাবে জেনে নিতে পারেন।

উদাহরনস্বরূপ, আপনার অফিস কিংবা বাসার ইন্টারনেট কাজ করছেনা। আপনি সেটা আপনার ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে জানাতে চান। এই কথোপকথনটি আপনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুকে চ্যাটবোটের মাধ্যমে সেরে ফেলতে পারেন। চ্যাটবোট ইন্টারনাল ডাটাবেইজ ব্যবহার করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে। এতে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে দীর্ঘক্ষন অপেক্ষার ঝক্কি থেকে যেমন রেহাই পাওয়া যায়, তেমনি প্রতিষ্ঠানে স্বশরীরে উপস্থিত হবার ঝামেলা থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। আবার ধরুন, কোনো বিষয়ের উপর বই বা প্রবন্ধ খুঁজতে চান। যেকোন লাইব্রেরির ওয়েব পেইজে ঢুকে চ্যাটবোটে আপনার পছন্দের বইয়ের তালিকা, এভেইলেবিলিটি বা এতদসম্পর্কীয় যেকোন প্রশ্ন রাখতে পারেন। সে চটজলদি আপনাকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়ে দেবে। ব্যাংক, বীমা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট সবক্ষেত্রেই আপনি এই সুবিধাটা পেতে পারেন। এতে সেবা প্রদানকারী ও সেবা গ্রহনকারী দুপক্ষই সময় এবং খরচের অপচয় রোধ করতে পারে।

তবে এটি অবশ্যই হিউম্যান-এজেন্ট বেইজড চ্যাট অপশন থেকে আলাদা। চ্যাটবোটগুলো কাস্টোমারকে ‘ইমিডিয়েট’ রেসপন্স দিতে পারলেও এরা জটিল সমস্যা সমাধানে অনেকাংশেই অপারগ। এছাড়াও বেশ কিছু চ্যাটবোট প্রবন্ধ বা নানারকম লেখেলেখির কাজেও ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

আবার যারা গুগল অ্যাসিস্টেন্ট (জিএ), অ্যামাজনের এলেক্সা কিংবা আইফোনের সিরি সম্পর্কে জানেন, তারাও এইসব এআই ফিচার ব্যবহার করে অনেক কিছুর উত্তর (Query) সহজেই জেনে নিতে পারেন। যেমন, আপনি কোথাও বেড়াতে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। যাওয়ার আগে সেই জায়গা সম্পর্কে- সেখানকার আবহাওয়া, আশপাশের দর্শনীয় স্থান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে আপনি সিরি’কে প্রশ্ন করতে পারেন। সিরি আপনাকে উত্তর দেবে। কিছু ওয়েব পেইজের লিংকও দিয়ে দেবে। আপনি প্রয়োজনীয় তথ্যের সহায়তায় ভেকেশন প্ল্যান তৈরী করতে পারেন। সিরি বা গুগল অ্যাসিস্টেন্টের সাথে নিয়মিত কথা বলে ভাষাগত দক্ষতাও বাড়ানো যায়।

তবে চ্যাট জিপিটি তার পূর্বসুরীদের চাইতে একেবারেই ভিন্ন। প্রযুক্তির ভাষায় এটি একটি ‘ডিসরাপ্টিভ’ ইনোভেশন। আগের চ্যাটবোট গুলো হিউম্যান কনভারসেশন-কে মিমিক (Mimic) করলেও চ্যাট জিপিটি একটি ভারস্যাটাইল প্ল্যাটফর্ম। এটি যেকোন বিষয়ের উপর কবিতা বা নাটক লেখা, গানের লিরিক বা সুর কম্পোজ করা, ম্যাথ, ফিজিক্স ইত্যাদির সল্যুশন বের করা, স্টুডেন্টদের জন্য যেকোন বিষয়ের উপর অ্যাসাইনমেন্ট/ প্রবন্ধ লেখা, বানান এবং ব্যাকরণ ঠিক করে দেয়া, কম্পিউটার প্রোগ্রাম ‘ডিবাগ’ করা, পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ের উপর রচনা/প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা, যেকোন বিষয়ের উপর টিপস এন্ড ট্রিকস, গেইম খেলা, সিমুলেশন ইত্যাদি মুহূর্তেই করে ফেলতে পারে।

