আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | সোমবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

মানুষ বিজয়ী হতে পারে ক্ষমা আর ভালোবাসার মাধ্যমে

কৈশোর, তারুণ্যে অনেক গল্প-কবিতা উপন্যাস পড়তাম। ভ্রমণ কাহিনীর বইও আমার খুব প্রিয় ছিল। কল্পনা করতাম বড় হয়ে আমি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে কাঁধে ব্যাগ, মাথায় ক্যাপ, হাতে ক্যামেরা নিয়ে দেশ-বিদেশের সাগর, পর্বত, জঙ্গল, শ্যামল প্রান্তরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর বিখ্যাত স্থান, স্মরণীয় কীর্তি দেখে বেড়াবো। তাই ভ্রমণ কাহিনীর বইগুলো সযত্নে রাখতাম। পাঠ্যগ্রন্থ “বিলাতে সাড়ে সাতশ দিন” সংরক্ষিত রেখেছিলাম। অনেক বৎসর ভেবেছিলাম যখন ইংল্যান্ড যাবো বইটি সাথে নিয়ে যাব। তাহলে দ্রষ্টব্য স্থানগুলো সহজে দেখতে পারবো। কিন্তু পুরানো জিনিস যত্নে রাখলেও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় বইটি কিছুতে খুঁজে পেলাম না। অনেক পরে বাসা বদলের সময় বইটি পেয়েছিলাম। আমাদের বাসায় বই পত্র-পত্রিকা অগুনতি। কারণ আমার তিন ছেলে-মেয়ে বইয়ের পোকা। কিন্তু বইয়ের তুলনায় আলমারি ও সেলফের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। ফলে যার যেখানে খুশি বই, পত্র-পত্রিকা রেখে দেয়। বাসায় বিশিষ্ট মেহমান এলে তখন বই, পত্র-পত্রিকা খাটের নিচে, আলমারির ওপরে, দেওয়ালের তাকে রেখে কোন মতে ঘর গুছিয়ে রাখতাম। সবাই ড্রইং রুম সাজাবার জন্য সুন্দর সুন্দর জিনিস ক্রয় করে। আমি ও আমার ছেলে-মেয়েরা বই কিনতে পছন্দ করি। তাই আমার বাসায় এলে অনেকে হতাশ হন। কক্ষগুলো নিতান্তই সাদামাটা। তবে ফুল, লতা-পাতার বাগান বাসার চারপাশে। উঠানে দোলনা। সকালে দোলনায় বসে পত্রিকা, বিকেলে বই পড়তে ভাল লাগে। উন্মুক্ত আকাশ, দখিনা বাতাস, ফুলের সুবাস ও শোভা। এটুকুই আমার বিলাসিতা।
কলতাকার মাসিক পত্রিকা “সানন্দা’য়” দেশ বিদেশের ভ্রমণের ছবিসহ (পত্রিকার পাতাগুলো যেমন মোলায়েম, ছবিগুলো তেমনি অপূর্ব) প্রতিবেদন থাকে। পড়লে মনে হয়, “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা।” বেশিরভাগ ভ্রমণের প্রতিবেদন জমিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু ইউরোপ যাবার সময় খুঁজে পাই না। অনেক পরে একদিন বিছানার তোষকের নিচে সেগুলো পেলাম। আমার প্রয়োজনীয় কাগজ ও পত্রিকা বিছানার নিচে রাখতে হয় কারণ ডোমেস্টিক কেয়ারটেকাররা আমার অগোচরে বিক্রি করে দেবার জন্য প্রায় সময় পত্র-পত্রিকা নিয়ে যায়। অথচ পছন্দনীয় ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমার জমিয়ে রাখার স্বভাব।
কৈশোরে পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম “এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং” আমেরিকার সবচেয়ে বড় (১০২/৩ তলা) বিল্ডিং। এরপর বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পৃথিবীর উন্নত ও ধনী অনেক দেশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমেরিকার শিকাগোর কাছে দেবর আর্কিটেক্ট আতিকুর রহমান সপরিবারে থাকেন। একদিন তিনি আমাদের “সিয়ারস টাওয়ার” এ (১৯৮৩ সাল) নিয়ে গেলেন। ২৫ বছর ধরে সর্বোচ্চ উঁচু টাওয়ার সিয়ারস (বর্তমানে উইলিস টাওয়ার) এর নকশা প্রদান করেন বাংলাদেশী (আমেরিকায় বসবাস করছিলেন) স্থপতি ও পুরাকৌশলী জনাব ফজলুর রহমান খান। তাকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী বলা হয়। সর্বোচ্চ ভবন নির্মাণের ফর্মুলা তিনি প্রথম তৈরি করেন। তাঁকে বলা হয়, “স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন।” “কযধহ ধষংড় ধ ঢ়রড়হববৎ রহ পড়সঢ়ঁঃবৎ রিফবফ ফবংরমহ”.
১৯৮১ সালে সৌদি আরবের জেদ্দায় নির্মাণ করেন সৌদি আরবের সর্ববৃহৎ ও বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিমান বন্দরসহ হজ্জ টার্মিনালের ছাদ কাঠামো (৫০,০০০ বর্গফুট) এবং বাদশাহ্‌ আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য নকশা তাঁরই তৈরি। তাঁর নামে শিকাগোতে সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। তিনি রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করতেন। তাঁর কবরের ওপর লেখা রয়েছে “তোমার হল শুরু, আমার হল সারা, তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা।”
জনাব ফজলুর রহমান সিয়ারস টাওয়ারের ডিজাইন ও প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করেছিলেন। সিয়ারস টাওয়ারে প্রবেশ করলে প্রথম কক্ষেই তার প্রতিমূর্তি দেওয়ালে খোদিত রয়েছে। আমাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। সে অশ্রু আনন্দের। দেশের ভাল কিছু দেখলে বিদেশে মনে অপরিসীম আনন্দ সৃষ্টি হয়।
এরপর একদিন নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার দেখতে গিয়েছিলাম (১৯৮৩ সাল)। এতো উঁচু দালান দেখলে বিস্ময় সীমা হারায়। ২/৩ টা লিফট পরিবর্তন করে উপরে উঠতে হয়। একদম উপরে উঠলে নিচের সবকিছু পিঁপড়ের মত ছোট দেখতে লাগে। ছাদের চারদিকে দুরবিন রয়েছে। এত বড় দালানে কত অফিস, বাসস্থান। সত্যিই বিস্ময়কর! লেখক যাযাবর বলেছেন, “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ”। তাই টুইন টাওয়ার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম কিন্তু মনে আবেগ সৃষ্টি হয়নি। তাজমহল দেখে আমার ভাল লেগেছিল। অপূর্ব সুন্দর! কি বিস্ময়কর মহিমা। গভীর ভালবাসা আর অপূর্ব কারুকাজের সৃষ্টি। পূর্ণিমার রাতে তাজমহরের কি অসামান্য শোভা। ব্যথা বেদনায়, সৌন্দর্যে-মমতায় উর্মিমুখর সাগরের মত গভীর আবেগ অন্তরে উথলে ওঠে।
টুইন টাওয়ার ছিল আমেরিকার গর্ব, অহংকার। আমরা জানতাম আমেরিকা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অসাধারণ। পৃথিবীর সব খবর আমেরিকার নখদর্পণে। উপগ্রহ, রাডার, গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিমূহূর্তে আমেরিকা পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে জানতে পারে। এতো পাওয়ারফুল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তিনি কি বলেছেন? কোরান শরীফের অনেক পাতায় লেখা আছে মহান আল্লাহ ইচ্ছে করলে মুহূর্তে সব গর্ব, সব শক্তি ধ্বংস করে দিতে পারেন। বাস্তবে চোখের সামনে ঘটলো। টেলিভিশনে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমরা প্রত্যক্ষ করলাম হঠাৎ একটি প্লেন দ্রুত গতিতে এসে টুইন টাওয়ারে আঘাত করলো আর মুহূর্তে বাষ্প আর ধুলোর মাঝে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সব ধ্বংস হয়ে গেলো। নিজের চোখকে আমার মত দুনিয়ার কোন মানুষ যেন সেদিন বিশ্বাস করতে পারছিল না। সত্যি কি অসম্ভব ঘটনা।
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরিকল্পনা নিশ্চয়ই একদিনের ছিল না। নিউইয়র্কের আকাশ সীমানায় প্লেন নিরাপদে প্রবেশ করলো কিভাবে। মুহূর্তে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়া কি এতই সহজ। নিরাপদ রাখার কোন ব্যবস্থাই কি ছিল না। “সুরা আর রাহমান”-এ বারবার বলা হয়েছে “ফাবি আইয়্যি আ-লা ই রাব্বিকুমা তুকায যিবান” অর্থ্যাৎ তোমরা রবের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে ? আমরা জানি আল্লাহ “হও” বললে সব কিছু মুহূর্তে হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ কি চান? আল্লাহ চান শান্তি। ইসলাম অর্থ শান্তি। সব ধর্মেই বলা হয়েছে মানুষকে ভালোবাসো তবেই আল্লাহর ভালবাসা পাবে। তাহলে কেন এতো যুদ্ধ, এতো সন্ত্রাস। