শিক্ষাক্ষেত্রে নব দিগন্তের প্রত্যাশা

নেছার আহমদ | সোমবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

মানুষের মাঝে শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো ইতর বা পশুস্তরের মানুষকে সাধারণ জ্ঞান, বুদ্ধিসম্পন্ন ও বিবেকবান মানুষে পরিণত করা। এ শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের মাঝে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, অধ্যাপক, শিক্ষক, মৌলভী, মেকানিক, মিস্ত্রি, নার্স, ধাত্রী সহ বিভিন্ন পেশাধর্মী মানুষ তৈরি হয়। স্বাভাবিক একটি সুশিক্ষিত ও সুসভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সে আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্যই আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি।
২০২৫ সাল থেকে পুরোপুরি নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোন পরীক্ষা দিতে হবে না। নবম ও দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক কিংবা বাণিজ্যের মতো কোন বিভাগ থাকবে না। ২০২৩ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসপি) ও অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জিএসসি) পরীক্ষা থাকবেনা বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা উপস্থাপনের পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বর্ণিত বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণি।
নতুন শিক্ষা কার্যক্রমের ফলে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘ দিনের একটি প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে, নতুন আঙ্গিকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে যে কার্য্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে সে দিকে লক্ষ্য রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছেন। যা আমাদেরকে আশান্বিত করেছে।
নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোন পরীক্ষা থাকবেনা। দশম শ্রেণী পর্যন্ত থাকবেনা পাবলিক পরীক্ষা। উঠে যাবে জেএসসি, পিএসসি এবং সমমানের সকল পরীক্ষা। দশম শ্রেণীর পাঠ্যক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দু’টি পরীক্ষা নিয়ে সেই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে দেয়া হবে এইচএসসি ফলাফল। অন্য শ্রেণীগুলোতে হবে সমাপনী পরীক্ষা। সমাপনীতে ধারাবাহিক মূল্যায়নের সঙ্গে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। প্রথম শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যক্রম একই থাকবে। একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক কিংবা বাণিজ্যের মতো কোন বিভাগে পড়বে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যত স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হলেও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়ে কোন কিছুই উল্লেথ নেই। আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত মৌলভীদেরকেও পেশাজীবী শ্রেণীতে গণ্য করা যায়। কিন্তু দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তবসম্মত আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। বর্তমানে আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বাস্তবায়ণের তিনটি শাখায় বিভক্ত (ক) আলিয়া বা সুন্নিয়া মাদ্রাসা, (খ) আহলে হাদিস বা ওহাবী মাদ্রাসা, (গ) কওমী মাদ্রাসা। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ন্যায় স্কুলিং নয়। ফলে তাদের মাঝে সামাজিক দায়িত্ব গড়ে উঠে না বললেই চলে। বিশেষজ্ঞদের মতে বিভিন্ন পেশার ছাত্ররা সকলেই একই রকম সাধারণ বা অসামপ্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থায় ১ম হতে ১২তম শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ সম্ভব হলে একটি আধুনিক মানবিক বোধ ও বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গড়ে তোলা যাবে। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য দেশের মত বাংলাদেশেও একটি মাত্র শিক্ষা পদ্ধতি বা ইন্সটিটিউশনালাইজড স্কুলিং সিস্টেম রাখা প্রয়োজন। ধর্মীয় শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। মুসলিম ধর্মীয় শিক্ষা অবশ্যই থাকবে এবং সবার জন্য থাকবে। আমাদের গ্রাম্য পাঠশালায় প্রতিটি মসজিদে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার জন্য মক্তব রয়েছে প্রয়োজনে আরো মক্তব তৈরি করতে হবে যা ইউনিয়ন কাউন্সিলের তত্বাবধানে সম্ভব। বর্ণিত বিষয়গুলো শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে পর্যালোচনা পূর্বক বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বর্তমানেও বইয়ের চাপে শিশুরা তাদের স্বাভাবিক বিকাশ হারাতে বসেছে। ক্লাসের পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বসতে হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায়। এক গাদা বইয়ের বোঝা বইতে বইতে তাদের শারীরিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অভিভাবকরা দীর্ঘ সময় এবিষয়ে কষ্টের মাঝে দিন অতিবাহিত করে আসছে। শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ সময় ধরে শিশুদের ক্লান্তিকর পড়ালেখায় চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন ও সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে আমি সরকারের ও বিশেষজ্ঞ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে “বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখে তা প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরণ করেছিলাম, যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়।
