সমাধি মন্দিরে সূর্যোদয়

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

 রূপা দত্ত | শনিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

ঘড়ির এলার্মে ঘুম ভাঙে। ভোর চারটা কি সাড়ে চারটা হবে, এখন পরিষ্কার মনে নেই। আমরা পুরানো এক বৌদ্ধ বিহার থেকে সূর্যোদয় দেখতে যাব। মিকার সাথে করে নিয়ে আসা জাপানী গাইড বইয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক বাগান শহরে অবশ্য দেখার তালিকায় একটা নির্দিষ্ট বৌদ্ধবিহার থেকেই সূর্যোদয় দেখার কথা বলা আছে। আমাদের ইজিবাইকে করে কয়েক মাইল গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে। যথারীতি গুগল ম্যাপে বিহারের ঠিকানা অফলাইনে নামিয়ে রাখলাম। দিনের আলো ফোটার মুখেই আমরা বের হয়ে গেলাম। আসার দিন যেমন ভয় লেগেছিল, এই দুই দিন ঘুরে সেই ভয় কেটে গেছে। রাস্তায় আমাদের মতোই বেড়াতে আসা মানুষজন বাইক নিয়ে ছুটছে সূর্যোদয় দেখবার জন্য। ভোরের হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় একটা হিম হিম ভাব আছে। বুদ্ধি করে উইন্ডচিটার (পাতলা জ্যাকেট মতো, পরলে বাতাস লাগে না শরীরে) পরে নিয়েছিলাম। আমি ষড়ঋতুর দেশের মেয়ে হলেও, ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারি না। তাই একটা উইন্ডচিটার বা হালকা গরম কাপড় সবসময় সাথে রাখি, আর কিছু না হোক একটা চাদর হলেও রাখি। চাদরের সুবিধা হল, ঠাণ্ডায় গায়ে দেয়া যায়, আবার বিছিয়ে বসে বা শুয়ে পড়া যায়, ধূলোবালি বেশি হলে নাক মুখ পেঁচিয়ে ফেলা যায়, এমন আরও কত্ত সুবিধে। সেযাই হোক, আপাতত চাদরের বিজ্ঞাপন এখানেই শেষ করি। মোবাইলে ম্যাপ দেখতে দেখতে মিকার বাইক ছুটে যায় আমাকে সাওয়ারি করে। ম্যাপের দেখানো পথে ধরে আমরা মূল পিচঢালা সড়ক থেকে হাতের বায়ের দু’পাশে শুকিয়ে আসা ঝোঁপের মাঝের মাটির সড়ক ধরে এগিয়ে যাই। অনেকখানি যাওয়ার পরেও কোনও মন্দিরের দেখা পাই না। দূরে গ্রাম থেকে মানুষ আসতে দেখে আমরা ওনাদের আসার জন্য অপেক্ষা করলাম। কাছে আসার পর আমাদের উচ্চারণে মন্দিরের নাম বলে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না কোথায় যেতে চাই। ওনারাও আবার ইংরেজি জানেন না। কিন্তু অনেক পর্যটক আসে বলে হয়তো আন্দাজ করে নিয়েছিল কোথায় যেতে চাইছি। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল আমরা ভুল রাস্তায় ঢুকে গেছি। মূল সড়ক ধরে এগিয়ে হাতের বায়ের পরের রাস্তা ধরে আমাদের যেতে হবে। আবার ছুটল মিকার ইজিবাইক। এবারের রাস্তা বেশ খানিকটা প্রশস্ত কিন্তু, সাংঘাতিক এবড়োথেবড়ো। এবার মনে হল সঠিক রাস্তাতেই এসেছি। আমাদের মতো আরও বাইক আছে এই রাস্তায়। রাস্তা এক জায়গায় এসে দু’ভাগ হয়ে গেছে। ম্যাপ দেখে বুঝতে পারছি না আমাদের ডানে যাওয়া উচিত, না বাঁয়ে। ডানের পথের দিকে তাকিয়ে কাছাকাছি কোন বৌদ্ধ বিহার বা জাদি কিছুই দেখতে পেলাম না। অনেক দূরে আবছামতো একটা দেখা যাচ্ছে বটে। আবার বাঁয়ের পথে তাকিয়ে কাছাকাছি একটা মন্দির মতো স্থাপনা চোখে পড়ে। দুই পশ্চিমা পর্যটকও আমাদের মতো চরকি কাটতেকাটতে একই জায়গায় এসে থেমেছে। প্রচন্ড দ্বিধান্বিত সবাই। পশ্চিমারা ডানের পথ ধরে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল, আর আমরা বাঁয়ের পথ। প্রায় ছয়টা বেজে যাচ্ছে, সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছে, তাই কাছের স্থাপনাতেই যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। মন্দিরের মতো দেখতে স্থাপনার সামনে এসে দেখি এখানে এক পরিবার ঘর বানিয়ে বসবাস করে। অনুমতি নিয়ে আমরা স্থাপনার ছাদে উঠে গেলাম সরু সিঁড়ি ধরে। আমি আর মিকা ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। চারপাশে ছড়ানোছিটানো ছোটছোট মঠ। সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আমরা বসে রইলাম। অনেক সময় পর পূর্বাকাশ কিছুটা রঙিন হলো বটে, কিন্তু কুসুমের মতো যে সূর্যের অপেক্ষায় বসেছিলাম, সেই সূর্যের দেখা পেলাম না। ছাদ থেকে নিচে নামলাম। বাড়ির মানুষ সকালের নিত্য কাজে ব্যস্ত। ভাঙাভাঙা কথা বলে জানা গেল, আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মঠগুলো কোনও এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সমাধি মন্দির। শ্মশান না সমাধি এটি অবশ্য খুব একটা পরিষ্কার হল না আমার কাছে। আর যে স্থাপনার উপরে উঠেছিলাম সেটি ছিল তাদের পারিবারিক উপাসনালয়। যে পরিবারটি এখানে আছে, তারা এগুলো দেখেশুনে রাখে। পাশের জমিতে ফসল ফলায়। বাড়ির ভদ্রলোককে কথা বলতে বলতে পকেট থেকে পাতার বিড়ি বের করে জ্বালাতে দেখে কৌতূহলবশত আমিও একটা চেয়ে নিলাম। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম বয়স্ক নারী ব্যাতিত, কম বয়সী মেয়েরা এখানে প্রকাশ্যে বিড়ি বা সিগেরেট খায় না। বার্মিজ বিড়ির কথা বাংলাদেশে অনেক শুনেছি, তাই কৌতূহল দমন সম্ভব হয়নি। একটান দিতেই মাথা চক্কর দিতে লাগলো, বেড়াতে এসে অসুস্থ হতে চাই না। আমার অবস্থা দেখে সবাই খুব মজা পেয়ে গেল। ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইলাম তার একটা বিড়ি নষ্ট করার জন্য। মিকা ছবি তুলে স্মৃতি ধরে রাখল।

গতরাতে গাড়ি ঠিক করে রেখেছি প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের পোপা মাউন্টেনে যাবার জন্য। কোথাও গেলে, পাহাড়ে উঠা আমার তালিকার সবার উপরে থাকে। আর এই বাগানের আশেপাশের বিখ্যাত পাহাড় হলো মাউন্টেন পোপা। এই মাথায় আবার আছে আত্মারূপী দেবতা নাতদের প্রাচীন মন্দির। এই এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের আগে স্থানীয়রা এই নাতদের পূজা করত। মূলত হিন্দু দেবতার পূজা হয় ওই মন্দিরে। পাহাড়ে চড়ার উত্তেজনা নিয়ে ফিরতে লাগলাম হোস্টেলে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাঁওলি মিত্র, একজন নক্ষত্র
পরবর্তী নিবন্ধমানবিক সেবাদানে ভূমিকা রাখছে লায়ন্স সার্ভিস কমপ্লেক্স