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর সমগ্র মুসলমান জাতিকে সন্ত্রাসীরূপে চিহ্নিত করা শুরু হলো। অথচ লাদেন, তালেবান, সাদ্দাম সৃষ্টি করলো কারা? আজ তালেবানকে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র দিচ্ছে কারা? সমগ্র পৃথিবীতে ইহুদিদের কোন বাসভূমি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি বিজ্ঞানী মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল। তাই প্রতিশ্রুতি মত ইহুদিদের মিত্রপক্ষ বাসভূমি দিল। কোথায়? ইউরোপ-আমেরিকায় খৃষ্টানদের মাঝে না। দিল মুসলমানদের বাসভূমির কাছে। ইহুদি এখন দখল করে নিচ্ছে মুসলমানদের জায়গা। ফলে লেবানন প্যালেষ্টাইনে আজও যুদ্ধ। অথচ মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের কোন সাংঘাতিক যুদ্ধ ছিল না। বরং জার্মানির হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। হযরত মুহাম্মদ (স:) মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীকে দেখিয়েছিলেন যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। ক্ষমা ও ভালবাসার মাধ্যমে মানুষ বিজয়ী হতে পারে। যীশু খৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল কারা? তারা তো মুসলমান ছিলেন না। কোরআন শরীফের সূরা নাস (৪) এ বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ তায়ালা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ হতে দেননি। তিনি তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে কেন খৃষ্টান ও ইহুদির সন্ত্রাস মুসলমানদের সাথে শুরু হলো। সমগ্র মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হলো কিভাবে?
আজ পৃথিবীর অনেক দেশে যুদ্ধ চলছে। উন্নত অনেক দেশ দু’পক্ষকে সহযোগিতা করছে মারণাস্ত্র দিয়ে। প্রতিবছর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দিন সমগ্র পৃথিবীর মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। নিরীহ মানুষগুলো মারা যায় ক্ষমতালোভী, হিংসুটে পশুরূপী কিছু মানুষের কারণে। সন্ত্রাসকে যারা প্রশ্রয় দেয়, সহযোগিতা করে তাদের বিরুদ্ধে কবে পৃথিবীর মানুষ সোচ্চার হবে? প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কিছু মানুষের লোভ, হিংসা, বিক্ষোভ, প্রতিশোধ পরায়ণতা নির্বিচারে হত্যা করছে নিরীহ মানুষকে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস একটি করুণ নিদর্শন। স্রষ্টা ইচ্ছে করলে এক মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে পারেন মানুষের গর্ব, অহংকার, রাজত্ব, সভ্যতা সবকিছু। তবুও কি মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে। আল্লাহ জানেন যুদ্ধ নয় শান্তি বেশিরভাগ মানুষের কাম্য। করোনা মহামারি হয়তো একদিন বিলুপ্ত হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর ভদ্রতার মুখোশধারী মানুষগুলোর লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ কি কোনদিন বিলীন হয়ে পৃথিবীতে শান্তি এনে দেবে?
লেখক : কবি- কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাক্ষেত্রে নব দিগন্তের প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধহাসিনা জামাল কলেজে নবীন বরণ