বর্তমানে প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থাটি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এবং দীর্ঘদিন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এই শিক্ষাক্রম ২০২৫ সালে পুরোপুরি চালু হলে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দ ঘন শিক্ষা নিশ্চিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
শিক্ষার্থীরা শ্রেণী কক্ষেই যেন অধিকাংশ পাঠ গ্রহণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা এই শিক্ষাক্রমে রয়েছে। এতে বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমবে বলে মনে করেন অভিভাবকরা। মুখস্ত শিক্ষা নির্ভরতার বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রম ভিত্তিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে এ শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্য্যক্রমে।
সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে শিশুদের ওপর থেকে পরীক্ষায় চাপ কমানোর এ উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। বিশ্বের উন্নতদেশগুলোতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা নেয়া হয় না। নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষক নির্ভর পড়াশুনার প্রতি মনোযোগী হতে পারবে। খসড়া শিক্ষাক্রমে স্থান পেয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা। অদূর ভবিষ্যতে প্রণয়ন করা হবে উচ্চ শিক্ষার কার্যক্রম। দ্বাদশ শ্রেণীর পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী চলে যায় কারিগরি শিক্ষার দিকে। এ ব্যবস্থায় এক দিকে যেমন দক্ষ ‘জনশক্তি’ গড়ে উঠবে অন্য দিকে হ্রাস পাবে বেকারত্ব।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝেও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হলে বেকার সমস্যা অনেক হ্রাস পাবে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ বন্ধ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুগোপযোগী পরামর্শের আলোকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিগরি শিক্ষার বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত।
বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার আরও আধুনিকায়ন এবং শিক্ষা কার্যক্রমকে সময়োপযোগী করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা মনে করি যে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদেরকে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সে জন্য শিক্ষা কার্য্যক্রমকে সময়োপযোগী করা একান্ত অপরিহার্য।” শিক্ষা ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং কার্যক্রম প্রণয়ন বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবক মহলকে ব্যাপকভাবে আশান্বিত করেছে।
শিক্ষা কার্যক্রমে মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে আধুনিক কারিগরি শিক্ষার কার্য্যক্রমকে সম্পৃক্ত করে উচ্চ শিক্ষাক্রম প্রণীত হলে শিক্ষা ব্যবস্থা আরো বাস্তব সম্মত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে শিক্ষা গবেষকরা বলেন, অল্প বয়সের বাচ্চাদের পাবলিক পরীক্ষা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পড়াশোনা হতে হবে খেলাধুলার মতো আনন্দময়। বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সলর এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উজ্জ্বল নাম পবিত্র সরকারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “যখন শিশুরা বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে একটি কবিতা মজা করে আনন্দের ছলে আবৃত্তি করেন তখন সেটি হয়ে উঠে খুবই আনন্দময়। কিন্তু সেই একই কবিতাটি যদি ক্লাসে মুখস্ত করতে শিশুদের বাধ্য করা হয় এবং সেটিকে পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত করা হয় তখন সেটি হয়ে উঠে “যন্ত্রনাদায়ক”। সুতরাং শিশুদেরকে আনন্দময় পরিবেশে খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি শিক্ষাক্রমে অন্তভূক্তি করে সকলের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে।
পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া জন্য শিশুদের ওপর স্কুল এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে যে চাপ দেয়া হয় সেটা তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষাবিদ্‌দের মতে, শিশুদের ওপর যখন তাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি চাপ দেওয়া হয় তখন সেটা তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। এটা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। প্রচলিত বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায়। এতোসব পরীক্ষার কারণে ছেলে মেয়েদের মাঝে লেখাপড়ার ব্যাপারে অনীহা এসে গেছে। এ অবস্থা হবে উত্তোরণের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে এবং তা অভিভাবকদেরকে আশান্বিত করবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হোক। সুষ্ঠুভাবে ২০২৫ সালে পুরোপুরি নতুন শিক্ষাক্রম বাঁধাবন্ধনহীনভাবে শুরু হবে এটি আমাদের প্রত্যাশা।
আমরা আশাকরি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা পরবর্তীতে একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম তৈরি করে জাতির কাছে রেখে যাওয়া সম্ভব হবে। যারা সৃষ্টি করবে নতুন স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে যেন কোন সাম্প্রদায়িক শক্তি, কোন উগ্রবাদী শক্তি মাথাছাড়া দিয়ে না উঠে এবং শান্তিময় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এটি সরকারের নিকট আমাদের সকলের কাম্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক-শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে হাসান মাহমুদ চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর