শাঁওলি মিত্র, একজন নক্ষত্র

রিতু পারভী | শনিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্র আর তৃপ্তি মিত্রের সুযোগ্য কন্যা শাঁওলি মিত্র, যার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে বলিষ্ঠ এক মঞ্চ অভিনেতার চেহারা সামনে ভেসে উঠে সবার আগে। একাধারে লেখক ও পরিচালক, অভিনেতা শাঁওলি মিত্র সুস্পষ্ট একটা যুগ তৈরি করা অত্যন্ত প্রভাবশালী এক শিল্প ব্যক্তিত্বের নাম যিনি তাঁর সাবলীল, অনবদ্য সৃষ্টি দিয়ে তৈরি করেছেন ইতিহাস। বাবামা’য়ের পরিচয়কে ছাড়িয়ে নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন উল্লেখযোগ্যভাবে।

১৯৪৮ সালে সদ্যস্বাধীন ভারতে জন্ম নেয়া শাঁওলি মিত্রের রক্তের সাথে মিশে আছে মঞ্চ আর অভিনয়, তাই ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মঞ্চে পদচারণা শুরু হয়। শুরু থেকেই অভিনয়ে অত্যন্ত সাবলীল শাঁওলি মিত্রের জীবন জুড়েই অভিনয় আর নাটক, উচ্চশিক্ষাও নাটক নিয়ে।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকের উপর স্নাতকোত্তর করা শাঁওলি মিত্র ঋত্ত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গল্প’ ছবিতে ‘বঙ্গবালা’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন। মঞ্চের শক্তিশালী অভিনেত্রী শাঁওলি মিত্র সিনেমার বিশাল পর্দাতেও যে অত্যন্ত সাবলীল তা প্রমাণ করেন, যদিও মঞ্চকে ভালোবেসে সেখানেই অভিনয় করে গেছেন আজীবন, রূপালি পর্দা তাঁকে সেভাবে টানেনি। ‘বিতত বীতংস’, ‘ডাকঘর’, ‘পুতুলখেলা’, ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’র মতো কালজয়ী সব নাটকে অভিনয় করে রঙ্গমঞ্চ কাঁপিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন শম্ভু মিত্র আর তৃপ্তি মিত্রের সুযোগ্য কন্যা শাঁওলি মিত্র।

অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক রচনা এবং পরিচালনাতেও শাঁওলি মিত্র তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এর জন্য আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯১ সালে। একজন নাথবতীর অনাথবৎ হওয়াকে অনবদ্য ফুটিয়ে তোলা হয় এই নাটকে যা হিন্দি ভাষাতেও অনূদিত হয়। অনবদ্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নেয়া শাঁওলি মিত্র উপহার দেন একের পর এক শক্তিশালী নাটক। ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘কথা অমৃতসমান’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বাবার জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘গণনাট্য, নবনাট্য, সৎনাট্য এবং শম্ভু মিত্র’। কাজ করেছেন লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। বঙ্গীয় একাডেমি অভিধান নিয়েও করেছেন অনেক কাজ। এছাড়াও শাঁওলি মিত্র তাঁর যাদুকরী কন্ঠ দিয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন অসংখ্য শ্রুতি নাটকের শ্রোতাকে।

মঞ্চনাটক অন্তঃপ্রাণ এই অসামান্য ব্যক্তিত্ব আজীবন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন শিল্পসৃষ্টিতে আর তারই ধারাবাহিকতায় অর্জন করেছেন সম্মানিত সব স্বীকৃতি। ২০০৩ সালে সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় শাঁওলি মিত্রকে। ২০০৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভূষিত করেন অত্যন্ত সম্মানিত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে। এছাড়াও ২০১৩ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ খেতাবে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। এসবই ছিল শাঁওলি মিত্রের অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি।

সারাজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সাধারণ জীবনযাপন করে যাওয়া অসাধারণ ব্যক্তিত্বের শাঁওলি মিত্র ৭৪ বছর বয়সে জীবনমঞ্চ থেকেও বিদায় নেন একজন অতি সাধারণ মানুষের মতো। ১৬ জানুয়ারি ২০২২এর এক শীতল বিকালে এই নক্ষত্রজীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন অতি নিভৃতে। বাবার মতোই তিনি নিতে চাননি কোন ফুলের ভার, তাই শেষ বিদায়ে ছিল না বিশেষ কারো উপস্থিতি। মৃত্যুর খবরও জানানো হয় শেষকৃত্য সমাপ্ত করেই। বাংলার রঙ্গমঞ্চের একটা যুগের সমাপ্ত হয় শাঁওলি মিত্রের মৃত্যুর সাথে সাথে।

বিদায়, হে সাহসী বলিষ্ঠ নাট্য ব্যক্তিত্ব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাতে পারে রাশিয়া: বাইডেন
পরবর্তী নিবন্ধসমাধি মন্দিরে সূর্যোদয়