লং কোভিড কেন হয়, কী চিকিৎসা?

| মঙ্গলবার , ২০ জুলাই, ২০২১ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যাপারটা ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা খেয়াল করেছিলেন। প্রথম দিকে বলা হয়েছিল, করোনা সংক্রমণের ফলে শতকরা ৯০ জনের ক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ত এবং মৃদু অসুস্থতা দেখা দেয়; জ্বর, কাশি, স্বাদ-গন্ধ না পাওয়া ইত্যাদি। যা সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই সেরে যায়। যাদের ওজন বেশি বা যাদের ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হৃদরোগ ইত্যাদির মতো কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা আগে থেকেই আছে তাদের জন্যই এটি বিপদ বা মৃত্যু ঝুঁকির কারণ। কিছুকাল পর দেখা গেল, করোনা সংক্রমিতদের অনেকের জ্বর-কাশির মতো উপসর্গগুলো সেরে গেলেও তারা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছেন না।
তাদের ফুসফুসের গুরুতর ক্ষতি হয়ে গেছে। অবসন্নতা ও বুক ধড়ফড়ানি দেখা দিচ্ছে। স্মৃতিশক্তি কমে গেছে। অনেকে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে, হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে তাদের মাসের পর মাস সময় লাগছে। কাউকে কাউকে ফিজিওথেরাপি নিতে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট হলো, এগুলো আসলে করোনা সংক্রমণের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া। তখন থেকে লং কোভিড কথাটা চালু হলো। যতই দিন যাচ্ছে ততই এটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে যে, যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অনেকের মধ্যেই লং কোভিড সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যারা প্রথম দফা ভাইরাস সংক্রমণে খুব একটা অসুস্থ হননি, তাদের মধ্যেও লং কোভিড হতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, যারা টিকা নেননি বা মাত্র এক ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে বড় মাত্রায় লং কোভিড দেখা দিতে পারে। খবর বিবিসি বাংলার। লং কোভিডের লক্ষণ কী? : যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী কেউ যদি করোনা সংক্রমণের পর ১২ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যদি রোগীর দেহে এমন অসুস্থতার লক্ষণ রয়ে যায়, যার কারণ হিসেবে অন্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে হবে তার লং কোভিড হয়েছে।
লক্ষণগুলো হচ্ছে : ১. চরম ক্লান্তি বা অবসন্নতা। ২. শ্বাস নিতে কষ্ট বা হাঁপিয়ে ওঠা, হৃৎপিণ্ডের ঘন ঘন স্পন্দন বা বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা বা টানটান ভাব। ৩. স্মৃতি শক্তি বা মনঃসংযোগের সমস্যা। ৪. স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতিতে পরিবর্তন। ৫. হাড়ের জোড়ায় ব্যথা। লং কোভিডের অন্তত ২০০টি লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন ব্রিটেনের ইউসিএলের বিশেষজ্ঞরা। এসব লক্ষণের মধ্যে আছে হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম, নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন, স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি লোপ, কথা বলা ও ভাষার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেওয়া। অনেকের ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্র ও মূত্রাশয়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব ও ত্বকের অবস্থায় পরিবর্তন দেখা গেছে। এসব লক্ষণ কতটা গুরুতর হবে তা একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক রকম।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, লং কোভিডের কারণে তারা শাওয়ারে স্নান করা, দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র কেনা বা কথা মনে রাখার মতো কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশের রোগী ও ডাক্তাররা কী বলছেন? : বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হবার পর সেরে উঠলেও মাসের পর মাস অসুস্থ ছিলেন এ রকম কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছে। ঢাকায় মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. টিটো মিয়া বলেন, মানসিক অবসাদ থেকে শুরু করে স্মৃতিভ্রমের মতো জটিল নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে সুস্থ হওয়া মানুষের শরীরে। রোগীরা বলে, তারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন, তাদের কিছু ভালো লাগছে না, কিছু করতে ইচ্ছা করছে না। কারও কারও হঠাৎ করে মনে হয়, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারও কারও ফুসফুসে জটিলতা দেখা দেয়। কেউ হার্টের সমস্যায় পড়েন, অনেক সময় কার্ডিয়াক ডেথও হয়ে যায়। হার্ট বিট কখনও স্লো হয়ে যায় বা খুব বেড়ে যায়। এছাড়া অনেকের ভুলে যাওয়াটা বেড়ে যায়।