ধরুন, একজন প্রোগ্রামার বাগ ফিক্সিং এর জন্য কোড তৈরী করতে চাইছেন। এ সম্পর্কিত কোড জেনারেট করতে চ্যাট জিপিটি-কে বললে দেখা যাবে সেকেন্ডেই সব কোড প্রস্তুত। জোছনা কিংবা প্রেম নিয়ে কবিতা লিখতে বলবেন, দেখবেন আপনার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে প্রেমময় কবিতা। তাও একদম নতুন। কারো কবিতার কপি নয়।
একই ভাবে রোমান্টিক নাটক বলুন আর সিভি বলুন, মুহুর্তেই লিখে দেবে এই চ্যাট জিপিটি। কি ভাবছেন! তবে কি মানুষের সক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, সৃষ্টিশীলতা এসবের চৌদ্দটা বেজে গেল? প্যাটেন্ট, কপিরাইট, একাডেমিক চৌর্যবৃত্তিরই (Plagiarism) বা কী হবে? এখন থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই কি নিয়ন্ত্রন করবে মানুষের চিন্তা ভাবনা, কাজকর্ম, ব্যবসা বানিজ্যসহ সবকিছু?

তবে এটা ঠিক যে, এর সঠিক ব্যবহার ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যেমন ব্যাপক সক্ষমতা বাড়াবে ঠিক একই সঙ্গে সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হবে। যে সকল সেক্টর এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে খাপ খাওয়াতে পারবেনা, তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং তাদের বিদায় আসন্ন। চাকরির বাজারেও এর ভয়ংকর প্রভাব পড়তে পারে। অনেক কাজ যখন যন্ত্রই করে দেবে, মানুষের মতোই যখন সে চিন্তা ভাবনা করবে, বুদ্ধি খাটাবে তখন মানুষের আর প্রয়োজন কি? একাডেমিক ক্ষেত্রেও চ্যাট জিপিটি’র বঢ় ধরণের প্রভাব পড়বে। শিক্ষার্থীরা তাদের কাজগুলো এই বিস্ময় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই করে ফেলবে। তেমনি গবেষকরাও এই প্রযুক্তির ফায়দা নেবেন। পিয়ার-রিভিঊড জার্নালের এডিটর এবং রিভিউয়াররা ইতিমধ্যেই এর ব্যবহারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।

চ্যাট জিপিটি হয়ে উঠতে পারে সম্ভাব্য সহ-লেখক (Co-Author)। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে একাডেমিক ইন্টিগ্রিটি বজায় রাখার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীদের কাছে সতর্কতামূলক ইমেইল পৌঁছে গেছে। আমি অস্ট্রেলিয়ার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পিএইচডি অধ্যয়ন করছি, বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছ থেকে বুধবারই এসংক্রান্ত ইমেইলটি পেয়েছি। তবে কতটুকু প্রস্তুতি এর অপব্যবহার ঠেকাতে পারবে তা জানতে আমাদের আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। অবশ্য চ্যাট জিপিটির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন, ইংরেজীর বাইরে বাকী ভাষাগুলোতে দূর্বল শব্দের প্রয়োগ কিংবা ব্যাকরণগত ত্রুটি ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা এরইমধ্যে এটি ব্যবহারকালে তথ্যসংক্রান্ত ভুলক্রটির ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে যা-ই বলুক, আমার মতে অজানাকে জানতে চ্যাট জিপিটির তুলনা হয়না। তাই অজানাকে জানুন-প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান রাখুন। এক্সপ্লোর করুন বিস্ময়কর ইনোভেশন চ্যাট জিপিটি।

লেখক- দীপান্বিতা ভট্টাচার্য, সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার বন্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি অধ্যয়নরত)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটানা চতুর্থ হারে রেলিগেশন শঙ্কায় মোহামেডান
পরবর্তী নিবন্ধলায়ন্স ক্লাবের প্রাক্তন জেলা গভর্নরদের মতবিনিময় সভা