ভেন্টিলেটরে থাকা কোভিড রোগীদের চ্যালেঞ্জ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রতি ২০ জনের একজনের হয়ত নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসা দরকার হতে পারে। এর মানে হলো, তাদের সংজ্ঞাহীন করে রাখা এবং ভেন্টিলেটর লাগানো। রোগীকে যদি ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকতে হয় তাহলে তার সেরে উঠতেও সময় বেশি লাগবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো রোগীকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ক্রিটিক্যাল কেয়ারে থাকতে হলে, তার পুরোপুরি সুস্থ হতে ১২ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত লাগতে পারে।
কীভাবে জানা যাবে? : লং কোভিড ধরার কোনো ডাক্তারি পরীক্ষা এখনো নেই। কারো লং কোভিড হয়েছে কিনা তা ডাক্তাররা এখনো নিরূপণ করছেন এভাবে, যখন আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই ধরে নেওয়া হচ্ছে যে তার লং কোভিড হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে ডাক্তাররা রোগীর ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের কার্যকারিতা, আয়রনের অভাব ইত্যাদি সমস্যা আছে কিনা তা টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে নেবেন।
টিকা নিলে কাজ হবে? : লং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর যারা টিকা নিয়েছেন তাদের প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত ভ্যাঙিন নেওয়ার পর তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। এর ফলে শরীরে করোনার কোনো ক্ষুদ্র টুকরো রয়ে গেলে তাকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, টিকা নেওয়ার ফলে লোকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেই নিজেকে রক্ষা করতে পারছে। ফলে লং কোভিডের হাত থেকেও রেহাই পাচ্ছে।
চিকিৎসা আছে? : ব্রিটেনে এখন ৮৯টি বিশেষ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লং কোভিড আক্রান্তদের অবস্থা যাচাইয়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। তবে লং কোভিডের চিকিৎসার জন্য এখনো কোনো প্রমাণিত ওষুধ নেই। ডাক্তাররা যা করছেন তা হলো রোগীর উপসর্গগুলোর শুশ্রুষা এবং পর্যায়ক্রমে রোগীর শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যাদের কোভিড থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘদিন লাগে, তাদের দরকার প্রচুর বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং প্রচুর পানি পান করা। কোনো কোনো রোগীর হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পেতে ফিজিওথেরাপি দরকার হয়। ধূমপান না করা, মদ্যপান কমানো, শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা-এগুলো মেনে চলতে পারলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে অল্পদিনেই সেরে ওঠা সম্ভব।
সমপ্রতি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৭ জন গবেষকদের একটি দল লং কোভিড নিয়ে গবেষণা করেছেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মো. ফিরোজ কবির বলেন, ২০২০ সালের মে মাস থেকে শুরু করে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত এক বছর দুই হাজারের বেশি কোভিড রোগীর উপর চালানো গবেষণাটিতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৫ শতাংশ কোভিড রোগী লং কোভিডে ভুগছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এখন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার নির্ধারিত ঢাকায় সরকারি কয়েকটি হাসপাতালে সুস্থ হওয়াদের ছাড়পত্র দেওয়ার সময় ফলোআপ চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সারা দেশের সরকার- বেসরকারি সব হাসপাতালের জন্য কোভিডের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কাটানোর চিকিৎসার কোনো পরিকল্পনা বা কোনো প্রটোকল এখনো নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপেগাসাস কী, এটা কীভাবে ফোন হ্যাক করে?
পরবর্তী নিবন্ধপোশাক শিল্পের রপ্তানি আদেশ বাতিলের শংকা বিজিএমইএ নেতার